বিজ্ঞানচিন্তার দপ্তরে অনেক চিঠি আসে, একটা প্রশ্নের উত্তর চেয়ে। মেসেজ আসে বিজ্ঞানচিন্তা গ্রুপ কিংবা ফেসবুক পেজে, একই প্রশ্ন। একটুখানি ফিজিকস গ্রুপের দেয়ালে আছড়ে পড়ে প্রশ্নের ঢেউ- ফোটনের ভর নেই কিন্তু ভরবেগ আছে কেন?
এখানেই আসলে ভরশক্তির সমীকরণের কারিশমা। ধরা যাক, একটা ইলেকট্রন। এর গতি নির্দিষ্ট নয়। কিন্তু একেবারে থেমে থাকা ইলেকট্রনের দেখাও আপনি পাবেন না। তাই যেকোনো ছুটন্ত ইলেকট্রনের ভরবেগ আপনি পাবেন। আলোর তো আর নিশ্চল ভর নেই, তাহলে এর ভরবেগ আসে কোত্থেকে?
এখানেই আসলে আলোর বিচিত্র চরিত্রের খেলা। আলো এক ধরনের শক্তি, সে আমরা সেই প্রাইমারি স্কুল থেকে পড়ে আসছি। আবার শক্তির সঙ্গে ভরবেগের সম্পর্ক আছে।
বিস্তারিত ব্যাখ্যায় যাওয়ার আগে জানা দরকার, ভরবেগ নিয়ে বাংলা ভাষায় জটিলতা আছে। আমরা যেটাকে বাংলায় ‘ভরবেগ’ বলি, এই শব্দটা দেখলেই বোঝা যায়, ভর আর বেগ দুটোই যেন ডট গুননের নিয়মে পাশাপাশি বসে গেছে। কিন্তু ইংরেজি শব্দটা হলো মোমেন্টাম (momentum)। এখানে ভর অর্থাৎ ম্যাস (mass) কিংবা বেগ, ইংরেজিতে যাকে বলে ভেলোসিটি (Velocity)- এই দুইয়ের নামগন্ধই নেই এই ‘মোমেন্টাম’ শব্দটির মধ্যে। তাই বাংলা ভরবেগ শব্দটা দেখলে আমরা সরলীকরণ করে ফেলি, বস্তুর মোমেন্টাম থাকতে হলে ভর থাকতেই হবে। ঝামেলাটা তৈরি হয়েছে চিরায়ত গতিবিদ্যায় মোমেন্টামের যে সংজ্ঞা আছে সেখান থেকেই।
চিরায়ত গতিবিদ্যায় মোমেন্টামের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, বস্তুর ভর আর বেগকে গুন করে ফলাফল হিসেবে পদার্থবিদ্যার যে রাশিটি পাওয়া যাবে, তাকেই বলে মোমেন্টাম। সুতরাং বাংলা বৈজ্ঞানিক পরিভাষাবিদরা সেটা ‘ভরবেগ’ বানিয়ে ফেলছেন। চিরায়ত বলবিদ্যায় এটাতে সমস্যা থাকারও কথা নয়। সমস্যা হয় তখন, যখন খুদে কণিকাদের হিসাব এসে পড়ে। বিশেষ করে কোয়ান্টাম বলবিদ্যায় মোমেন্টামের হিসাব মোটেও ভর আর বেগের গুনফল দিয়ে করলে চলে না। কারণ কণাদের ভর থাকতেও পারে নাও পারে। কিন্তু শক্তি আছে। আবার একই সঙ্গে কণা আর তরঙ্গ চরিত্রও রয়েছে এদের। সুতরাং মোমেন্টামের ভেতর কোয়ান্টামের ব্যাপার-স্যাপার না এলে হিসাব মিলবে কী করে?
