এখানে এত গরম যে পারদ গলিয়ে ফেলতে পারে। এসিড বৃষ্টি আপনার হাড় থেকে মাংস খুবলে তুলে ফেলতে পারে, তারপরও এটা আপনার পরিবার সহ বসবাসের জন্য চমৎকার একটি জায়গা হতে পারে! এই জায়গা হল শুক্র গ্রহ। হ্যাঁ ঠিকই পড়েছেন, মঙ্গল নয়, শুক্র। এই শুক্র গ্রহই হতে পারে পৃথিবীর বাইরে মানুষের কলোনি গড়ে তোলার এক আদর্শ গন্তব্য। মহাকাশ বিজ্ঞানীরা অনেক দিন থেকেই মঙ্গল গ্রহে বসতি স্থাপনের জন্য বিপুল অর্থ ও সময় ব্যয় করছে। কিন্তু আমরা কি শুক্র গ্রহের তীব্র প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকতে পারবো? আজ আমরা সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করব।
এলন মাস্কের মতো উদ্যমী মানুষদের বাদ দিলে অন্য কারও আসলে মঙ্গল গ্রহে বসতি স্থাপনের আগ্রহ থাকার কথা না। এর পিছনে দায়ী মঙ্গলের চরম ভাবাপন্ন পরিবেশ। অত্যন্ত পাতলা বায়ুমণ্ডলের কারণে মঙ্গলে নিঃশ্বাস নেয়া একেবারেই অসম্ভব। তীব্র ঠান্ডা, মৃত্যু পর্যন্ত ডেকে আনতে পারে এমন কম বায়ুচাপ এবং বিপজ্জনক সৌর বিকিরণের হাত থেকে রক্ষার জন্য বলতে গেলে কোন প্রতিরক্ষা না থাকা এমন নানাবিধ কারণে মঙ্গলে জীবনধারণ এক কথায় অসম্ভব রকমের কঠিন ও ব্যয়বহুল।
অন্যদিকে শুক্র গ্রহেরও নানা রকম সমস্যা আছে। এর পৃষ্ঠের পরিবেশ ভয়ংকর রকমের বিপজ্জনক। আমাদের জানা পৃথিবীর সাথে তুলনা করলে সেখানেও জীবন ধারণ অসম্ভব। তবে বাহ্যিকভাবে শুক্রের সাথে পৃথিবী পৃষ্ঠের কিছু মিল আছে। শুক্রের মাধ্যাকর্ষণ পৃথিবীর মাধ্যকর্ষণের প্রায় ৯০%, আর আমরা সূর্য থেকে যতটা দূরে আছি, শুক্র গ্রহ সেই দূরত্ব থেকে মাত্র ৩০% কম দূরত্বে আছে সূর্য থেকে। তবুও সেখানে প্রধান ও ভয়ঙ্কর একটি পার্থক্য আছে। যেখানে মঙ্গলের বায়ুমণ্ডল অতিরিক্ত পাতলা সেখানে শুক্রের বায়ুমণ্ডল অতিমাত্রায় ঘন। পৃথিবী থেকে শুক্রের বায়ুমণ্ডল ৯০ গুন বেশি ঘন। এই ঘন বায়ুমণ্ডলের প্রধান উপাদান কার্বন-ডাই-অক্সাইড। আর এই ঘন বায়ুমণ্ডল আবৃত থাকে সালফিউরিক এসিডের মেঘ দ্বারা।
এই কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রীন হাউস ইফেক্টের মাধ্যমে সূর্যের বিপুল পরিমাণ তাপ তার পরিবেশে ধরে রাখে, ফলে শুক্র গ্রহের পৃষ্ঠ সবসময় থাকে অতিমাত্রায় গরম। সূর্যের নিজের পৃষ্ঠ বাদ দিলে শুক্রের পৃষ্ঠই এই সৌরজগতের সব থেকে উত্তপ্ত জায়গা। শুক্রের তাপমাত্রা সব সময়েই থাকে ৪৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে, এই তাপমাত্রায় জিংক, পারদ বা যেকোন জৈব উপাদানকে গলিয়ে ফেলতে পারে। সেই সাথে আছে ভারী ও ঘন বায়ুমণ্ডলের বিপুল চাপ। পৃথিবীতে পানির এক কিলোমিটার নীচে যে চাপ অনুভূত হবে শুক্রের পৃষ্ঠে সেই একই চাপ অনুভূত হবে আর এই বিশাল চাপ একটি নিউক্লিয়ার সাবমেরিনকেও চিড়ে চ্যাপ্টা বানিয়ে দিতে পারে।
তাহলে এই রকম ভয়ঙ্কর জায়গায় আমরা কিভাবে বসতি স্থাপন করব? উত্তর হল ভূপৃষ্ঠকে এড়িয়ে যাওয়া। এমনকি শুক্র গ্রহে বায়ুমণ্ডলীয় চাপ এতটাই বেশি যে এর বায়ুমণ্ডলের কার্বন-ডাই-অক্সাইড অধিক চাপে “সুপার ক্রিটিকাল ফ্লুইড” নামের পদার্থের এক অদ্ভুত অবস্থায় পরিণত হয়ে ভূপৃষ্ঠে গলে পরে। এই সুপার ক্রিটিকাল ফ্লুইড না গ্যাসীয় পদার্থ না তরল পদার্থ, এই দুটোর মাঝামাঝি একটি অবস্থান এবং তরল ও গ্যাসীয় দুই ধরণের বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। আমাদের পৃথিবীতে এই সুপার ক্রিটিকাল কার্বন-ডাই-অক্সাইড কে অত্যন্ত বিষাক্ত ও বিপজ্জনক হিসেবে দেখা হয়। এই পদার্থ ইন্ডাস্ট্রিয়াল সলভেন্ট ও স্টেরিলাইজার হিসেবে খুব সাবধানতার ব্যবহার করা হয়। আর শুক্র গ্রহের পৃষ্ঠ আক্ষরিক অর্থে এই বিষাক্ত পদার্থের সাগরে ডুবে আছে।
