এই লেখাটি “আদর্শ” থেকে প্রকাশিত এবং চমক হাসান রচিত গ্রন্থ গণিতের রঙ্গে হাসিখুশি গণিত বই থেকে নেয়া হয়েছে।
আমি আমার অন্তর থেকে বিশ্বাস করি যে, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর বিষয়টা হচ্ছে গণিত। এখন আমি যদি মানুষকে বলি এটা পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর বিষয়, সবচেয়ে মজার বিষয়, মানুষ কেন আমাকে বিশ্বাস করবে? সেই চিন্তা থেকে আমি গণিতের খুব মজার কিছু বিষয় নিয়ে ভিডিও বানিয়ে ইউটিউবে আপলোড করি। আমি জানি শেখার জন্য ভিডিও বেশ আধুনিক একটা মাধ্যম, তবু সত্যিটা হলো— বইয়ের তুলনা বই-ই। তাই গণিতের সেই ভিডিওগুলোর তথ্য-উপাত্তকে অক্ষরে সাজিয়ে রাখার জন্য এই প্রয়াস!
একসময় যখন গণিতের ক্লাস নিতাম, প্রতিটা ক্লাস উৎসর্গ করতাম একেকজন গণিতবিদকে, শুনে শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ মজা পেত, আর কেউ কেউ আড়ালে বলত— পাগল নাকি? যে যা ভাবে ভাবুক, এই বইতেও সেই চর্চা থাকবে! শুরু করা যাক মধ্যযুগের এক গণিতবিদকে স্মরণ করে, যার নাম মোহাম্মদ ইবনে মুসা আল খোয়ারিজমি।
আজ থেকে ১২০০ বছর আগের একজন গণিতবিদ। আমরা অনেকেই ‘অ্যালগরিদম’ শব্দটা বোধ হয় শুনেছি। গণিত এবং কম্পিউটার বিজ্ঞানের খুব পরিচিত একটা শব্দ অ্যালগরিদম। অ্যালগরিদম শব্দটা আসলে তার নাম থেকে এসেছিল! আল খোয়ারিজমি থেকে ল্যাটিনে আল গরিদমি— সেই আল-গরিদমি থেকে অ্যালগরিদম!
যাহোক, এই যে আল খোয়ারেজমি, তার একটা বিখ্যাত বই ছিল। বইটার নামটা কিন্তু খুউব ছোট্ট— আল কিতাব আল মুখতাসার ফি হিসাব ওয়াল যাবুর ওয়াল মুকাবালা!! শেষের ‘আল যাবুর’ অংশটা গণিতে খুবই বিখ্যাত হয়ে আছে। এই ‘আল যাবুর’ থেকেই এসেছে অ্যালজেবরা নামটা! তো ‘আল যাবুর ওয়াল মুকাবালা’ দিয়ে খোয়ারেজমি সাহেব আসলে গণিতের দু’টি পদ্ধতির কথা বলতে চেয়েছিলেন। সেগুলো কী ছিল সেটাই এবার দেখা যাক।
আল যাবুর কী ছিল? একটা উদাহরণ দিয়ে বলি, আল যাবুর ছিল অনেকটা এরকম—
যদি ‘x+৩ = ৫’ হয় তবে ‘x = ৫-৩’
তার মানে সোজা বাংলায় এটা হচ্ছে পক্ষান্তর করা!
আর আল মুকাবালা কী জিনিস? তিনি বললেন—
যদি x+৩ = ৫+৩ হয় তবে দুই পাশ থেকে ৩ আর ৩ মু-কা-বা-লা।
থাকবে x = ৫। অর্থাৎ আমরা যে কাটাকাটি করি সেটাই ছিল তার মুকাবালা! মুকাবালা আবার দুই রকম— গুণের মুকাবালা আর যোগের মুকাবালা!! খেয়াল রাখবেন কিন্তু, এরপর আমি প্রায়ই বলব “দুই পাশ থেকে মুকাবালা করে”, তখন বুঝে নেবেন কাটাকাটি করেছি!
