লেখকঃ এনামুল হক
দৈনিক জনকনণ্ঠ হতে সংগ্রহীত
.
.
.
রাস্তাঘাটে একই চেহারার অন্য মানুষ দেখে আমরা বিভ্রান্ত হই। অনেক সময় বিব্রতকর পরিস্থিতিতেও পড়ি। এমন ঝকমারিতে পড়া স্বাভাবিক। একই চেহারার মানুষের তো অভাব নেই। প্রশ্ন হচ্ছে তাই বলে প্রত্যেকেরই কি একই চেহারার আরেকজন রয়েছে? প্রকৃতপক্ষে এমন সম্ভাবনা যথেষ্ট মাত্রায় বিদ্যমান। কারণ যেসব জিন চেহারার বৈশিষ্ট্যকে প্রভাবিত করে সেগুলোর সংখ্যা সীমিত।
কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরোবায়োলজির সহকারী অধ্যাপক মাইকেল শিহান, বোলতা ও নেংটি ইঁদুরের মতো প্রজাতিগুলোর ক্ষেত্রে চেহারার তারতম্য ও বংশগতি নিয়ে নিয়মিতই গবেষণা চালিয়ে থাকেন। তিনি বলেছেন যে, আমাদের চারপাশে জিনগত বৈচিত্র্য প্রচুর পরিমাণে বিদ্যমান। তার মধ্যে কতগুলো জিন মানুষের চেহারার আদল নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সে সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের বর্তমানে কোন ধারণা নেই। মুখায়বের কাঠামো, চুল, চোখ ও ত্বকের বর্ণের মতো বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে বিপুল সংখ্যক জিনের অবদান থাকে এবং এই জিনগুলোর সবই অতিমাত্রায় অসম বা পরস্পরের সঙ্গে অমিল রয়েছে। এমন মন্তব্য করেছেন হিউস্টনের জিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আর্থার বিউডেট। মানুষের মুখম-লে বিপুল মাত্রায় স্বাতন্ত্র্য আসার ক্ষেত্রে বিবর্তনের একটা ভূমিকা আছে। শিহান ও তার এক সহকর্মী গত বছর যে চার কমিউনিকেশনস সাময়িকীতে এক নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন যে, মানুষে মানুষে হাতের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে যে তারতম্য থাকে তাদের চেহারার ক্ষেত্রে মাত্রাগত তারতম্যটা তার চেয়েও বেশি। এছাড়াও বিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করেছেন যে, মানুষের এনাটমি বা দৈহিক গঠনের অন্যান্য এলাকায় যত জিন যুক্ত তার তুলনায় তাদের চেহারার সঙ্গে আরও বেশি জিন যুক্ত। শিহান বলেন, মানুষে মানুষে শরীরের অন্যান্য অংশের ক্ষেত্রে যে তারতম্য থাকে তার ভিত্তিতে তাদের চেহারাগত অমিল যতটা হওয়ার কথা তার চেয়ে সেই অমিলটা আরও বেশি। এর একটা সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হলো এই যে, অন্যান্য সামাজিক প্রাণীর মতো মানুষ তাদের নিজ প্রজাতির বিভিন্ন ব্যক্তির মধ্যে পার্থক্য টানার সক্ষমতা থেকে লাভবান হয়।
পরিবারের সদস্যদের মধ্যে চেহারাগত সাদৃশ্য গড়পরতা হিসেবে অনাত্মীয় ব্যক্তিদের তুলনায় বেশি থাকে। তা থেকে প্রমাণ হয় যে, মানুষের চেহারা স্পষ্টতাই উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্তি। সে কারণেই কথিত অভিন্ন যমজ সন্তানদের মধ্যে পার্থক্য টানা অনেক সময় অসম্ভব হয়ে পড়ে। বলাবাহুল্য যমজদের প্রত্যেকেই একই নিষিক্ত ডিম্ব থেকে বিকাশলাভ করে এবং তাদের মধ্যে সমস্ত জিনই অভিন্ন রূপে থাকে।
