১২. উচ্চ পুষ্টিসম্পন্ন খাদ্য এবং কম ফাইবার যুক্ত খাবার : মুরগির ক্ষেত্রে অতি উচ্চশক্তির খাদ্য খাওয়ালেও এ সমস্যা সৃষ্টি হয়। আর খাবারে ফাইবার কম থাকাটাও একটা অন্যতম কারণ। যার ফলে ক্যানাবলিজমের স্বভাব বৃদ্ধি পায়।
ক্যানাবলিজমের প্রতিকার : কথায় আছে প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম। ক্যানাবলিজমের ক্ষেত্রেও একই কথা। একবার ক্যানাবলিজম হলে খুব সহজেই তা দূর করা কষ্টকর। তবে কিছু বিষয়ের ওপর সজাগ দৃষ্টি দিলে তা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। যায় এর প্রভাবে ক্ষতির পরিমাণ কমানো। যে বিষয়ের ওপর বিশেষ যতœ নিতে হবে তা হলো-
১. সুষম খাদ্য সরবরাহ করতে হবে : মুরগিকে তার প্রয়োজনমতো সব পুষ্টি উপাদানের উপস্থিতি ঠিক রেখে সুন্দরভাবে খাদ্য প্রস্তুত করতে হবে। কোনো ঘাটতি যেন না থাকে সে ক্ষত্রে লক্ষ রাখতে হবে। ভিটামিন ও মিনারেলের ওপর সুনজর রাখতে হবে। আর মুরগি সাধারণত যে অর্গানিক উপাদানগুলো গ্রহণ করে থাকে তাই উৎপন্ন মাংস ও ডিমে সরবরাহ করে। তাই তার নিজের খাদ্যে যদি এগুলো উপাদানের ঘাটতি থাকে তাহলে সে দিনে দিনে ঘাটতিতে পড়ে যাবে। আর সব উপাদান ভালো মাত্রায় রাখলে এ ক্যানাবলিজমের পরিমাণ অনেকাংশেই হ্রাস পাবে।
২. পর্যাপ্ত পানির ও খাদ্যের পাত্রের সরবরাহ বাড়াতে হবে : মুরগির সংখ্যা অনুযায়ী পাত্রের সংখ্যা নির্ধারণ করে তাতে পরিষ্কার ও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করতে হবে। খাবারের জায়গা সবসময় পরিষ্কার রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। খাবার পরিমাণ মুরগির বয়স অনুযায়ী নির্ধারণ করে মুরগির সংখ্যার সঙ্গে তালমিলিয়ে প্রয়োগ করতে হবে।
৩. সময়মতো ডিবেকিং (ঠোঁট ছোট) করা : বর্তমানে সহজ উপায়ে মুরগির ক্যানাবলিজম দূর করার জন্য ডিবেকিংকেই একমাত্র প্রধান হাতিয়ার হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষত লেয়ার মুরগির ক্ষেত্রে ঠোটের এক-তৃতীয়াংশ কেটে দিতে হবে। আর এ সময় মুরগির রক্তক্ষরণ কমানোর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যেমন- দক্ষ লোক দ্বারা এ কাজ সম্পন্ন করা,
* আইরন ব্রান্ড কে পর্যাপ্ত তাপমাত্রায় উত্তপ্ত করা,
সতর্কতার সঙ্গে মুরগিকে ধরা এবং মেশিনে স্থাপন করা,
* পরিমাণ মতো ঠোঁট কাটা বেশি না কাটা,
* ঠোঁট কাটার পর মুরগির স্ট্রেস (ধকল) কমানো জন্য ভিটামিন সি অথবা লেবু পানি খাওয়ানো।
৪. পর্যাপ্ত জায়গার ব্যবস্থা করা : সব মুরগিকে তার নিজের সব কাজ সঠিকভাবে করার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা দিতে হবে।
৫. মুরগির ভিড় কমানো : বেশি মুরগি একসঙ্গে গাদাগাদি করে যেন না থাকে সে দিকে বিশেষ লক্ষ রাখতে হবে।
৬. পর্যাপ্ত আলো বাতাসের ব্যবস্থা করতে হবে।
৭. শেডের আলো সব জায়গায় যেন সমভাবে ব্যাপ্ত হয় সেদিকেও দৃষ্টি রাখতে হবে। লাইট ব্যবহারের ক্ষেত্রে ৪০ ওয়াটের ওপর বাল্প ব্যবহার করা উচিত নয়।
৮. পোলট্রি খাবারে যথেষ্ট পরিমাণে মিথিওনিন সরবরাহ করতে হবে। মিথিওনিন ক্যানাবলিজম প্রতিরোধ করতে বেশ সহায়তা করে
ডিম খাওয়া
ডিম পাড়া মুরগির আরও একটি মারাত্মক বদঅভ্যাস হলো নিজের ডিম নিজে খাওয়া। এটা প্রায়ই লেয়ার খামারে দেখা যায়। এর ফলে খামারি তার লাভের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারে না।
যেসব কারণ আছে ডিম খাওয়ার পেছনে-
দীর্ঘক্ষণ ডিম খাঁচায় রাখা।
যদি কোনো কারণে একবার ডিম ভেঙে যায় এবং সেই ডিম যদি মুরগি খেয়ে স্বাদ পায় তাহলে পরে সে নিজের ভালো ডিম খেতে অভ্যস্ত হয়ে যায়।
ডিমের খোলস যদি খুব পাতলা হয়। রক্ত বা ভেজা ভেজা অবস্থার উপস্থিতি লক্ষ করা যায়।
মুরগির খাবারে যদি প্রোটিনের অভাব হয়।
সমাধান
১. মুরগিকে পরিমিত সব উপাদান দেয়া প্রয়োজন,
২. যত দ্রুত সম্ভব মুরগির ডিম অন্য জায়গায় সরিয়ে নিতে হবে,
