-মাহফুজুর রহমান রিদোয়ান
মহাবিশ্ব প্রতিনিয়ত সম্প্রসারিত হচ্ছে।এভাবে সম্প্রসারিত হতে থাকলে কি ঘটবে?
স্থান ও সময় এবং এদের অন্তর্ভুক্ত সকল বিষয় নিয়েই মহাবিশ্ব ।মহাবিশ্বই সবকিছু। এর মধ্যে রয়েছে সকল স্থান, এবং সকল পদার্থ এবং শক্তি । ঘড়ির কাটা ঘোরা এমনকি সময়ও এই মহাবিশ্বের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত এবং অবশ্যই, এটি আপনার নিজেকেও অন্তর্ভুক্ত করে। পৃথিবী এবং চাঁদ মহাবিশ্বের অংশ, এছাড়া অন্যান্য গ্রহ এবং চাঁদের মত আরও কয়েক ডজন উপগ্রহ এর মধ্যে পড়ে।আমাদের পর্যবেক্ষণ-লব্ধ মহাবিশ্বের ব্যাস প্রায় ৩০০ বিলিয়ন আলোকবর্ষ।
মহাবিশ্ব প্রতিনিয়ত সম্প্রসারিত হচ্ছে। তবে ঠিক ফুটবলের মতো সব দিকে সমান ভাবে ফুলে ফেঁপে উঠছে না। কোনও বিশেষ একটি দিকেই বেশি ফুলে ফেঁপে উঠছে মহাবিশ্ব। অনেক বেশি দ্রুত গতিতে। ফলে, তার চেহারাটা হয়ে যাচ্ছে অনেকটা রাগবি বলের মতো। যার পেটটা ফোলা। মহাবিশ্বের এই সম্প্রসনশিলতা নিয়ে কিছু তত্ব রয়েছে। তার মধ্যে হাবলের সুত্র অন্যতম।
হাবলের সূত্রঃ পদার্থবিজ্ঞানের মহাকাশবিদ্যার একটি আবিষ্কার যা প্রকাশ করে
১) গভীর মহাকাশে যে সব বস্তু দেখা যায় তা পৃথিবীর সাপেক্ষে এবং একে অপরের সাপেক্ষে একটি আপেক্ষিক বেগে চলে।
২)আর এই বেগ পৃথিবী থেকে তাদের দূরত্বের সমানুপাতিক । মোটামুটিভাবে দুরবর্তী ছায়াপথ গুলির দূরত্ব এবং অপসারণ বেগের মধ্যে বিদ্যমান সমানুপাতিক সম্পর্ককে হাবলের নীতি বলে। এই সম্পর্কটিতে বেগ ও দূরত্বের অনুপাত যে ধ্রুবসংখ্যা তাকে হাবলের ধ্রুবক বলে। এই ধ্রুবকটিকে H বা H০ দ্বারা প্রকাশ করা হয়ে থাকে । বস্তুত পর্যবেক্ষণের উপযুক্ত মহাকাশ দিনে দিনে আয়তনে সম্প্রসারিত হচ্ছে এবং এ প্রকিয়ার সরাসরি সম্পর্ক প্রকাশ করে হাবলের নীতি।এটা প্রথম পর্যবেক্ষণশীল ভিত্তি যা সম্প্রসারিত মহাকাশ তত্ত্বকে প্রমাণ করে এবং বর্তমানে বিগ ব্যাং মডেল তত্ত্বের সমর্থনে অন্যতম প্রমাণ হিসেবে কাজ করে ।
বলে রাখা ভালো, যদিও সবাই এডওইন হাবলকে এর কৃতিত্ব দেয়, কিন্তু এই সমীকরণটি প্রথম পাওয়া গেছে ১৯২৭ সালে 'জর্জ ল্যামেত্র' এর সাধারণ আপেক্ষিক সমীকরণ নামক প্রতিবেদনে যেখানে তিনি বলেন যে মহাকাশ সম্প্রসারিত হচ্ছে এবং তিনি এই সম্প্রসারণের হারের একটি নির্দিষ্ট মান প্রস্তাব করেন এখন যা হাবলের ধ্রুবক নামে পরিচিত । দুই বছর পর, হাবল এই নীতির সত্যতা নিশ্চিত করেন এবং ধ্রুবকের অধিক সঠিক মান নির্ণয় করেন যা তার নাম বহন করছে।
এই নীতি প্রকাশ করা হয় V=H০D হাবল ধ্রুবকের যুক্তিসঙ্গত মান হলো 72 km per s/Mpc (1Mpc=3.084x10 to the power 19 km )
তা ছাড়াও আরো কিছু তত্ব রয়েছে, যেমন স্থানের মেট্রিক সম্প্রসারণ Metric expansion of space ,ফ্রিদম্যানের সমীকরন, ফ্রিদমান-লেমাইট্র-রবার্টসন-ওয়াকার মেট্রিক, লোহিত স্বরন ইত্যাদি।
এবার আসি এভাবে মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হতে থাকলে কি ঘটবে,