বিউডেট বলেন যে, একথা বলার পিছনে যুক্তি আছে যে পরস্পরের অপরিচিত যেসব ব্যক্তির একে অপরের সঙ্গে চেহারাগত মিল আছে তারা যাদের মধ্যে চেহারাগত মিল মোটেও নেই তাদের তুলনায় সম্ভবত পরস্পরের সঙ্গে অধিকতর নিকট সম্পর্কিত। অথচ সে ব্যাপারটা তারা আদৌ হয়ত জানেও না। তদুপরি বাইরের জাত বা গোষ্ঠীর লোকদের তুলনায় একই জাত বা গোষ্ঠীর লোকদের নিজেদের মধ্যে অভিন্ন জিন অনেক বেশি সংখ্যায় থাকে। এই কারণেই দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায় যে, দক্ষিণ এশীয়রা সাধারণত কালো চুল ও বাদামী ত্বকের অধিকারী এবং স্ক্যান্ডিনেভীয়দের সাধারণত সোনালী চুল ও শ্বেতকায় গাত্রবর্ণ দেখা যায়।
বিউডেট বলেন, ‘ব্যাপারটা এমন নয় যে আপনি এমন একজন এশীয় ও একজন ইউরোপীয়কে পেয়ে গেলেন যাদের চেহারা প্রায় একই রকম। একই চেহারার দু’জন মানুষকে দেখতে পাওয়া গেলে বুঝতে হবে সম্ভবত তাদের একই বংশ থেকে উৎপত্তি ঘটেছে। বস্তুতপক্ষে পিছনের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে তাদের প্রচুর পরিমাণ জিনগত বৈশিষ্ট্য অভিন্ন’।
নৃতত্ত্বগত বিষয়টি একটা হেঁয়ালিপূর্ণ বিষয়। এর সঙ্গে সংস্কৃতি ও ভাষার মতো অ-বংশগতির দিকগুলোও যুক্ত। তথাপি বৃহত্তর নৃতাত্ত্বিক সত্তা বা জাতি বলতে জিনগতভাবে সম্পর্ক যুক্ত লোকজনকে বুঝায় যাদের মধ্যে একই চেহারার ব্যক্তিবর্গ থাকার সম্ভাবনা যৌক্তিক দিক দিয়ে অনেক বেশি। বিশ্বের সবচেয়ে বড় নৃতাত্ত্বিক বা জাতিগোষ্ঠী হচ্ছে হান চৈনিক (প্রায় ১৩০ কোটি নরনারী) এবং হিন্দুস্তানী (সম্ভবত ১২০ কোটি)। আপনি যদি এই দুই জাতিগোষ্ঠীর কোন একটির অন্তর্গত হন তাহলে আপনার সঙ্গে সেই গোষ্ঠীর অন্য কারোর মিল থাকার সম্ভাবনা তত্ত্বগতভাবে বেশি থাকবে।
এতকিছু সত্ত্বেও অভিন্ন জিন ও ভৌগোলিক অঞ্চলের অধিকারী ব্যক্তিবর্গের চেহারাগত সাদৃশ্য থাকার ধারণাটি আধুনিক যুগের বৈশ্বিক অভিবাসনের কারণে জট পাকিয়ে গেছে। যেসব জাতিগোষ্ঠী বেশ কয়েক শতাব্দী আগে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল এখন তাদের মধ্যে নিয়মিত মিলন ঘটছে, প্রজনন হচ্ছে এবং সন্তান উৎপাদন চলছে। বিউডেট বলেন, আগে লোকে খুব একটা স্থানান্তর গমন করত না। এখন এক মহাদেশের মানুষের সঙ্গে অন্য মহাদেশের মানুষের মিলন ঘটছে, প্রজনন হচ্ছে, সন্তান জন্ম নিচ্ছে। ফলে তাদের জিনগত রূপান্তরও ঘটছে। তাই জাতিসত্তা নতুন বৈশিষ্ট্য লাভ করছে। মনে রাখতে হবে যে মানুষের উৎপত্তি হয়েছিল আফ্রিকায় কয়েক লাখ বছর আগে। কালক্রমে তারা পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।
সূত্র : লাইফ সায়েন্স