পৃথিবীর ভবিষ্যৎ কী—এটা বড় একটা প্রশ্ন। দেখা যাক, প্রশ্নটাকে টুকরা করে উত্তর দেওয়া যায় কি না। যেমন, পৃথিবীর নিকট-ভবিষ্যৎ কী? আগামী ৫০ থেকে ১৫০ বছরে পৃথিবী কোন দিকে যাবে, সেটা বরং জানার চেষ্টা করা যাক।
জিন সম্পাদনা করে নীরোগ, নির্মেদ (কিন্তু নির্লোভ অবশ্যই নয়) ‘আদর্শ’ মানুষ তৈরি করার বিদ্যা মানুষ আগামী ৫০ থেকে ১৫০ বছরের মধ্যে খুব ভালোভাবেই রপ্ত করবে। ক্রিস্পার ক্যাস৯-এর (CRISPR-Cas9) মতো জিন এডিটিং টুল এখনই চলে এসেছে। আর ক্যানসারের নিরাময়ে অর্জিত অগ্রগতির কারণে বয়স ১০০ বছরের নিচে কেউ আর ক্যানসারের বলি হবে না। কাজেই মানুষের গড় আয়ু আরও বাড়বে, যেমনটা গত দেড় শ বছরে ধরে বেড়েই এসেছে।
কিন্তু আগামী দেড় শ বছরের মধ্যে মানুষ সিঙ্গুলারিটি পয়েন্টে, অর্থাৎ মানুষ অমর হবে—এ কথা হলফ করে বলতে পারছি না। উনিশ শতকে মানুষ গড়ে মাত্র ৩৭ বছর বাঁচত, আজকে বাঁচছে ৭৮ বছর। কাজেই সিঙ্গুলারিটি পয়েন্টে পৌঁছাতে না পারলেও আগামী ১৫০ বছরে যে গড় আয়ু বেড়ে ১০০ পার করবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
ভাবুন তো, একদিকে মানুষ ১৫০-২০০ বছর বাঁচছে, অন্যদিকে জনসংখ্যা বেড়ে ১৩ বিলিয়ন ছাড়িয়ে গেছে (পৃথিবীর বর্তমান জনসংখ্যা ৭.৩ বিলিয়ন, ২০৫০ সালে জনসংখ্যা বেড়ে হবে ৯.৭ বিলিয়ন আর ২১০০ সালে হবে ১১.২ বিলিয়ন), এ রকম এক পৃথিবী ১৫০ বছর পরে সামান্য আর্থসামাজিক ভারসাম্যহীনতাতেই কিন্তু ভীষণ রকম ডিস্টোপিয়ান হয়ে উঠতে পারে। দেখা দিতে পারে আরও বেশি অসাম্য; সেখান থেকে হতাশা ও নৈরাজ্য।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা খাটিয়ে উৎপাদনে রোবটের ব্যবহার এমন একপর্যায়ে পৌঁছতে পারে যে আফ্রিকা ও এশিয়ার বিশাল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে ধনী দেশগুলোর সম্পদের ফারাক সাত আসমানচুম্বী হয়ে উঠবে। উন্নত দেশগুলোর ত্রুটিহীন মানবজিনোমের অধিকারী বড়লোকেরা হয়তো আজ থেকে ১০০ বছর পর স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করবেন না। এরা তাঁদের বিপুল সম্পদ নিয়ে প্রথমে পৃথিবীর আন্তর্জাতিক পানিসীমানায় নিজস্ব কৃত্রিম দ্বীপ বানিয়ে বড়লোকপাড়া স্থাপন করবে।
কৃত্রিম দ্বীপ কেন? কারণ মোনাকো বা সুইজারল্যান্ড বা পশ্চিম পাম বিচ যতই বিত্তবান এলাকা হোক না কেন; উত্তর আফ্রিকা বা মধ্যপ্রাচ্য বা লাতিন আমেরিকা থেকে কিন্তু বেশি দূরে নয়। খোদ উত্তর আমেরিকায় সাদারা তখন ভীষণ সংখ্যালঘু এক জাতি। ‘বেআইনি’ আর ‘অসম্পূর্ণ’ সাধারণ মানুষে সয়লাব হয়ে যাবে উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপ।
আর তাই আটলান্টিক বা প্যাসিফিকে সাগরের মাঝখানে পানির ওপরে (এবং নিচে) প্রতিষ্ঠিত হবে কিছু নতুন অতি সমৃদ্ধশালী (সুপার রিচ) সার্বভৌম রাষ্ট্র। এই দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর মহা বিত্তবান প্রায়-অমর মানুষেরাই পরে প্রথম সুযোগে চাঁদে বা মঙ্গল গ্রহে বা অন্য গ্রহগুলোতে বসতি স্থাপন করবে। আর জলবায়ুর দিক থেকে বিধ্বস্ত, প্রাকৃতিক সম্পদের দিক থেকে নিঃস্ব এই পৃথিবীতে পড়ে থাকবে গরিব দেশগুলোর জেনেটিকভাবে ‘অপরিশোধিত’ মানুষের দল।
এত কিছুর পরেও আগামী দেড় শ বছরে ভিন গ্রহের বুদ্ধিমান প্রাণের অস্তিত্বের সঙ্গে মানুষের দেখা না হওয়ার সম্ভাবনা বেশিই।
জিন সম্পাদনা করতে পারছে মানুষ। মুক্তি মিলতে পারে কঠিন সব রোগ থেকেজিন সম্পাদনা করতে পারছে মানুষ। মুক্তি মিলতে পারে কঠিন সব রোগ থেকে
আরেকটা আদি প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা না করলেই নয়—দেড় শ বছর পরে পৃথিবী আদৌ টিকবে তো? পরিবেশ বিপর্যয়ের যে বার্তা মিলছে, তাতে শঙ্কা একটা জাগেই। তবে দেড় শ বছরের মধ্যে পৃথিবীর স্বাভাবিক মৃত্যু হবে না, কিন্তু পৃথিবীর অনেক দেশই বেড়ে যাওয়া সমুদ্রের পানিতে (বৈশ্বিক উষ্ণতায় বিশ্বাস করুন আর না-ই করুন, সমুদ্রপৃষ্ঠ আগামী দেড় শ বছরে অন্তত ১ ফুট বাড়বে) ডুবে যাবে।
এমনকি নিউক্লিয়ার যুদ্ধেও শেষ হয়ে যেতে পারে আমাদের এই একমাত্র পৃথিবী। কাজেই সংক্ষেপে বলতে গেলে, বিজ্ঞানের ঝড়ের বেগে বিরামহীন অগ্রগতির কারণে গত ১৫০ বছরে পৃথিবী যেখানে এসে পৌঁছেছে, তাকে পেছনের আয়নার দ্রুত অপস্রিয়মাণ প্রতিচ্ছবি হিসেবে দেখলে, আগামী ১৫০ বছরে পৃথিবী কোথায় যাবে, সেটা বলতে পারাটা প্রায় অসম্ভব।
কে জানে, তখনকার কেউ হয়তো সার্চইঞ্জিন ঘেঁটে এই লেখাটা পড়বেন আর মুচকি মুচকি হাসবেন!
প্রতিবেদন ঃপ্রথম আলো