কোরবানির ঈদ মানেই খাবার তালিকায় থাকবে মাংস। ঈদ পরবর্তী দিনগুলোতেও কোরবানির গরুর মাংসের বিভিন্ন বাহারি পদ আয়োজন করা হয়। গরুর মাংস দিয়ে রান্না করা লোভনীয় খাবার এড়িয়ে চলা মুশকিল। তারচেয়েও বড় মুশকিল হচ্ছে গরুর মাংস খেলেই দেখা দেয় অ্যালার্জি। অনেকের আবার মাংস কাটার সময় ধরলেও হয় অ্যালার্জি। ঠিক কী কারণে হয় এমন অ্যালার্জি, প্রতিকারের উপায় কী? চলুন বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক :
বর্তমানে সময়ে খাবারে অ্যালার্জি পরিচিত একটি সমস্যা, প্রায় ৮% শিশু ও ২% প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের খাবারে অ্যালার্জি থাকে। মানুষের গরুর মাংস, ভেড়া বা ছাগলের মাংস, হাঁস বা মুরগির মাংসে অন্যান্য খাবারের থেকে অ্যালার্জি তুলনামূলক কম হয়। অ্যালার্জির একটি কারণ হলো মাংসের প্রোটিন যা অ্যালার্জেনকে ট্রিগার করে। মাংস রান্না করার পর অ্যালার্জি হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। তা সত্ত্বেও অধিকাংশ মানুষের রান্না করা গরুর মাংস খেলেও দেখা দেয় অ্যালার্জি। যেসব মাংসে মানুষের অ্যালার্জি আছে তা খাওয়ার সাথে সাথে শরীরের ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা প্রতিক্রিয়া দেখানো শুরু করে দেয়।
মাংস খাওয়ার পর অ্যালার্জেনের সংস্পর্শে ইমিউন সিস্টেম সক্রিয় হয়ে উঠে এবং কোষ থেকে হিস্টামিন নিঃসরণ হয়ে রক্তের মাধ্যমে প্রবাহিত হয়, যার জন্য অ্যালার্জি সৃষ্টি হয়। হিস্টামিন দেহে তাৎক্ষণিক এবং কখনো কখনো গভীর প্রভাব সৃষ্টি করে, যেমন : রক্তনালী প্রসারিত হয় এবং মিউকাস উৎপাদনকারী কোষগুলি সক্রিয় হয় যা ত্বক, পরিপাকতন্ত্র এবং শ্বাসযন্ত্রকে প্রভাবিত করে। এছাড়াও সেরেটোনিন, নোরেপিনেফ্রিন নিঃসরণ হলে চুলকানি ও মানসিক চাপ সৃষ্টি হতে পারে। মাংসে অ্যালার্জি জীবনের যেকোনো পর্যায়ে বিকাশ লাভ করতে পারে। নির্দিষ্ট রক্তের গ্রুপ, অন্যান্য খাবার যেমন : ডিম, হাঁস ও মুরগির মাংস, চিংড়ি ইত্যাদিতে অ্যালার্জি আছে এমন মানুষের গরুর মাংসে অ্যালার্জি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
নির্দিষ্টভাবে গরুর মাংসে অ্যালার্জি হলো রেড মিট বা লাল মাংস খাওয়া বা আলফা-গ্যাল আছে এমন উপাদানের সংস্পর্শে আসার ফলে সৃষ্ট একটি বিরুপ প্রতিক্রিয়া। গরুর মাংসে অ্যালার্জি আলফা-গ্যাল এর সাথে সম্পর্কিত। গরুর মাংসে গ্যালাকটোজ-আলফা-1,3-গ্যালাকটোজ নামক কার্বোহাইড্রেট থাকে যা সাধারণত আলফা-গ্যাল নামে পরিচিত। আলফা-গ্যাল স্তন্যপায়ী প্রাণীদের কোষ ঝিল্লীতে থাকা একটি কার্বোহাইড্রেট। লাল মাংসে অ্যালার্জি বা আলফা-গ্যাল অ্যালার্জি বা ম্যামালিয়ান মিট অ্যালার্জি (MMA) A ও O রক্তের গ্রুপের মানুষের মধ্যে প্রায়শই দেখা যায়। AB ও B রক্তের গ্রুপের মানুষের লাল মাংসে অ্যালার্জি হওয়ার সম্ভাবনা পাঁচগুণ কম। গবেষকদের মতে, এর কারণ AB ও B রক্তের গ্রুপের B অ্যান্টিজেন মাংসে অ্যালার্জি সৃষ্টিকারী অ্যালার্জেনের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ।
