যদি কোনো শিক্ষার্থীকে জিজ্ঞাসা করা হয়, দর্শন আর বিজ্ঞানের মধ্যে সম্পর্ক কি- তাহলে সে এর উত্তর নাও জানতে পারে। এই দুই বিষয়ের মধ্যে কোনো সম্পর্ক আদৌ থাকতে পারে কিনা- এই ব্যাপারে সে সন্দিহান হতে পারে। বাস্তবপক্ষে বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায়, দর্শন আর বিজ্ঞান- জ্ঞান চর্চা আর বিকাশের সম্পূর্ণ দুইটি ভিন্ন ভিন্ন শাখায় পরিণত হয়েছে । তবে, কিছু কাল আগেও দর্শন এবং বিজ্ঞান ছিল জ্ঞানের একই পথের যাত্রী। জ্ঞানের এই দুই শাখার মধ্যে ছিল গভীর মিতালি।
ক্রমাগত ধারণার পার্থক্য আর আধুনিক মতবাদের উদ্ভাবনে একসময় বিজ্ঞান আর দর্শনের একই সাথে চলমান থাকা নিষ্প্রয়োজন আর সাংঘর্ষিক হয়ে যায়। তাই, জ্ঞান চর্চার প্রয়োজনেই বিজ্ঞান আর দর্শনের বিচ্ছেদ ঘটে।
প্রথমে জেনে নেয়া যাক, দর্শন বলতে কী বোঝায় ?
দর্শন হচ্ছে মানব সভ্যতার আদি জ্ঞানভাণ্ডার। জগৎ, জীবন , মানব সমাজ, সমাজচিন্তা এবং জ্ঞানের প্রক্রিয়া- প্রভৃতি মৌলিক বিধানের আলোচনা "দর্শন" নামে পরিচিত। আদি মানবসমাজে আজকের মতো বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির ব্যবহার আর ধারণা ছিল না। তবে, বিচার-বিবেচনা আর চিন্তার দক্ষতা মানুষকে তার চারিদিকের জগৎ সম্পর্কে অভিহিত রেখেছে। মানুষের চিন্তা ব্যাখ্যা করতে চেয়েছে জগতের সকল স্বাভাবিক কার্যক্রমকে। মানবসভ্যতার প্রারম্ভিক সময়ে এই জগৎ ও জীবনের প্রায় প্রত্যেকটি সমস্যা মানুষ সমাধানের চেষ্টা করেছে যেকোনো কাল্পনিক বিষয় বর্ণনার মাধ্যমে। তাই, দর্শনভিত্তিক সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা- নিরীক্ষার ভিত্তিতে সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে কাল্পনিক সমাধানের সমাহার বেশি চোখে পড়ে। আসলে, দর্শনের মুখ্য বিষয় প্রজ্ঞা। তাই, একজন দার্শনিক কেবল তথ্যগত ও পরীক্ষালব্ধ জ্ঞানের ওপর নির্ভর করেন না- পাশাপাশি নিজের অর্জিত জ্ঞানকে ভাবনার অসীমে বিস্তৃত করতে চান।
বিজ্ঞান বলতে কী বোঝায়?
ইতিহাসে বিজ্ঞান মূলত দর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা "প্রাকৃতিক দর্শন" হিসেবে যাত্রা শুরু করে ৷ বিজ্ঞান, বাস্তব জগৎ আর জীবনের বিভিন্ন ধারণা-অনুভূতি প্রচেষ্টার মাধ্যমে প্রকাশ আর প্রমাণ করতে সচেষ্ট থাকে ৷ বৈজ্ঞানিক পাঠ গভীর থেকে উপলব্ধির জন্য প্রয়োজন গাণিতিক ধারণার সান্নিধ্য। বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক বিষয়গুলোর জন্য অনুমানকৃত ধারণাগুলো পরীক্ষা দ্বারা নির্ধারিত এবং যাচাইযোগ্য।
চলুন, এবার জেনে নেওয়া যাক, বিজ্ঞান যদি দর্শনেরই একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা হয়ে থাকে তবে তা দর্শন থেকে আলাদা হলো কীভাবে?