৩. মুরগির ঠোঁট কেটে দিতে হবে।
৪. মুরগির খাবারে অতিরিক্ত ক্যালসিয়ামের সরবরাহ বাড়াতে হবে। ক্যালসিয়াম ডিমের সেল গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখে।
৫. মুরগির ডিম পাড়ার জায়গা তুলনামূলক ঢালু করে রাখতে হবে। এতে ডিম পাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা নিচে চলে আসে।
৬. ডিম পাড়া স্থানে তুলনামূলক অন্ধকার হলেও এ অভ্যাসের প্রকোপ কমে।
৭. ডিম সংগ্রহের বিরতি কমাতে হবে।
ডিম লুকানো
যদিও ডিম লুকানো অভ্যাস মূলত বন্য মুরগির ক্ষেত্রে বেশি প্রযোজ্য। তারপরও জেনেটিক্যালি (বংশগত ভাবে) কিছু মুরগির মধ্যে এ অভ্যাস চলে আসতে পারে। আর এ অভ্যাসে আক্রান্ত মুরগি তাদের ডিম কে মানুষের চোখের অন্তরালে লুকিয়ে রাখে।
সমাধান
মুরগির মুক্ত চলাচলে বাধা প্রদান।
ডিম পাড়ার স্থানটা খামারের ভেতরেই রাখতে হবে সঙ্গে বালু বা খড় দিয়ে তা আরামদায়ক করার ব্যবস্থা নিতে হবে।
মুরগির মধ্যে যাদের এ স্বভাব দেখা দেবে তাদের আলাদা করে খাঁচায় পালনের ব্যবস্থা করতে হবে।
পালক খাওয়া
কোনো কোনো মুরগি অস্বাস্থকর পরিবেশে পালক খাওয়া শুরু করে। যদিও এ সমস্যা খুব একটা মারাত্মক নয়। তারপরও এ অভ্যাস হতে আস্তে আস্তে ক্যানাবলিজমের দিকে ধাবিত হয়। আর একবার এ অভ্যাস হয়ে গেলে তা দূর করা খুব দুরূহ হয়ে পড়ে।
এ অভ্যাস কমানোর অন্যতম উপায় হলো মুরগির পরিবেশ ও বাসস্থান পরিষ্কার-পরিছন্ন রাখা। খাবার দেয়ার সময় দানাদার ও গুঁড়া খাবার একসঙ্গে দেয়া উচিত।
কুচে হওয়া
ডিম পাড়া মুরগির খুবই পরিচিত সমস্যা এ কুচে লাগা। একটা নির্দিষ্ট সময় ডিম দেয়ার পর সেই মুরগি ডিম দেয়া বন্ধ করে দেয়।
ব্রুডি হেন (কুচে মুরগি) ডিম দেয় না কিন্তু সে তার জায়গা ধরে রাখে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। ফলে অন্য মুরগির ডিম পাড়ার জায়গা দখল করে থাকে। কুচে মুরগি খুব আক্রমণাত্মক রূপ ধারণ করে এবং তাকে তার জায়গা হতে সরানো কষ্টকর।
কুচে হওয়া মুরগির সমাধান
তাকে আলাদ করে রাখতে হবে।
ডিম পাড়া মুরগির সামনে বেশি ডিম একসঙ্গে না রাখা। তার ফলে কুচে হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে।
কুচে লেগে বসে থাকা মুরগিকে বসে থাকতে না দিয়ে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ানো। এটাও খুব সাধারণ ফলপ্রসূ নিয়ম।
উপযুক্ত খাবার সরবরাহ করা।
পিকা
মুরগি অনেক সময় যা খাওয়ার উপযুক্ত নয় তাও খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। মুরগির এ স্বভাবকে পিকা বলা হয়। যেমন লিটার, পালক ইত্যাদি খেয়ে থাকে। এ অভ্যাস আধুনিক মুরগির খামারে তেমন নেই বললেই চলে। অনেক সময় ফসফরাসের ঘাটতি হলে, পরজীবীর আক্রমণ হলে এ অভ্যাস লক্ষ করা যায়।
সমাধান : ভালো খামার ব্যবস্থাপনা এবং ফসফরাসের পরিমাণ ঠিক রেখে খাবার প্রদান করলে এ সমস্যার সমাধান খুব দ্রুত হয়।
গাছে উঠা : কিছু কিছু মুরগি তাদের জন্য বরাদ্দকৃত জায়গা বাদ দিয়ে রাতের বেলায় গাছে উঠে থাকে। এটা গ্রামের মুরগির ক্ষেত্রে বেশি দেখা যায়। এ সমস্যায় আক্রান্ত মুরগি অনেক সময় বনবিড়াল ও শিয়ালের আক্রমণের শিকার হয়। ভয় পেয়ে অনেক মুরগি তাদের ডিম উৎপাদন কমিয়ে দেয়। এসব মুরগির ডানা অল্প পরিমাণে কেটে দিতে হবে যেন উড়ে গাছে উঠতে না পারে। আর সজাগ দৃষ্টি রেখে তা প্রতিহত করা যায়।
খামার করে লাভবান হতে হলে ওপরের বিষয়গুলো বিবেচনা করে তার যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। এ বদঅভ্যাসগুলো খামারে দেখা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে তা কমাতে হবে। তাহলেই নিজের প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখা সম্ভব হবে।
মো. মোস্তাফিজুর রহমান*
* শিক্ষার্থী, ভেটেরিনারি অ্যান্ড এনিমেল সায়েন্স অনুষদ, ৪র্থ বর্ষ, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর