রক্তবমি : কারণ ও প্রতিকার:
বমির সঙ্গে রক্ত এলে তাকে বলা হয় রক্তবমি বা হেমাটোমেসিস। এটা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পরিপাকতন্ত্রের সমস্যার কারণে হয়। বমির সঙ্গে তাজা লাল রক্ত বা কফি রঙের মতো রক্ত অথবা ভেতরে প্রচুর রক্তপাত হলে ছোট ছোট জমাট রক্তদলা বমির সঙ্গে আসতে পারে।
রক্তবমির কারণ :
* পেপটিক আলসার বা পেটে আলসার হলে।
* অন্ত্রনালির নিচের দিকের রক্তবাহী নালি ফেটে গিয়ে (সাধারণত দীর্ঘ যকৃতের রোগে হয়)।
* অন্ত্রনালি, পাকস্থলী বা অন্ত্রের ঝিলি্ল ক্ষয়ে গেলে।
* এসপিরিন বা এ-জাতীয় ওষুধ বিশেষ করে খালি পেটে খেলে।
* পাকস্থলীতে ক্যান্সার হলে।
* রক্তের রোগ, রক্তের ক্যান্সার হিমোফিলিয়া।
* অন্যান্য মহাধমনির স্ফীতি হয়ে যাওয়া রোগ ইত্যাদি।
উপসর্গ :
রোগীর প্রথমেই রক্তবমি শুরু না-ও হতে পারে। অনেকক্ষণ ধরে পেটে ব্যথার পর ওয়াক করে বমি করতে করতে রক্তবমি শুরু হতে পারে। এ পর্যায়ে রক্ত কম পরিমাণে বের হলে তেমন কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায় না। তবে বেশি রক্তবমি হলে দুর্বলতা, বিরামহীনতা, অস্বস্তিবোধ, শরীর ঠা-া হয়ে ঘেমে যাওয়া, ধীরে ধীরে নেতিয়ে পড়া, ভুলভাল বলতে শুরু করা বা অজ্ঞান পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে। এ সময় চিকিৎসক পরীক্ষা করলে রক্তশূন্যতা, নাড়ি স্পন্দনের হার বেশি, রক্তচাপ কমে যাওয়া এগুলো পাওয়া যেতে পারে। এ লক্ষণগুলো রক্তবমি হওয়ার। তবে রক্তবমি হওয়ার পেছনে কোনো কারণ বা রোগ থাকলে সে ক্ষেত্রে তার লক্ষণও থাকবে। যেমন লিভার সিরোসিসের জন্য হলে সে ক্ষেত্রে জন্ডিস, আয়তনে বড় যকৃত, পেটে পানি জমা ইত্যাদি থাকতে পারে। আবার রোগী বা তার আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের মাধ্যমেও এর কারণ পাওয়া যেতে পারে। যেমন_ বলতে পারে শরীরের কোনো ব্যথার জন্য খালি পেটে লাল বড়ি খেয়েছে, তার পর থেকে এ অবস্থা বা পেটে আলসার ছিল কিন্তু নিয়ম মেনে খাওয়া-দাওয়া না করা বা রোগীর পেটে ক্যান্সার রোগ নির্ণয় করা আছে, যা রোগী জানে না; এসব কিছুর মাধ্যমে এই রক্তবমি হওয়ার একটি আপাতত কারণও বোঝা যায়।
রোগ নির্ণয় :
১. রক্তবমির ক্ষেত্রে রোগী বা রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে বিশদ তথ্য সংগ্রহ করা জরুরি। কারণ এটা নিজে কোনো রোগ নয়। এটা কোনো রোগের ফল। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এর কারণ থাকে কোনো দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা। যেমন_ লিভার সিরোসিস, পেটের আলসার, শরীরে স্থায়ী কোনো ব্যথাজনিত রোগের জন্য দীর্ঘদিন ধরে ব্যথার ওষুধ খাওয়া, পেটে ক্যান্সার থাকা ইত্যাদি। তাই এ ক্ষেত্রে রোগী বা স্বজনদের কাছ থেকে নির্দিষ্ট কিছু তথ্য খুবই সহায়ক রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে।
২. রোগীর শারীরিক লক্ষণ। যেমন_ পেটের আলসারের ক্ষেত্রে ওপরের পেটে চাপ দিলে ব্যথা পাওয়া, আস্তে আস্তে ওজন কমে যাওয়া, কালো পায়খানা হওয়া, আবার লিভারের অসুখের ক্ষেত্রে হলুদ প্রস্রাব হওয়া, চোখ ও শরীর হলুদ হয়ে যাওয়া। আয়তনে বড় আকারের লিভার আবার পেটে ক্যান্সারের ক্ষেত্রে দ্রুত ওজন কমতে থাকা, মাঝেমধ্যে কালো পায়খানা হওয়া, রক্তশূন্যতা, পেটে কোনো চাকা অনুভূত হওয়া ইত্যাদি শারীরিক পরীক্ষার মাধ্যমে রক্তবমির কারণ অনুসন্ধান করা।