আবার কণাদের ভর না থাকলেও তারা অন্যবস্তুকে মোমেন্টাম অর্থাৎ ভরবেগ দিতে পারে, ঠিক যেমন গতিশীল এক বড় গাড়ি একটা সিএনজি অটোরিক্সাকে ধাক্কা দিয়ে সেটাকে গতিশীল করে দিতে পারে। অর্থাৎ থেমে থাকা একটা অটোরিক্সাকে যদি কোনো প্রাইভেট কার এসে পেছন থেকে ধাক্কা দেয়, তাহলে অটোরিক্সাটি গাড়ির কাছ থেকে ভরবেগ লাভ করে এবং সামনের দিকে গতিশীল হয়। অন্যদিকে ধাক্কার ফলে প্রাইভেট কারটির গতি কিছুটা কমে যায়, সুতরাং ভরবেগও কমে যায়। আর গাড়ির ভরবেগ ততটুকুই কমবে, যতটুকু ভরবেগ সিএনজি অটোরিক্সাটি লাভ করবে। ঠিক একই ঘটনা ঘটে আলোকতড়িৎক্রিয়ার ক্ষেত্রেই।
আলোকতড়িৎক্রিয়া প্রথম পর্যবেক্ষণ করেণ ব্রিটিশ বিজ্ঞানী হেনরিখ হার্জ, ১৮৮৭ সালে। একই বছর একই ব্যাপার লক্ষ্য করেন জার্মান বিজ্ঞানী ভিলহেম হলকওয়াস। এসময় বিশ্বজড়ে বিজ্ঞানীরা ক্যাথোড রশ্মি নিয়ে ব্যস্ত। ক্যাথোড রশ্মি আসলে কণাদের স্রোত না আলোর রশ্মির প্রবাহ, তা নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত গোটা দুনিয়ার বিজ্ঞানীরা। ক্যাথোড রশ্মির পরীক্ষাগুলো চলে বায়ুশূন্য ক্যাথোড টিউবের ভেতর। এই টিউবে যে ক্যাথোড দণ্ড ব্যবহৃত হয়, সেগুলো ধাতুরই তৈরি। হার্জ ক্যাথোড দণ্ডকে অতিবেগুনি রশ্মি দিয়ে আঘাত করেন। এর ফলে সেটা থেকে নির্গত হয় ক্যাথোড রশ্মি। হার্জের বিশ্বাস ছিল ক্যাথোড রশ্মিও এক ধরণের আলোর কণা, তাই ফটোতড়িৎ ক্রিয়ার মাহত্ম্য বোঝা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। পরে অবশ্য হলকওয়াসকেও ভাবিয়েছিল এই ঘটনা। তিনি আরও পরীক্ষা-নিরিক্ষা চালান। আরেকটু স্পষ্ট হয় ব্যাপারটা। কিন্তু, ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। হার্জ-হলকয়াকেরও দেড় দশক আগে একটু অন্যভাবে ব্যাপারটা পর্যবেক্ষণ করেন এক ব্রিটিশ তড়িৎপ্রকৌশলী উলাফবি স্মিথ। কিন্তু তিনি মাথামুণ্ডু কিছুই বোঝেননি। এরপর ১৮৯৯ সালে আলোকতড়িৎক্রিয়া নিয়ে ব্যাপকভাবে কাজ করেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী জে জে টমসন। আসলে এই ঘটনা নিয়ে গবেষণা করতে গিয়েই তিনি নিশ্চিত হন ক্যাথোড রশ্মি আসলে আলোক রশ্মি নয়, ইলেকট্রন কণার স্রোত। অর্থাৎ ইলেকট্রন কণাটাই টমসন আবিষ্কার করে বসেন ক্যাথোড রশ্মি নিয়ে পরীক্ষা করতে গিয়ে। কিন্তু কেন ক্যাথোড দণ্ডে আলো ফেললে সেখান থেকে ইলেকট্রন কণা নির্গত হবে, সে বিষয়টা নিশ্চিত হতে পারেননি টমসন।
কাছাকাছি সময় এই ঘটনা নিয়ে আরও বিস্তারিত গবেষণা করেন ফিলিপ লেনার্ড। কিন্তু ব্যাখ্যা মেলেনি। ব্যাপারটা ছিল এমন-- ধাতব ক্যাথোড পাত ওপর পাত থেকে ক্যাথোড রশ্মির আকারে আসলে ইলেকট্রন কণাই বেরিয়ে আসছে। সমস্যা আলোকে তখন সবাই তরঙ্গ মনে করত, নিউটনের কণা তত্ত্ব বাতিল করেছিলেন জার্মান বিজ্ঞানী হেনরিখ হাইগেনস শ দেড়েক বছর আগেই। যে জিনিস নিজে তরঙ্গ, তারপক্ষে কীভাবে সম্ভব একটা ধাতব পাত থেকে রীতিমত ভরযুক্ত একটা কণাকে মুক্ত করা?
