মানুষ ছাড়া আর কোনো প্রাণী কি অঙ্ক করতে পারে? প্রশ্নটার উত্তর মেলেনি এখনো। তবে এখন পর্যন্ত অন্য কোনো প্রাণী অঙ্ক বোঝে বা কষতে পারে বলে তেমন কোনো প্রমাণ মেলেনি। তাই গাণিতিক দক্ষতার বিষয়ে জীবজগতে মানুষের একক কৃতিত্ব মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। তাহলে এখন প্রশ্ন হলো, মানুষ কীভাবে অঙ্ক করে?
এই প্রশ্নের উত্তরটা জটিল। কেননা দেখা গেছে, একেক ধরনের গণিতের জন্য মস্তিষ্কের একেক এলাকাকে সক্রিয় হতে হয়। কখনো একাধিক এলাকা একসঙ্গে মিলেমিশে কাজটা সম্পন্ন করে। যেমন পাটিগণিত বুঝতে হলে আমাদের আগে বুঝতে হবে ভাষা, কেননা এতে থাকে বাক্য। আবার জ্যামিতি একটা ছবির মতো। জ্যামিতি করার সময় মস্তিষ্কের অক্সিপিটাল লোবের ভিস্যুয়াল এলাকা (যা দিয়ে আমরা দেখি) থেকে শুরু করে ফ্রন্টাল লোবের সেনসরি মোটর কর্টেক্স (যা হাতের নিখুঁত ও সূক্ষ্ম কাজকে নিয়ন্ত্রণ করে) পর্যন্ত অনেক জায়গাকে একই সঙ্গে কাজ করতে হয়। আবার একটা জটিল অঙ্ক সমাধানে যে উচ্চস্তরের চিন্তা বা হাইয়ার থিংকিং দরকার, তার মূল কাজটা হয় ফ্রন্টাল লোবে। মানুষের মস্তিষ্ক কেন অঙ্কে পারদর্শী, তা নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে। নানা ধরনের ইমেজিং স্টাডি হয়েছে এ নিয়ে। শেষ পর্যন্ত বলা হচ্ছে, গাণিতিক দক্ষতা আসলে ঠিক কোনো এলাকা বা কোনো পদ্ধতির ওপর এককভাবে নির্ভরশীল নয়। তবে দৃশ্য, স্থান বা স্পেস সম্পর্কে জ্ঞান এবং বিশ্লেষণী ক্ষমতা—মানব মস্তিষ্কের এ তিনটি দক্ষতা এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ কাজগুলো করতে আমাদের মস্তিষ্কে আছে এক বিস্তৃত নিউরাল নেটওয়ার্ক। এই নেটওয়ার্ক কয়েক বিলিয়ন নিউরন এবং তাদের মধ্যকার সংযোগ সেতু (যার সংখ্যা ২৫০ মিলিয়ন বিলিয়ন!), নিউরোট্রান্সমিটার, নিউরোমডুলেটর ইত্যাদির সাহায্যে তৈরি। আমাদের নিউরনগুলো কাজ করে একটা কম্পিউটারের সিপিইউর মতো। এখানে তথ্য ও ডেটা প্রসেসিং হয়। আর এ তথ্যগুলো সঞ্চয়, বিশ্লেষণ, ব্যাখ্যা করা ও সঠিক পদ্ধতিতে বিতরণের কাজটি করে প্রায় এক ট্রিলিয়ন গ্লিয়া কোষ। গণিত সমাধানে এ সবকিছু কাজ করে একটা ইউনিটের মতো। গোটা সার্কিটটা সমাপ্ত হলেই কেবল সমাধান মেলে।
তবে গণিতের জগতে মানুষের একটাই প্রতিদ্বন্দ্বী আছে—তা হলো কম্পিউটার বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। কিন্তু কম্পিউটার কি মস্তিষ্কের চেয়ে অঙ্কে বেশি পারদর্শী? উত্তরটা হলো—না। কম্পিউটারের সঙ্গে মস্তিষ্কের পার্থক্য হলো যে কম্পিউটারের প্রসেসিং ও বিশ্লেষণে দুটো কাজের জন্য আলাদা দুটো অংশ লাগে, মস্তিষ্ক একাই মিলেমিশে তা করে ফেলে। একটা জটিল অঙ্ক বা ক্যালকুলেশন করতে যেখানে একটা কম্পিউটারকে কয়েক মিলিয়ন ধাপ পার হতে হয়, দরকার হয় বিশাল এনার্জির, সেখানে মানুষের মস্তিষ্ক ব্যবহার করে মাত্র কয়েক শ নিউরন ও সামান্য এনার্জি। মজার ব্যাপার হলো, কম্পিউটারকে আমরা আপাতদৃষ্টিতে মুহূর্তের মধ্যেই ক্যালকুলেশন করতে দেখি। কিন্তু মস্তিষ্কের প্রসেসিং গতি কম্পিউটারের তুলনায় বহুগুণ বেশি। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। এ মুহূর্তে বিশ্বের সবচেয়ে তড়িতগতিসম্পন্ন সুপার কম্পিউটার আছে চীনের গুয়াংজুতে। এর প্রসেসিং স্পিড ৫৪.৯ পিটাফ্লপস (এক পিটাফ্লপ মানে ১০১৫ বা সেকেন্ডে এক হাজার ট্রিলিয়ন পয়েন্ট ক্যালকুলেশন করার দক্ষতা)। সেখানে একটা মস্তিষ্কের প্রসেসিং স্পিড গুনতে হবে এক্সাফ্লপ দিয়ে—যার অর্থ ১০১৮ বা সেকেন্ডে বিলিয়ন বিলিয়ন ক্যালকুলেশন করার দক্ষতা। এর ধারেকাছে পৌঁছাতে কম্পিউটারের সময় লাগবে আরও অনেক। তাহলে দেখা যাচ্ছে, কেবল জীবজগতে নয়, বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডেও সত্যিকার অর্থে গণিতের মাথা আছে কেবল মানুষেরই।