পৃথিবী নিজ অক্ষের চারদিকে ২৪ ঘন্টায় একবার ঘুরছে। এর ফলে বিষুবীয় অঞ্চলে যারা অবস্থান করছে তারা ঘন্টায় ১৬০০ কিলোমিটার হারে পৃথিবীর সাথে ঘুরছে। তাছাড়া, পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘন্টায় ১ লাখ ১০ হাজার কিলোমিটার বেগে ঘুরছে। আবার সূর্য তার গ্রহগুলো নিয়ে গ্যালাক্সিতে ঘন্টায় ৮ লাখ ২৮ হাজার কিলোমিটার বেগে ঘুরছে। এত বিপুল গতিতে ধাবমান থাকার পরেও আমরা এই গতি অনুভব করতে পারি না। অথচ বাসে কিংবা ট্রেনে কিংবা অন্যান্য বাহনে এর তুলনায় তুচ্ছাতিতুচ্ছ গতিতে ভ্রমণ করেও আমরা বুঝতে পারি। আমাদের শরীরের উপর দিয়ে প্রচন্ড ধকল বয়ে যায়। কিন্তু কেন?
যখন একটি বাস বা ট্রেন গতিশীল থাকে তখন এটি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সুষম বেগে চলে না। অর্থাৎ সময়ের সাথে এর বেগ পরিবর্তিত হয়। যেমন: একটি বাস এখন হয়তো ৬০ কিলোমিটার/ঘন্টায় চলল, পরক্ষণে ৭০ কিলোমিটার/ঘন্টা চলল। তাহলে এর বেগের পরিবর্তনটুকু আমরা অনুধাবন করতে পারব। সময়ের সাথে বেগের পরিবর্তনের হারকে ত্বরণ বলা হয়। আমরা বেগ অনুভব করতে পারি না। বেগের পরিবর্তনের হার অর্থাৎ ত্বরণ অনুভব করতে পারি। যদি বেগের পরিবর্তন না হয় তাহলে বেগের পরিমান যত বেশীই হোক না কেন তা অনুভবক্ষম হবে না এবং আমাদের শরীরে তার কোনো প্রভাব পড়বে না। মানুষ্যসৃষ্ট সবগতিশীল বস্তুই কমবেশী অসম বেগে গতিশীল হয়, অর্থাৎ সর্বদা কিছু না কিছু ত্বরণ হয়েই থাকে। আবার যদি বেগের মান মোটামুটি সুষম থাকেও তবু এর দিকটি পরিবর্তিত হয়ে যায়। স্কুলে আমরা যারা পদার্থ বিজ্ঞানের একেবারে প্রাথমিক আলোচনা পড়েছি তারা সবাই জানি, বেগের মান বা দিক বা উভয়ই পরিবর্তিত হলে ত্বরণ ঘটে। কাজেই বেগের মান সুষম হয়ে যদি দিক পরিবর্তিত হয় তবুও আমরা সেই গতি অনুভব করতে পারব। মানবসৃষ্ট প্রতিটি বাহনই কমবেশী দিক পরিবর্তন করে। শুধু তাই নয়, চলতে চলতে এতে কমবেশী ঝাঁকুনি তৈরি হয় যেটিও বেগের দিক পরিবর্তনসূচক। কিন্তু যদি বেগের মান ও দিক স্থির থাকে তাহলে আমরা তা অনুভব করব না। যেমন: স্থির সমুদ্রে জাহাজ অনেকসময় বেশ সুষম বেগে চলে। তাই জাহাজের কেবিনে শুয়ে চলন্ত জাহাজকে আমাদের স্থিরই মনে হবে।
অপরদিকে, পৃথিবীর নিজের যেসব গতি সেগুলোর সবই অত্যন্ত সুষম, তাই এদের গতি অনুভব করা যায় না। তারপরও যদি পৃথিবীতে আমাদের পরিপার্শ্বের বিভিন্ন বস্তু বিভিন্ন বেগে গতিশীল থাকত তবুও আমরা বেগ বুঝতে পারতাম, একটির সাপেক্ষে অপরটির অবস্থান পরিবর্তনের কারণে। কিন্তু পৃথিবীর পৃষ্ঠের সবকিছুই পৃথিবীর সাথে একই বেগে গতিশীল। তাই পৃথিবীর বেগের বোঝার উপায় নেই। এতক্ষণে হয়তো ভাবছেন,পৃথিবীর কোনো গতিই সরলরৈখিক নয় এবং প্রায় সবধরনের গতিই ঘূর্ণন গতি। যেহেতু ঘূর্ণায়মান পৃথিবীর বেগের ক্ষেত্রে দিকটি প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে তাহলেতো তা অনুভব করতে পারার কথা। এই ক্ষেত্রে বলতে হয়, পৃথিবীর গতিগুলো ঘূর্ণন গতি হলেও এদের বক্রতা খুবই কম। একটি বৃত্ত যত বিশাল হবে তার বক্রতা ততোই কম হবে। মানুষে সাপেক্ষে পৃথিবীর এই বক্রতাকে সরলরেখাই ধরে নেয়া যায়। সেই ক্ষেত্রে যেটুকু ত্বরণের প্রভাব আমাদের উপর পড়বে তা অনুভবক্ষম হবে না।
পৃথিবীর গতি অনুভব করা না পারায় আগেরকার মানুষ বিভ্রান্ত হয়েছে। মানুষ মনে করেছে পৃথিবী স্থির এবং এর আকাশে বিভিন্ন বস্তুর অবস্থান বদলাতে দেখে মনে করেছে পৃথিবী মহাবিশ্বের কেন্দ্র এবং অন্যান্য বস্তুগুলো পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। মানুষের সেই বিশ্বাস ভাঙ্গতে শুরু করেছে কেবল চার শতাব্দী আগে, টেলিস্কোপের মাধ্যমে আকাশ পর্যবেক্ষণ শুরুর মধ্য দিয়ে। যার সবচেয়ে বড় অবদান বিজ্ঞানী গ্যালিলিও’র।
©বিজ্ঞান পত্রিকা