৩. ল্যাবরেটরি পরীক্ষা_ এ ক্ষেত্রে রক্তবমির কারণ অনুসন্ধানের জন্য করা হয়। তবে রোগী শকে চলে গেলে বা বিশেষ প্রয়োজনে তাৎক্ষণিকভাবে রক্তের গ্রুপ, হিমোগ্লোবিনের মাত্রা, ইউরিয়া ও ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা পরিমাপ করা হয়। তবে কারণ খোঁজার পরীক্ষাগুলো হলো_
* অ্যান্ডোসকপি
* বেরিয়ামমিল এক্স-রে
* পেটের আলট্রাসনোগ্রাম
* লিভার ফাংশন টেস্ট
* রক্তের বিভিন্ন কণিকার পরিমাণ
* বিস্নডিং টাইম, ক্লটিং টাইম
* রেডিও নিউক্লিভ স্ক্যান ইত্যাদি।
হঠাৎ করে রক্তবমি শুরু হলে কী করতে হবে :
* ঠা-া তরল খাবার পরিমাণমতো যেমন ঠা-া দুধ পান করাতে হবে।
* রোগীকে কোনো গরম বা দানাদার খাবার যেমন ভাত-রুটি খাওয়ানো যাবে না।
* রোগীর গলা, বুক জ্বলে যাচ্ছে এ রকম অনুভূত হলে কয়েক চামচ অ্যান্টাসিড সাসপেনশন খাওয়ানো যেতে পারে। তবে অনেক ক্ষেত্রে সাসপেনশন খাওয়ালে আবার বমি শুরু হয়।
* রোগীকে শোয়ানোর সময় পা একটু ওপরে রাখলে ভালো হয়। তবে এগুলো তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা। এটা কোনো সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নয়। তাই অবশ্যই রোগীকে নিকটস্থ চিকিৎসা সেবা কেন্দ্রে বা চিকিৎসকের কাছে নিতে হবে।
চিকিৎসা :
রোগীর শারীরিক অবস্থার ওপর চিকিৎসা পদ্ধতি নির্ভর করে। খুব বেশি রক্তবমি হলে রক্তও দেয়া লাগতে পারে। তা ছাড়া তাৎক্ষণিকভাবে লক্ষণগত চিকিৎসা চললেও রোগ নির্ণয় হলে সেই নির্দিষ্ট রোগীর চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসা মেডিকেলেও হতে পারে, আবার বিশেষ পর্যায়ে সার্জিক্যাল ব্যবস্থারও দরকার হতে পারে।
কোন রোগী বেশি ঝুঁকিপূর্ণ : যাদের বয়স ৬০ বছর বা তার বেশি।
* যাদের আগে থেকেই ক্যান্সার নির্ণয় করা আছে।
* লিভার বা কিডনি ফেইলিওর আছে।
* যেসব রোগী শকে আছে।
* যেসব রোগীর আগেও এমন রক্তবমি হয়েছে। * যাদের হৃৎপি-ের অসুখ বা ডায়াবেটিস আছে।
রক্তবমি কীভাবে প্রতিরোধ করা যায় : রক্তবমি প্রতিরোধ করতে হলে এর কারণগুলোকে প্রতিরোধ করাই উত্তম যেমন_
১. পেটে আলসার যাতে না হয়, সে জন্য আগেভাগেই খাবারের প্রকার ও সময়ের শৃঙ্খলা রক্ষা করা, অ্যালকোহল বা ধূমপানে বিরত থাকা, এসপিরিন বা এ-জাতীয় ওষুধ নিয়মিত সেবন করা ইত্যাদি।
২. হেপাটাইটিস বা অন্যান্য লিভারের রোগ, যা দীর্ঘস্থায়ী রোগ সৃষ্টি করতে পারে সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে। যেমন_ ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা, রক্তদ্রব্যাদি ব্যবহারে সতর্ক থাকা, অ্যালকোহল পানে বিরত থাকা ইত্যাদি। তবে কোনো কারণে হেপাটাইটিস হয়ে গেলে তার যথাযথ চিকিৎসা যত্নসহকারে গ্রহণ করা।
৩. রিউমাটয়েড আথ্রাইটিসসহ বিভিন্ন দীর্ঘস্থায়ী ব্যথাজনিত রোগ বা সাময়িক ব্যথাজনিত রোগের ক্ষেত্রে কোনো ব্যথার ওষুধ বা ইসকেমিক হার্ট ডিজিজের ক্ষেত্রে এসপিরিন-জাতীয় ওষুধ অবশ্যই ভরা পেটে খাওয়া বা খুব বেশি এসিডিটি হলে রেনিটিডিন বা এ-জাতীয় ওষুধ সেবন করা।
৪. পাকস্থলীতে অন্যান্য ক্যান্সারের ক্ষেত্রে বংশগত প্রভাব থাকলে কিছু ঝুঁকিপূর্ণ ফ্যাক্টরও থাকে। সেসব ক্ষেত্রে সেই ঝুঁকিকে এড়িয়ে চলা। যেমন_ পেটে আলসার থাকলে তা নিয়মকানুন মেনে চলার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে রাখা, ধূমপান ও অ্যালকোহল সেবনে বিরত থাকা, অতিরিক্ত হাইড্রোকার্বন-জতীয় খাবার (অর্ধসিদ্ধ মাংস) থেকে বিরত থাকা ইত্যাদি।
রক্তবমির ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা গ্রহণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এর আধিক্যের ফলে রোগীকে অনেক সময় জীবনসংশয় পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়।