মহাবিশ্বের পরিণতি নিয়ে জ্যোতিপদার্থবিদদের মধ্যে বেশ কয়েকটি ধারণা ঘুরপাক খাচ্ছে। একটি দৃশ্যপট এমন যে আজ থেকে প্রায় 120 বিলিয়ন বছর পরে যদি অদৃশ্য শক্তি বা Dark Energy-এর ঘনত্ব সময়ের সাথে সীমাহীনভাবে বেড়ে যেতে থাকে তাহলে মহাবিশ্বের প্রসারণও সীমাহীনভাবে বৃদ্ধি পাবে। ফলে গ্যালাক্সি বা গ্যালক্সিগুচ্ছে, সৌরজগৎ ইত্যাদি যারা মহাকর্ষের প্রভাবে একত্রিত থাকে তারা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে এবং কালক্রমে মহাবিশ্বের প্রসারণ এত প্রবল হতে থাকবে যে, যে তাড়িতচৌম্বক বল অণু-পরমাণুসমূহকে একত্রিত করে রাখে সে বলকে অগ্রাহ্য করে এরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে থাকবে। এমনকি নিউক্লিয়াস পর্যন্ত ছিন্নভিন্ন হয়ে এক অস্বাভাবিক মহাকর্ষীয় অনন্যতায় আমাদের এ পরিচিত মহাবিশ্বের সমাপ্তি ঘটবে। এ অনন্যতার সময় মহাবিশ্বের প্রসারণের হার অসীমে পৌঁছাবে ফলে যেকোনো বল তা সে যতই প্রবল হোক না কেন পদার্থের ওপর তার কোনো প্রভাবই থাকবে না। মহাবিশ্বের সবকিছুই পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে যাকে বিশ্ব রিপ (Big Rip) বা মহাবিচ্ছেদ নামে অভিহিত করা হয়।
এখন থেকে 100 বিলিয়ন বছর পরে অদৃশ্য শক্তির শক্তি ঘনত্ব যদি ঋণাত্মক হয় বা মহাবিশ্ব যদি আবদ্ধ হয় তাহলে এটা সম্ভব যে, এক সময় মহাবিশ্বের প্রসারণ বিপরীতমুখী হয়ে একটা অত্যন্ত উত্তপ্ত ও অতি ঘন অবস্থায় সঙ্কুচিত হবে। যাকে মহাসঙ্কোচন বা Big Crunch বলা হয়। সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণ থেকে জানা যাচ্ছে যে, মহাসঙ্কোচন সম্ভবত কখনই ঘটবে না বরং প্রসারণ অব্যাহতভাবে চলতে থাকবে। এমনকি ত্বরান্বিতও হতে পারে।
এখন থেকে 10^5 বিলিয়ন বছর পরে দৃশ্যপট এমন হতে পারে মহাবিশ্ব প্রসারিত হতে হতে প্রায় 10^14 বছর পরে যে সময় আসবে তখন মহাবিশ্বের নক্ষত্রসমূহের জ্বালানি শেষ হয়ে যাবে এবং নতুন নক্ষত্রও আর জন্ম নেবে না এবং আরো দীর্ঘকাল পরে গ্যালাক্সিগুলো কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত হয়ে হকিং বিকিরণের মাধ্যমে শক্তি বিকিরণ করতে থাকবে। মহাএকীভবন তত্ত্ব অনুসারে প্রায় 10^34 বছর পরে প্রোটনের অবক্ষয়ের ফলে আজ্ঞনাক্ষত্রিক গ্যাস এবং আজনাক্ষত্রিক অবশেষকে লেপটন (পজিট্রন এবং ইলেকট্রন) এবং ফোটনে রূপান্তরিত করবে। কিছু পজিট্রন ও ইলেকট্রন আবার পুনঃসংযোজিত হয়ে ফোটন তৈরি করবে। এক্ষেত্রে মহাবিশ্ব কণা ও নিম্নশক্তির বিকিরণের সমন্বয়ে একটি উচ্চ এন্ট্রপি অবস্থায় পৌঁছাবে। অবশ্য ঠিক কখন যে মহাবিশ্ব তাপগতীয় সাম্যাবস্থায় পৌঁছাবে তা জানা যায়নি। তবে বিজ্ঞানীরা ধারনা করছেন এখন থেকে প্রায় 10^1000 বছর পরে সে সময় আসতে পারে আর তখনই ঘটতে পারে মহাবিশ্বের তাগীয় মৃত্যু।
তথ্যসুত্রেঃ উইকিপিডিয়া, সাইন্স এলার্ট, কুওরা