যদিও দেখতে এখন অনেক সহজ লাগছে, আসলে এই ব্যাপারগুলোর ওপরেই দাঁড়িয়ে আছে এখনকার বীজগণিত। তাই আল খোয়ারিজমিকেই বলা হয় বীজগণিতের জনক।
ভালো থাকুন মুসা আল খোয়ারিজমি। এবার স্মরণ করছি আমার গুরুকে, যাকে বলা হয় ইতিহাসের প্রথম প্রকৃত গণিতবিদ (First true mathematician)। তিনি হচ্ছেন ম-হা-ন পিথাগোরাস, যার উপপাদ্য আমরা প্রায়ই তোতাপাখির মতো মুখস্থ করে থাকি। তার জীবন নিয়ে একটু বলি। এই যে মহান পিথাগোরাস, তিনি কী ধরনের মানুষ ছিলেন? আসলে তিনি ছিলেন বড়ই অদ্ভুত কিসিমের মানুষ! পিথাগোরাস চিন্তা করতেন এই পৃথিবীর সবকিছুই আসলে সংখ্যা দিয়ে তৈরি।
তিনি বলতেন, এক হচ্ছে ঈশ্বরের সংখ্যা, দুই হচ্ছে প্রথম নারী সংখ্যা, তিন হচ্ছে প্রথম পুরুষ সংখ্যা এবং দুই আর তিন যোগ করলে পাঁচ হয়, পাঁচ হচ্ছে বিবাহ সংখ্যা! সবকিছুকেই তিনি কেমন যেন ‘সংখ্যা সংখ্যা’ করে চিন্তা করতেন। তো একবার তার এক ছাত্র এসে তাকে জিজ্ঞেস করল—
— ‘আচ্ছা গুরু, বন্ধুত্ব কী জিনিস?’ গুরু তো সবকিছু চিন্তা করেন সংখ্যা নিয়ে, সুতরাং তিনি বললেন— ‘আহ বন্ধুত্ব! ওরে পাগল, এটা আমি বুঝি। আসলে ২২০ আর ২৮৪-এর মধ্যে যে সম্পর্ক তাকেই বলে বন্ধুত্ব।’ শুনে তো ছাত্রের মাথা খারাপ!
— ‘গুরু এটা আবার কী বললেন? একটু ব্যাখ্যা করেন না’!
—‘দাঁড়া! বোঝাচ্ছি! এদিকে আয়— ২২০ এর যে উৎপাদকগুলো আছে সেগুলোর দিকে তাকা। উৎপাদক বুঝিস তো? যেসব সংখ্যা দিয়ে ২২০-কে নিঃশেষে ভাগ করা যায়, তারা হলো ২২০ এর উৎপাদক।
খেয়াল করে দ্যাখ— ২২০-এর উৎপাদক হচ্ছে ১, ২, ৪, ৫, ১০, ১১, ২০, ২২, ৪৪, ৫৫, ১১০, ২২০। আর ২৮৪ এর উৎপাদক কী কী?
২৮৪ এর উৎপাদক হচ্ছে ১, ২, ৪, ৭১, ১৪২, ২৮৪। তুই কি জানিস প্রকৃত উৎপাদক (proper divisor) কাকে বলে’?
– ‘না তো গুরু!’
-‘তাহলে শোন। প্রতিটা সংখ্যা দিয়ে তো ঐ সংখ্যাকেই ভাগ করা যায়, যার ভাগফল হয় ১। তার মানে প্রতিটা সংখ্যা নিজেই নিজের উৎপাদক। এই নিজেকে বাদ দিলে বাকি যে উৎপাদকগুলো থাকে সেইগুলো হচ্ছে ‘প্রকৃত উৎপাদক’। মানে হচ্ছে, ধর ২২০ এর ক্ষেত্রে ২২০-কে বাদ দিলে বাকি যেগুলো থাকবে সেগুলো হচ্ছে ২২০ এর প্রকৃত উৎপাদক। তাহলে বল তো ২৮৪ এর প্রকৃত উৎপাদক কোনগুলো?’‘কেন গুরু, এই যে ২৮৪ বাদ দিয়ে বাকিগুলো!
-‘বাহ। এখন এর মধ্যে বন্ধুত্ব কোত্থেকে এলো, তাই না? দ্যাখ। এই ২২০ এর সমস্ত প্রকৃত উৎপাদক তুই যদি যোগ করিস, তাহলে পাবি ২৮৪। আর ২৮৪ এর সমস্ত প্রকৃত উৎপাদক যদি তুই যোগ করিস তাহলে পাবি ২২০।
অর্থাৎ ১+২+৪+৫+১০+১১+২০+২২+৪৪+৫৫+১১০=২৮৪ এবং ১+২+৪+৭১+১৪২=২২০। এরা দু’জন দু’জনার জন্য, একজনের ভেতরে অন্যজনের বসবাস। আর এজন্যই এরা আসলে বন্ধু!’
এবং সত্যি এখন পর্যন্ত ২২০ এবং ২৮৪-কে বন্ধু সংখ্যা বা Amicable Numbers বলা হয়। বন্ধু দিবসে এখন বন্ধুকে মেসেজ পাঠানো যেতে পারে, ‘আমাদের বন্ধুত্ব ২২০ আর ২৮৪ এর মতো হোক!’ (পরবর্তীতে এরকম বন্ধুসংখ্যা আরো পাওয়া গেছে, যেমন: ১১৮৪ আর ১২১০; ২৬২০ আর ২৯২৪ ইত্যাদি)।
তো, গণিত নিয়ে বিভিন্ন সময়ে মানুষ বিভিন্নভাবে চিন্তা করেছে। কখনো সংখ্যা নিয়ে, কখনো সমীকরণ নিয়ে, কখনো উপপাদ্য, সম্পাদ্য, তত্ত্ব, সমস্যা এমন নানা কিছু নিয়ে। আমার সবসময় একটা ব্যাপার জানতে ইচ্ছে করত— গণিতের এই যে এতসব ধারণা, এগুলো মানুষের মাথায় এল কিভাবে? ধারণাগুলো কিভাবে বিকশিত হলো? যেমন: আমরা জানি ‘পিথাগোরাসের উপপাদ্য’ বলে একটা ব্যাপার আছে। এটা কার মাথায় প্রথম এসেছিল, কে আবিষ্কার করেছিল?