তুলনামূলক আধুনিক সমাজে, মানুষের যখন বিভিন্ন বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে জ্ঞান বিকশিত হয়, তখনও দর্শনকে অনেকে আবদ্ধ করার চেষ্টা করেছেন কেবল কল্পনায় আর কথিত ধারণায়। তাদের এই চেষ্টার কারণে দর্শন জীবনের বাস্তব সমস্যার সঙ্গে অনেকটা সম্পর্কশূণ্য হয়ে পড়ে। যেখানে, প্রাচীনকালে জীবনের সমস্যা আর সমাধান প্রচেষ্টা দর্শনের বিকাশ ঘটিয়েছে, সেখানে এই ধরণের অবান্তর প্রচেষ্টায় দর্শন, বাস্তব জীবনের সঙ্গে কম সম্পর্কযুক্ত হয়েছে আর অবাস্তব কল্পনায় পর্যবসিত হয়েছে। পাশাপাশি, দর্শনের আদি ধারণা আর তত্ত্বকে "প্রারম্ভিক কালের বিজ্ঞান" মেনে নিতে পারে নি। অধুনা বিজ্ঞান চর্চার ফলে পরীক্ষালব্ধ উপায়ে একটি নির্ধারিত ধারণা আর স্বীকার্য এর দিকে মানুষ যখন এগিয়ে যেতে থাকে, তখন অনেক সময় দর্শনের ধারণাগুলো গবেষণা করে জ্ঞান অর্জনের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বতন্ত্র বিজ্ঞান প্রাকৃতিক বিভিন্ন ঘটনাগুলোকে কেবল ধারণা আর চিন্তার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে পারে না। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জগতের স্বাভাবিকতা বিশ্লেষণ আর অজানাকে আবিষ্কার করার দৃঢ় মানসিকতা নিয়ে বিজ্ঞান যখন আধুনিক মানব সমাজের বিকাশের ভূমিকায় অবতীর্ণ, তখন কেবল ধারণার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত দর্শনের সাথে বিজ্ঞানের একাত্ম থাকাটাই কঠিন হয়ে পড়ে। এরই ধারাবাহিকতায়, ১০ম থেকে ১৩শ শতক পর্যন্ত গ্রিকদের অর্জিত জ্ঞান ও পশ্চিম ইউরোপীয়দের থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান " প্রাকৃতিক দর্শন " হিসেবে পুনর্গঠিত হয়। পরবর্তীতে, ১৬শ শতকের শুরুতে হওয়া বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের সময় থেকে রূপান্তরিত হতে হতে ১৯শ শতকের মধ্যেই পেশাগত ও বিদ্যাগত বিজ্ঞানের পূর্ণ রূপ পেয়ে "প্রাকৃতিক বিজ্ঞান" আর "ভৌত বিজ্ঞান" রূপে আত্মপ্রকাশ করে।
দর্শন আর বিজ্ঞানের বিচ্ছেদর ব্যাপারে আধুনিক কালের একজন প্রথিতযশা বিজ্ঞানী, লুইস ডি ব্রগলি ( যিনি কণার তরঙ্গধর্মের ধারণা প্রদান করেন) এর কথাগুলো উল্লেখ করা যেতে পারে-
" উনিশ শতকের সময় দার্শনিক আর বিজ্ঞানীদের মধ্যে যেন একরকম বিচ্ছেদ হয়ে যায়। কেননা, বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন দার্শনিক ধারণাকে সন্দেহের তীরে বিদ্ধ করেন কারণ, সেগুলোতে কোনো নির্ধারিত তথ্য বা অর্জন ছিল না আর বাস্তব জীবনে সেগুলোর প্রয়োগ সম্পর্কে তাঁদের মনে দ্বিধা ছিল।
অন্যদিকে, দার্শনিকরা বিশ্বাস করতেন, বিজ্ঞান আর নির্ধারিত পরীক্ষালব্ধ স্বীকার্য মানুষের ভাবনার দ্বার বন্ধ করে দেয় আর জ্ঞানের বিকাশের একপ্রকার সংকীর্ণতা তৈরি করে। যে যাই বলুক, একথা সত্য যে, বিজ্ঞানী আর দার্শনিকদের বিচ্ছেদের ফলে তাঁরা উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
Tanha Hossain
Team Science Bee