পাঠক, এখন আবার আমাদের ফিরে যেতে হবে অটোরিক্সা আর প্রাইভেট কারের কাছে। ভাবুন তো একটা স্থির অটোরিক্সার ওরর লক্ষ-কোটি ওয়াটের এক টর্চের আলো ফেলে সেটাকে নড়াতে পারবেন? আপাতদৃষ্টিতে সেটা সম্ভব নয়। কিন্তু আলোর বদলে যদি বাতাস প্রবাহিত করেন? খুব কম বাতাস হলে চলবে না। কিন্তু বাতাসের বেগ যদি খুব বেশি হয়, ধরা যাক সেটা বিশাল এক ঘূর্ণিঝড়ের রূপ নিয়ে এলো, তাহলে? শুধু অটোরিক্সা কেন, প্রাইভেট কারকেও উড়িয়ে নিতে পারে। তবে সেটা বাতাস বলেই সম্ভব। কারণ বাতাস বস্তু, ভর আছে, মোমেন্টাম আছে। কিন্তু তরঙ্গ? সেই যুগে তরঙ্গের শক্তির কথা জানত সবাই, কিন্তু তার যে মোমেন্টাম থাকতে পারে একথা ভাবার সাহসই ছিল না। কিন্তু একজন জার্মান, যিনি কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণ সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে দেখালেন দুঃসাহস। বললেন, বিকিরণ, যাকে আমরা শক্তি বলে জানি, সেই শক্তি নির্গত হয় গুচ্ছ গুচ্ছ আকারে। অর্থাৎ যাবতীয় বিকিরণ শক্তি যাকে আমরা এতদিন নিরবিচ্ছিন্ন শক্তি প্রবাহ বলে ভাবতাম, তা আসলে নিরবিচ্ছিন্ন প্রবাহ নয়। যাঁরা রাইচমিলে ধান ভাঙানো দেখেছেন, তাদের জন্য ব্যাপারটা বোঝা সহজ হবে।
রাইচ মিলের হলার থেকে যখন প্রচণ্ডবেগে চাল বেরিয়ে আসে, তখন মনে হয় ঝর্নার ধারার মতো একটা চালের ধারা বেরিয়ে আসছে। এগুলো যে অসংখ্য চালের সমষ্টি, তখন তা বোঝা যায় না। মনে হয় ধূসর রঙের একটা নিরবিচ্ছিন্ন ধারা হলার থেকে নিচে নেমে আসছে। কিন্তু সেখন থেকে একমুঠো চাল হাতে নিয়ে দেখুন, প্রতিটা চাল তখন আলাদা করে চিনতে পারবেন। ঝর্নার পানির ক্ষেত্রেও একই ব্যপার। আপাত দৃষ্টিতে মনে হয়, ঝর্নার ধারা নিরবিচ্ছিন্ন। কিন্তু একথা তো সত্যি, এই পানির ধারাগুলো ট্রিলিয়ন-ট্রিলিয়ন পানির অণু দিয়ে তৈরি। কষ্টসাধ্য হলেও পানির ধারা থেকে পানির অণুগুলো আলাদা করা যায়।
চলবে...