শুনে মনে হতে পারে— কেন? পিথাগোরাসের উপপাদ্য আবার কে আবিষ্কার করবে, পিথাগোরাসই আবিষ্কার করেছিল। আসলে ব্যাপারটা কিন্তু তা না। পিথাগোরাসের আবিষ্কারের বহু আগেই মানুষ এটা জানত। কিভাবে তিনি এটা আবিষ্কার করলেন, সেটা খুবই মজার একটা গল্প। কৌতূহলী পাঠক পড়তে থাকুন, পরের কোনো একটা অধ্যায়ে সেই গল্প বলা হবে!
আরেকটা ব্যাপার বলি। অনেক বিষয়ই আছে যেগুলো আমরা মনে করি আমরা জানি— আসলেই জানি কি না এটা কিন্তু আমরা জানি না! গণিত আমার কাছে কখনোই ধরাবাঁধা কিছু নিয়ম (set of rules) বলে মনে হয়নি। অনেকেই ভাবে, গণিত আর কী! কতগুলো নিয়ম আছে—
সেগুলো ধরে ধরে অংক কষলেই সমাধান হয়ে গেল! মূল ব্যাপারটা কিন্তু মোটেই এরকম না। গণিতের অনেক কিছু অন্তর থেকে অনুভব (feel) করা যায়। আমি নিজে অনুভব করতে চাই, আর চাই মানুষও অনুভব করুক! যেমন, আমরা জানি ১-কে ০ (শূন্য) দিয়ে ভাগ করলে সেটা অসংজ্ঞায়িত হয়। কিন্তু কেন? কেন আসলে এরকম হলো? ০-কে ০ দিয়ে ভাগ করলে আসলে কী হতে পারে? বিয়োগে বিয়োগে যোগ (মাইনাসে মাইনাসে প্লাস) হয়, এটা একদম ছোটবেলা থেকে জানি। আমরা কি অনুভব করি, এটা কেন হয়?
আমরা জানি 4/3πr³ হচ্ছে গোলকের আয়তন। কেন? গোলকের আয়তন কেন এরকম হলো? আমরা কি কোনো প্রাথমিক নিয়ম (elementary method) দিয়ে, সহজ কোনোভাবে একে ব্যাখ্যা করতে পারি? এরকম অসংখ্য প্রশ্ন সব সময়ই আমার মাথায় ঘুরপাক খেত। সেগুলো পরে আস্তে আস্তে জানার চেষ্টা করেছি। একটু আধটু যা জেনেছি, সেগুলোই আমি আপনাদের জানাতে চাই।
এই লেখাটি শেষ করব একটি গল্প দিয়ে। অবশ্যই আমাদের প্রত্যেকটা অধ্যায় অনেক গল্পে সাজানো থাকবে। কারণ গণিতের গল্পগুলো যদি না জানা যায়, তাহলে ভেতরের মজাটা আসলে পাওয়া যাবে না। একেকটা চিন্তা কিভাবে জন্ম নিল সেই গল্পগুলো অনেক সুন্দর হয়! আবার কিছু ঘটনা যেমন মজার, তেমনি কিছু ঘটনা আছে খুবই বিব্রতকর!
আমরা ক্যালকুলাসের কথা অনেকেই জানি। ক্যালকুলাস আবিষ্কারের কৃতিত্ব দেয়া হয় মূলত দু’জন মানুষকে— নিউটন এবং লিবনিজ। যখন প্রথম এই ক্যালকুলাসটা আবিষ্কৃত হলো তখন গণিতের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ঝগড়াগুলোর একটা লেগে গিয়েছিল। এবং সেই ঝগড়াটা ছিল এই খুব বিখ্যাত দু’জন মানুষের মধ্যে। স্যার আইজ্যাক নিউটন এবং লিবনিজ— এদের মাঝে ক্যালকুলাস কে আগে আবিষ্কার করেছে সেটা নিয়েই কলহ!
আর সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে, কয়েকদিন পরেই রয়েল সোসাইটিতে একটা তদন্ত কমিটি গঠন করা হলো: ঠিক আছে, কে আগে ক্যালকুলাস আবিষ্কার করেছে তা তদন্ত করে দেখা হোক। মজার বিষয় হচ্ছে পদাধিকার বলে সেই তদন্ত কমিটির প্রধান ছিলেন নিউটন নিজেই। এবং নিউটন অনেক অনুসন্ধান করে শেষ পর্যন্ত রায় দিলেন— হ্যাঁ, নিউটনই আগে ক্যালকুলাস আবিষ্কার করেছে! কী হাস্যকর একটা বিষয়, তাই না! এখন অবশ্য দুজনকেই যৌথভাবে ক্যালকুলাস আবিষ্কারের সম্মান দেয়া হয়।
যাহোক এমন অসংখ্য গল্প আমরা পরের অধ্যায়গুলোতে বলব এবং অনুভব করব গণিতের আরও দারুণ সব বিষয়।