'টেলিকাইনেসিস' মানুষের কল্পনাশক্তির একটি দুর্দান্ত নির্মাণ। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এটি বাস্তব কিছু নয়। কেন নয়- তা ব্যাখ্যা করছি। টেলিকাইনেসিস হলো চিন্তাশক্তি ব্যবহার করে কাছে-দূরের কোনো বস্তুকে কোনো ধরনের যান্ত্রিক শক্তি প্রয়োগ ব্যতীত নাড়ানো। যারা টেলিকাইনেসিস আছে বলে দাবি করেন, তারা ধরে নেন যে- মস্তিষ্কের এমন কোনো ক্ষমতা আছে যা এখনো শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি এবং তা ব্যবহার করে টেলিকাইনেসিস 'সম্ভব হলেও হতে পারে'। তারা মূলত মস্তিষ্ক কীভাবে কাজ করে এবং মস্তিষ্ক-সম্পর্কিত সাম্প্রতিক (গত পঞ্চাশ বছরের) গবেষণার ব্যাপারে ধারণা রাখেন না। নিউরোসায়েন্টিস্টরা মস্তিষ্কের সব অংশের কাজকর্মের ব্যাপারে এখন যথেষ্ঠ ভালো জ্ঞান রাখেন, চিকিৎসাক্ষেত্রেই জ্ঞানগুলো প্রয়োগ করা হচ্ছে এবং জীবন বাঁচানো ও রোগ নিয়াময় সম্ভব হচ্ছে। সুতরাং, মস্তিষ্কের এমন এক 'লুক্কায়িত শক্তি' আছে যা এমনকি দূর থেকে ভারী বস্তু নাড়ানোর ক্ষমতা রাখে কিন্তু বিজ্ঞানীরা এই ব্যাপারে কিছু জানে না- এটা খুবই হাস্যকর যুক্তি। মস্তিষ্কের নিউরনগুলো নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের জন্য তড়িৎ-রাসায়নিক বল ব্যবহার করে, আমাদের 'চিন্তা' হলো মূলত অনেকগুলো উদ্দীপিত নিউরনের জটিল তড়িৎ-রাসায়নিক যোগাযোগ। এখন, টেলিকাইনেসিস-এ যেমন দাবি করা হলো- চেয়ার তুলে ফেলা, চামচ বাঁকিয়ে ফেলা ইত্যাদি কাজের জন্য প্রয়োজন যান্ত্রিক শক্তি। যারা দাবি করেন যে, টেলিকাইনেসিস সত্য, তারা কখনো এটা ব্যাখ্যা করেন না যে- কীভাবে মস্তিষ্কের অভ্যন্তরস্থ তড়িৎ-রাসায়নিক বল বাইরে এসে যান্ত্রিক শক্তিকে পরিণত হয়ে গেল? শক্তির সেই রূপান্তরটি কোথায় ঘটল? আমরা জানি, যে শক্তির কোনো সৃষ্টি বা বিনাশ নেই, এক রূপ থেকে কেবল অন্য রূপ নিতে পারে। টেলিকাইনেসিস-এর ব্যাপারে যেমন দাবি করা হয়- দূরের বস্তুকে নাড়ানো- এটার জন্য নিশ্চয়ই শক্তির প্রয়োজন? সেই শক্তিটা কোথা থেকে সরবরাহ করা হচ্ছে? টেলিকাইনেসিস-এ বিশ্বাসীদের মতে- মস্তিষ্ক থেকে। ধরা যাক- একটি ৫০ কেজি ওজনের একজন মানুষকে টেলিকাইনেসিস শক্তি ব্যবহার করে মাটির উপরে ভাসাতে চাচ্ছি। তাহলে মানুষটির ওপর অন্তত ৪৯০ নিউটন বল প্রয়োগ করতে হবে। এই শক্তি কে সরবরাহ করবে? মস্তিষ্ক। তাহলে মস্তিষ্ককে ৪৯০ নিউটন বল জেনারেট করে, তারপর অলৌকিকভাবে সেটাকে কনভার্ট করে যান্ত্রিক শক্তিতে পরিণত করতে হবে। কিন্তু ব্যাপার হলো- এই শক্তিটা উৎপন্ন হলো কিনা তা পরীক্ষাগারে পরীক্ষণযোগ্য, এটা যন্ত্র দিয়ে মেপে দেখা সম্ভব। এবং এযাবত কোনো বাবা-গুরু-তান্ত্রিক ইত্যাদি কেউই ল্যাবরেটরিতে নিরপেক্ষ পরিবেশে এমনটা করে দেখাতে পারেনি। কোনো ঘটনা সত্য হবার জন্য আগে সেটা করে দেখাতে হয় অথবা ঘটনাটি ঘটতে হয়। টেলিকাইনেসিস আগে কেউ সত্যি সত্যি করে দেখাক। এরপর নাহয় এর সম্ভাব্যতা বা অসম্ভাব্যতা বিচার করব। তার আগপর্যন্ত- টেলিকাইনেসিস বিষয়ক যাবতীয় ব্যাখ্যা সত্যিকারের বিজ্ঞানের আওতায় পড়ে না। ( আর হ্যাঁ, অনেকেই না বুঝে বলে বসেন- 'বিজ্ঞানের অনেক কিছুই সম্ভব', 'ভবিষ্যতে সত্যি প্রমাণিত হবে', 'বিজ্ঞানীরা তো আগেও ভুল করেছে' ইত্যাদি ইত্যাদি। তাদেরকে বলি- বিজ্ঞানীদের ভুল শোধরানোর কাজটা হয় তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে। কল্পনার হাওয়ায় হাওয়ায় ভেসে ভেসে আর যা-ই হোক, বিজ্ঞান চলে না। কার্ল সেগান বলেছিলেন- “Extraordinary claims require extraordinary evidence” )