একটি সফল গোলের পেছনে থাকে খেলোয়াড়ের নৈপুণ্য, এর জন্য তাকে করতে হয় প্রচুর অনুশীলন। খেলোয়াড় যখন দূর থেকে ফুটবলে কিক করে কারো কাছে পাস করে বা গোলপোস্টের দিকে ছুড়ে মারে তখন সে জেনে কিংবা না জেনে পদার্থবিজ্ঞানের চর্চা করে।
কথা হলো কীভাবে কিক করলে বলকে বেশি দূর নিয়ে ফেলা যাবে, কোন কৌশলে কম শক্তি খরচ করে বলকে বেশি দূরে নিয়ে ফেলা যাবে? কেউ বলতে পারে বেশি জোরে লাথি দিতে হবে, জোর হবে যত বেশি বল তত দূরে যাবে। কিন্তু তা নয়। গতি বা উড়ার ক্ষেত্রে পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম কাজ করে, সেখানে শুধু গায়ের জোর কাজে লাগে না, লাগে কৌশল।
যদি কেউ সোজা সামনের দিক বরাবর ফুটবলে কিক দেয় তাহলে সেটা কিছুক্ষণ পরই অভিকর্ষ বলের প্রভাবে নিচে নেমে আসবে, শূন্যে বেশিক্ষণ থাকবে না। শূন্যে বেশিক্ষণ না থাকলে দূরত্বও অতিক্রম হবে কম। ফলে কাঙ্খিত লক্ষ্য মিস হয়ে যেতে পারে অথবা গড়াতে গড়াতে প্রতিপক্ষের কাছে চলে যাবে।
কেউ আবার মনে করতে পারে বলটা বেশি সময় শূন্যে থাকলেই বেশি দূরে যাবে। সেটা ভাবলেও ভুল হবে। যদি উপরের দিকে বল ছুড়ে মারা হয় তাহলে সেটি বেশি সময় শূন্যে ভেসে থাকবে ঠিকই, কিন্তু বেশি দূর না গিয়ে কাছাকাছি কোনো জায়গায় পড়ে যাবে।
পদার্থ বিজ্ঞান বলে, সোজা সমান্তরালে থাকে শূন্য ডিগ্রি আর খাড়া উপরের দিকে ৯০ ডিগ্রি। এ শূন্য ও ৯০ ডিগ্রির মাঝামাঝি অবস্থানে থাকে ৪৫ ডিগ্রি। যে খেলোয়াড় যত কৌশলে ৪৫ ডিগ্রির কাছাকাছি কোণে বলে কিক দিতে পারবে সে খেলোয়াড় তত দূরত্ব অতিক্রম করাতে পারবে। এর বেশি হলে অভিকর্ষের টান থাকবে বেশি, আর কম হলে উচ্চতার টান থাকবে বেশি।
কিন্তু কথা হলো খেলোয়াড়রা তো আর কাঁটা-কম্পাস, স্কেল বা চাঁদা নিয়ে মাঠে নামেন না। খেলতে নেমে তো মেপে মেপে বলে কিক দেওয়া যাবে না। সেক্ষেত্রে চর্চা আর অভিজ্ঞতাই হলো খেলোয়াড়ের শক্তি। বলা হয়ে থাকে ৩০ ডিগ্রি আর ৬০ ডিগ্রির ভেতরে কিক সীমাবদ্ধ রাখলেই চলে, আর সবসময় তো বেশি দূরে বল ফেলতে হয় না।
আমরা অনেক সময় দেখি, বলটা বাতাসে উঠে বাইরে যেতে যেতে হঠাৎ বাঁক খেয়ে গোলপোস্টে ঢুকে গেছে। এ গোলের পেছনে আছে ‘নিউটন তত্ত্ব’, বিজ্ঞানী স্যার আইজ্যাক নিউটনের এ সূত্র দিয়ে এর ব্যাখ্যা দেওয়া যেতে পারে। নিজেদের অজান্তেই হয়তো মেসি, নেইমার কিংবা রোনালদো গোল করার ক্ষেত্রে এ সূত্রের প্রয়োগ ঘটাচ্ছেন।
এ বিশ্বকাপে অনেক অসামান্য গোলগুলো পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। কীভাবে? জানতে হলে আমাদের ‘ম্যাগনাস ইফেক্ট’ বুঝতে হবে। এটা অ্যারোডাইমিক্সের মতো জটিল কোনো তত্ত্ব নয়। এর আবিষ্কারক জার্মান পদার্থ বিজ্ঞানী হেইনরিখ গুস্তাভ ম্যাগনাস।