অধুনালুপ্ত সোভিয়েত ইউনিয়ন ৬০,৭০ আর ৮০’র দশকে শুক্র গ্রহে বেশ কিছু প্রোব পাঠিয়েছিল। তাদের অধিকাংশই শুক্রের ভয়ংকর বায়ুমণ্ডলে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল আর বাকিগুলো ভূপৃষ্ঠে ভেঙে পড়েছিল। এগুলোর মাঝে ব্যতিক্রম ছিল ‘ভেনেরা ১৩’। শুক্রের নারকীয় তাপ ও চাপে ভর্তা হয়ে যাবার আগে এটি ২ ঘন্টা টিকে ছিল ও বেশ কিছু ছবি তুলে পাঠিয়েছিল। ছবিগুলো ছিল শুষ্ক, পাথুরে ও এলিয়েন সদৃশ লাল রঙের।
তাহলে আমরা কি করে এই বন্ধুর গ্রহে বসবাসের কল্পনা করব? এর উত্তর হচ্ছে আমাদের ভূপৃষ্ঠকে এড়িয়ে যেতে হবে। প্রথম যারা শুক্রকে বসতি স্থাপনের উপযোগী ভেবেছিলেন তাদের মধ্যে একজন, নাসার বিজ্ঞানী ও বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী লেখক জিওফ্রে ল্যান্ডিস বলেন, “প্রাণ ধারণের উপযোগীতার হিসেবে শুক্রের পৃষ্ঠ, পৃথিবীর পৃষ্ঠের অনেক নীচে অবস্থান করছে। এই সৌরজগতে অন্যান্য গ্রহের থেকে শুক্র গ্রহের পৃথিবীর সাথে মিল সব থেকে বেশি”। তবে আশ্চর্যজনক ভাবে পৃষ্ঠ থেকে ৩০ থেকে ৫০ কিলোমিটার উপরে শুক্র গ্রহ অনেক বেশি অতিথিপরায়ণ।
প্রথমত ওই উচ্চতায় শুক্র গ্রহের বায়ুচাপ পৃথিবীর বায়ুচাপের কাছাকাছি। আর অনেক পুরু বায়ুমণ্ডল থাকার কারণে শুক্র গ্রহের ওই উচ্চতার উপরে সূর্যের ক্ষতিকর বিকিরণ থেকে রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিরক্ষা থাকবে। ওই উচ্চতায় তাপমাত্রাও থাকবে পৃষ্ঠের তুলনায় অনেক বেশি সহনশীল, মাত্র ৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াস! পৃষ্ঠে যেখানে ৪৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা, সেই তুলনায় ৬০ ডিগ্রিকে অবশ্যই সহনশীল বলতে হবে। আর শুক্র গ্রহ পর্যন্ত যেয়ে যদি আমরা বসতি স্থাপন করতে পারি তাহলে ৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে সহনশীল করে নেবার প্রযুক্তিও আমরা বের করতে পারব। আর বিকিরণের ঠেকানো ও চাপ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ করে আরও কয়েক কিলোমিটার উপরে গেলে সেখানে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা পাওয়া সম্ভব। যা মানুষের পক্ষে খুবই সহনশীল। আর শুক্রের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি বলতে গেলে পৃথিবীর সমান, তাই ওই উচ্চতায় দীর্ঘদিন কলোনি করে বসবাস করলেও মাধ্যাকর্ষণ এর কারণে ভঙ্গুর হাড় বা মাংসপেশি শিথিল হয়ে যাওয়া জনিত জটিলতায় পড়তে হবেনা।
তাহলে আমরা স্বপ্ন দেখতে পারি যে একদিন আমরা শুক্র গ্রহে মানুষের কলোনি স্থাপন করব। যদিও শুক্র নিয়ে মানুষের জ্ঞ্যান বলতে গেলে খুবই কম। মহাকাশ নিয়ে প্রতিযোগীতার শুরুর দিকে এই গ্রহে কিছু অভিযান চালানো হয়েছিল। তখন প্রযুক্তিও এতো উন্নত ছিলনা, আর শুক্র গ্রহের বিরূপ আবহাওয়া পরবর্তীতে এই গ্রহে অভিযান চালাতে বিজ্ঞানীদের নিরুৎসাহিত করে। তবে সূর্য থেকে দূরত্ব, প্রযুক্তির উন্নতি ও নানা কারণে আবার শুক্র গ্রহের উপরে বিজ্ঞানীদের আগ্রহ তৈরি হচ্ছে। হয়ত পৃথিবীর বাইরে এই গ্রহেই সবার আগে মানুষ তার কলোনি গড়ে তুলবে।
সংগৃহীত