মহাকাশ গবেষণার মাইলফলক হবে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপঃ
মহাকাশ গবেষণায় আরেকটি মাইলফলক সংযোজিত হতে যাচ্ছে। নাসা (NASA), ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি ও কানাডিয়ান স্পেস এজেন্সি যৌথভাবে তৈরি করেছে একটি টেলিস্কোপ, নাম দেওয়া হয়েছে - জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ (James Webb Space Telescope- JWST). এটি উৎক্ষেপণের পর মেরামতের কোনো সুযোগ থাকবে না; তাই সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করে হাজারো রকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ক্যালিব্রেশন করতে গিয়ে এর উৎক্ষেপণ বেশ কয়েকবার পিছিয়েছে। ২৫ ডিসেম্বর, ২০২১ দক্ষিণ আমেরিকার ফ্রেঞ্চ গায়ানা থেকে স্থানীয় সময় সকাল ৯.২০ মিনিটে ( বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৬:২০) JWST-টি এরিয়ান ৫ রকেটের (Ariane 5 rocket) মাধ্যমে উৎক্ষেপণ করা হবে। হাবল টেলিস্কোপের চেয়ে ১০০ গুণ শক্তিশালী এই টেলিস্কোপটি তৈরিতে খরচ হয়েছে প্রায় ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ প্রোজেক্ট ১৯৯৬ সালে শুরু হয়, পঁচিশ বছর ধরে চলে এর নির্মাণ কাজ। এর মিশন হবে ১০ বছরের কাছাকাছি। এর শক্তির ধারণা দিতে গিয়ে প্রকৌশলীরা বলেছেন, চাঁদপৃষ্ঠে থাকা একটি মৌমাছিও সনাক্ত করা যাবে এটি দিয়ে। মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রে এটিই সবচেয়ে বড় সায়েন্স প্রোজেক্ট। মহাবিশ্বের বড় কিছু রহস্যের উদঘাটন ও প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার লক্ষ্যে JWST-টি তৈরি করা হয়েছে। এই প্রজেক্ট সফল হওয়ার পর মহাবিশ্বের অনেককিছু নতুনভাবে দেখবে ও জানবে মানুষ।
JWST-টি স্থাপন করা হবে পৃথিবী থেকে ১৫ লাখ কিলোমিটার দূরে, ল্যাগ্রেঞ্জ পয়েন্টে (Lagrange point). (এই ল্যাগ্রেঞ্জ পয়েন্ট হচ্ছে এমন একটি স্থান যেখানে পৃথিবী আর সূর্যের আকর্ষণক্ষমতা একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এখানে সহজেই কোনো বস্তু ভেসে থাকতে পারে।) পৃথিবী থেকে উৎক্ষেপণের পর ওই পয়েন্টে পৌঁছতে সময় লাগবে ২৯ দিন। স্হাপনের পরবর্তী ৫-৬ মাস পর্যন্ত এর প্রতিটি ইন্সট্রুমেন্টের ক্যালিব্রেশন (calibration) চলবে। তারপর ডিভাইসটিকে পরিপূর্ণভাবে কাজে ছেড়ে দেওয়া হবে। টেলিস্কোপটি পৃথিবীতে থাকা বিজ্ঞানীদের সাথে হাই ফ্রিক্যুয়েন্সি রেডিও ট্রান্সমিটারের সাহায্যে যোগাযোগ রক্ষা করবে।
এটি ইতিহাসের সবচেয়ে জটিল স্পেস এ্যাকটিভিটি হতে চলেছে। বিজ্ঞানীরা JWST-কে টাইমমেশিন হিসেবেও আখ্যা দিচ্ছেন। কারণ লং ওয়েভ লেন্থের কাভারেজের শক্তি থাকায় এটি মহাকাশের দূর অতীত দেখতে পারবে। যেসব নক্ষত্র ও গ্যালাক্সি বিলিয়ন বছর আগে তৈরি হয়েছিল, যার আলো পৃথিবীতে এখনো পৌঁছেনি, সেগুলোও জেমস ওয়েবের গোচরীভূত হবে। ইনফ্রারেড-রে সনাক্ত করার ক্ষমতা থাকায় এটি গ্যাস, ডাস্ট, ঘন মেঘ ইত্যাদির আড়ালে থাকা স্পেস বডিকে দেখতে সক্ষম হবে। ফলে অন্যান্য টেলিস্কোপের দৃষ্টিগোচর হয়নি এমন জগৎ বা বিস্ময়কর কিছুর দেখাও মিলতে পারে। টেলিস্কোপটি অসীম মহাশূন্যে প্রখর দৃষ্টি ফেলে বিলিয়ন বিলিয়ন বছর অতীতে মহাবিশ্ব সৃষ্টির শুরুতে প্রাচীনতম গ্যালাক্সিগুলোর তথ্য তুলে ধরবে, জানা যাবে মহাবিশ্বের সৃষ্টি ও বিবর্তনের প্রক্রিয়া। JWST-টি প্রধান যে কয়টি ক্ষেত্রে ফোকাস করবে সেগুলো হচ্ছে : (১) মহাবিশ্বের প্রথম আলো ও বিগব্যাঙের পর প্রারম্ভিক মহাবিশ্বে গ্যালাক্সির গঠন প্রক্রিয়া (২) গ্যালাক্সির বিবর্তন প্রক্রিয়া অধ্যয়ন (৩) তারকামণ্ডলীর গঠন ও প্ল্যানেটারি সিস্টেম উদ্ঘাটন (৪) জীবনের উৎপত্তি খোঁজ করা।
এসব গবেষণার মধ্য দিয়ে সম্ভাব্য বসবাসযোগ্য সেলেসটিয়ালএসব গবেষণার মধ্য দিয়ে সম্ভাব্য বসবাসযোগ্য সেলেসটিয়াল বডির (গ্রহ/উপগ্রহ ইত্যাদি) সন্ধান মিলতে পারে। মানুষের মনের সবচেয়ে কৌতূহলী প্রশ্ন আমরা কি এই ব্রহ্মাণ্ডে একা? না-কি আছে কোনো এলিয়েন? জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের মাধ্যমে পৃথিবীবাসী সন্ধান পেয়ে যেতে পারে চিরায়ত কল্পনার সেই এলিয়েনেরও!
এস্ট্রোনোমির জগতে মহারোমাঞ্চকর একটি ঘটনা ঘটতে চলেছে। কিন্তু তা ঘটছে নিভৃতে, অজ্ঞাতে। রাজনীতি, অর্থনীতি, জীবিকা, আনন্দ-বিনোদন-বেদনার মাঝে, এককথায় জীবনের তাৎক্ষণিক চাহিদার ভিড়ে, জীবনঘনিষ্ঠ নয় বিধায় জ্যোতির্বিজ্ঞানের বিষয়াদি সবসময় লুকায়িতই থাকে। চাঁদে গমনের চেয়েও অনেক বড়, জটিল, অবিশ্বাস্য প্রভাব বিস্তারকারী ও ফলপ্রদায়ী ঘটনা হতে যাচ্ছে JWST-এর মিশন। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা নেইল আর্মস্ট্রং-এর মতো করে বলতেই পারেন-" That’s one short launch of a telescope for astronomers, a long travel towards universe for mankind".
লিখেছেনঃ Ab Ta He Taha (Science Bee - বিজ্ঞান গ্রুপ)