মূলত ম্যাগনাস ইফেক্ট হয়ে থাকে বাতাসের চাপের তারতম্যের কারনে বলের উপর যে প্রভাব পড়ে তার জন্য। এটা হলো স্পিন আর বাতাসের খেলা। এ ব্যাপারটাই এখন ব্যাখ্যা করা যাক।
ফুটবলে শট মারার পর থেকে প্রতি মুহূর্তে সেটা তীব্র বেগে ঘুরতে থাকে। এভাবে স্পিন করে বল এগিয়ে যায়, সেই গমনপথের উল্টোদিক থেকে আসে বাতাস, বাতাসের ধাক্কায় পাল্টে যেতে থাকে বলের গতিপথ। বিশ্বকাপে খেলার জন্য যে মানের ফুটবল ব্যবহার করা হয় সেগুলো গতি বদল করে বেশি। ফলে ক্রমেই তা বদলে দিতে থাকে বলের শেষ গন্তব্য।
এর সঙ্গে যোগ হয় ‘অপ্টিক্যাল বা ভিজ্যুয়াল ইলিউশন’, বাংলায় একে বলা যেতে পারে ‘দৃষ্টি ভ্রান্তি’। এ ইলিউশনের কারণে গোলকিপার বলের গতিরেখা বুঝতে পারেন না, বরং আসল গতিপথ থেকে ভিন্ন পথে বলটিকে আসতে দেখেন। ফলে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন প্রতিপক্ষের গোলরক্ষক। ভালো খেলোয়াড়দের দুর্দান্ত গোলের এটাই রহস্য।
‘পজিটিভ ম্যাগনাস ইফেক্টে’ ডান পায়ের ইনস্টেপে (পায়ের পাতার নিচের দিক) মারা শট যায় ডান দিক থেকে বাঁ দিকে, আর বাঁ পায়ের ইনস্টেপে তা যায় বাঁ দিক থেকে ডান দিকে। একইভাবে আউটস্টেপের (পায়ের পাতার বাইরের দিক) শটের ক্ষেত্রে তা রিভার্স বা উল্টো হয়ে যায়। শটের গতি বাড়তে থাকলে এবং বলের স্পিন বা ঘূর্ণন বদলে যেতে থাকলে গন্তব্যও অবিশ্বাস্যভাবে বদলে যায়।
আর এভাবেই ‘ম্যাগনাস ইফেক্টের’ অ্যারোডাইনামিক্স মেনে বদলে যায় ফুটবলের গতিপথ। বল যত মসৃণ হয়, তত স্বাভাবিক গতিপথের উল্টো দিকে যায় বল। এ ঘটনার অনেক উদাহরণ আছে। তবে সবচেয়ে বড় ঘটনাটা দেখা গিয়েছিল ১৯৯৭ সালে ফ্রান্সের বিপক্ষে ব্রাজিলের রবার্তো কার্লোসের সেই বিখ্যাত ফ্রি কিকে। ফরাসি গোলকিপার ফাবিয়ান বার্থেজকে হতভম্ব হয়ে কেবল দাঁড়িয়েই ছিলেন, কারণ কার্লোসের শট নেওয়া বলটি গোলপোস্টের বাইরে যেতে যেতে হঠাৎ পথ বদল করে গোলে ঢুকে গিয়েছিল!
এটা শেখার পর কিন্তু অংক করে মাঠে গোল দেওয়া যায় না। কারণ ওভাবে কিক নেওয়ার জন্য রীতিমতো অনুশীলন এবং প্রচুর অধ্যবসায় করতে হয়। গোলপোস্ট থেকে দূরত্ব বুঝে শটে গতি ও স্পিনের সংখ্যা বাড়িয়ে-কমিয়ে একটা নিয়ন্ত্রণে শট নিতে হয়, এটাই ‘ম্যাগনাস ইফেক্টের’ রহস্য।
তথ্যসূত্র:
এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা
রিয়েল ওয়ার্ল্ড ফিজিক্স প্রবলেম ডটকম
কোউরা ডটকম
https://fb.watch/3OqAWGfPWf/