গরুর মাংসে অ্যালার্জির লক্ষণ :
১. মুখ, জিহ্বা, গলা, শরীরের অন্যান্য অংশ ফুলে লাল হয়ে যাওয়া এবং ফুসকুড়ি হওয়া।
২. চোখ ফুলে যাওয়া, চোখ থেকে পানি পড়া।
৩. পেট ব্যথা, ডায়রিয়া, বমি বমি ভাব।
৪. মাথাব্যথা, হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া।
৫. নাক দিয়ে পানি পড়া, হাঁচি।
৬. নিঃশ্বাসের দুর্বলতা, শ্বাসকষ্ট।
গরুর মাংসে অ্যালার্জি প্রতিক্রিয়া অল্প থেকে গুরুতর পর্যন্ত হতে পারে। নির্দিষ্ট মাংসের অ্যালার্জেনের প্রতি মানুষের সংবেদনশীলতা কতটুকু তার উপর নির্ভর করে লক্ষণ দ্রুত বা কয়েক ঘন্টার মধ্যে দেখা দিতে পারে।
গরুর মাংসে অ্যালার্জি নির্ণয় ও প্রতিরোধ :
মাংসে অ্যালার্জি আছে কিনা নির্ণয় করার জন্য রক্ত পরীক্ষা করা হয়। রক্ত পরীক্ষায় অ্যান্টিবডি সনাক্ত করা হয় যা ইমিউনোগ্লোবিউলিন-ই (IgE) নামে পরিচিত। এছাড়াও বিভিন্ন টেস্টের মাধ্যমে মাংসে অ্যালার্জি নির্ণয় করা হয়। গরুর মাংসের অ্যালার্জির নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা না থাকলেও অ্যালার্জি প্রতিরোধ করা সম্ভব। যেমন : প্রথমত, যাদের মাংস ধরলেও অ্যালার্জি হয় তারা কোরবানির সময় শরীর যতটুকু সম্ভব মাংসের সংস্পর্শ থেকে দূরে রাখা, মাংস কাটার সময় গ্লাভস ব্যবহার করা। গরু মাংসের অত্যাধিক অ্যালার্জি থাকলে না খাওয়াই সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত। গরুর মাংসের বদলে খাসি, ছাগল, ভেড়া ইত্যাদির মাংস খাওয়া যেতে পারে। এছাড়াও ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ঔষধ গ্রহণ এবং একটু সাবধানতা অবলম্বন করলে কোরবানি ঈদে অ্যালার্জি কিছুটা হলেও প্রতিরোধ করা সম্ভব।
পরিশেষে, সবার ঈদ কাটুক সুস্থতার সাথে, সবাইকে জানাই ঈদের শুভেচ্ছা।
- নিশাত তাসনিম (সায়েন্স বী)
রেফারেন্স : ১. https://www.verywellhealth.com/meat-allergy-82891
২. https://www.nyallergy.com/beef-allergy/
৩. https://www.mayoclinic.org/diseases-conditions/alpha-gal-syndrome/symptoms-causes/syc-20428608
৪. https://my.clevelandclinic.org/health/diseases/8610-allergy-overview-allergy-overview
৫. https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC7405174/
৬. https://www.medscape.com/viewarticle/893575