হিপনোসিস একটি কার্যকরী মনোবৈজ্ঞানিক চিকিৎসা পদ্ধতি। এর কার্যকারিতার প্রমান রয়েছে। তবে হিপনোসিস সম্পর্কে আমাদের নানা ভুল ধারনা রয়েছে।
সম্মোহন বলতে বোঝায় কাউকে মানসিকভাবে এমন একটা অবস্থায় নিয়ে যাওয়া যখন সম্মোহিত ব্যাক্তিকে প্রকৃত মানসিক অবস্থা জানা সম্ভব। আসলে মানুষের মনের দুটো পর্যায় রয়েছে, একটি বাহ্যিক মন আরেকটি অন্ত মন। বাহ্যিক মন হচ্ছে আপনার মনে যা আসছে তা আপনি বুঝতে পারেন ও তা করতে পারেন। অন্তমন হচ্ছে আপনার চিন্তারর গভীরতম অংশের ক্ষেত্র। যেখানে আপনি চেতন বা অবচেতন মনের সকল চিন্তা উৎপাদিত হয়। এটা সহজে প্রকাশিত হয় না বা সেকাজ সহজে আপনি করেন না। প্রকৃতপক্ষে অন্তমনের উপর প্রভাব বিস্তার করাকেই সম্মোহন বলে। সম্মোহন যে কেউ করতে পারে। তবে এজন্য চর্চার প্রযোজন পড়ে।
কারো চোখের সামনে হাত বা ফুল নাড়িয়ে কিংবা চোখের তারায় জোরালো আলো ফেলে সম্মোহিত করে তার থেকে তথ্য বা অন্য কিছু হাতিয়ে নেওয়ার দৃশ্য সিনেমা কিংবা নাটকে আমরা দেখেছি। বই বা মনোবিজ্ঞান-বিষয়ক সাময়িকীতে পড়েছি যেকোনো মানুষকে সম্মোহিত করে ইচ্ছামতো যেকোনো কাজ করিয়ে নেওয়ার ঘটনাও।
প্রাচীনকাল থেকেই সম্মোহনবিদ্যা প্রচলিত রয়েছে মানব সমাজে। সেকালে এই বিদ্যাকে জাদুবিদ্যা, বশীকরণবিদ্যা বা অলৌকিক ক্ষমতা বলে মানুষ বিশ্বাস করা হতো। তবে অষ্টাদশ শতকে সম্মোহনবিদ্যার নামকরণ হয় ‘মেজমেরিজম’। অস্টিয়ার ভিয়েনা শহরের ড. ফ্রান্ডস অ্যান্টন মেজমার সম্মোহনবিদ্যার চর্চা শুরু করেন বলে পরবর্তীতে তার নামানুসারে এর নামকরণ করা হয় ‘মেজমেরিজম’।
কিন্তু ১৮৪০ সালে স্কটল্যান্ডের আরেক ডাক্তার জেমস ব্রেড এর নতুন নামকরণ করেন। সম্মোহিত ব্যক্তি যেহেতু এক প্রকার ঘুমের ঘোরে কাজ করে যায় তাই তিনি গ্রিকদের ঘুমের দেবতা হুপনসের নামানুসারে এই বিদ্যার নাম দেন হিপনোটিজম।
সম্মোহনবিদ্যাকে (হিপনোটিজম) কলাবিদ্যা বলা যেতে পারে। হিপনোসিস শব্দের অর্থ সম্মোহন। তাই একজনের চরম প্রস্তাবনা, তীব্র আবেগ ও কল্পনাশক্তি দ্বারা অন্যের মনকে প্রভাবিত করা এবং পরিচালনা করাকে বলা হয় হিপনোসিস। আর যে বিদ্যার মাধ্যমে এটি করা হয় তাকে বলে হিপনোটিজম।
ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির প্রতিষ্ঠাতা প্রবীর ঘোষ বলেন, সম্মোহন হলো মস্তিষ্কে ধারণা সঞ্চার করা। এর ফলে মস্তিষ্ক উত্তেজিত হয়। তখন যদি সে উত্তেজনার সহনশীলতা ওই ব্যক্তির না থাকে, তবে সে সম্মোহিত হয়।
সম্মোহন মূলত বিজ্ঞানসম্মত একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে কোনো মনোরোগ বিশেষজ্ঞ তার রোগীর কাছ থেকে অবচেতন অবস্থায় বিভিন্ন কথা বের করে আনার চেষ্টা করেন। এর সফলতা রোগীর অবস্থার তারতম্যে পরিবর্তন হতে পারে। পুরো হিপনোসিস প্রক্রিয়ায় রোগী বা যাকে হিপনোসিস করা হচ্ছে তার শরীরে শিথিলতা নেমে আসে। তীব্র কল্পনাশক্তির কারণে একটি অস্বাভাবিক স্বপ্নায়ন মোহগ্রস্তের অবস্থার বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করে, যা অনেকটা ঘুমের মতো মনে হলেও আসলে কিন্তু ঘুম নয়। কারণ এই হিপনোসিস প্রক্রিয়াটিতে পুরো সময়জুড়ে হিপনোটাইজড ব্যক্তিটিকে সজাগ থাকতে হয়।
হিপনোসিস চলাকালীন মস্তিষ্কের সচেতন অংশকে সাময়িকভাবে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ওই ব্যক্তির বিক্ষিপ্ত চিন্তাগুলোকে কেন্দ্র্রীভূত করা হয় এবং তাকে মানসিকভাবে শিথিল করার দিকে মনোনিবেশ করানো হয়।
আমাদের মন কোনো একটি দিকে নিবিষ্ট হয়, কেন্দ্র্রীভূত হয় তখনই আমরা শক্তি অনুভব করি। যখন কোনো ব্যক্তি সম্মোহিত হয় তখন আমরা তার মাঝে কিছু শারীরিক পরিবর্তন ও লক্ষণীয় হয়। যেমন তার নাড়ির স্পন্দনও কমে যায়, শ্বাস-প্রশ্বাসও কমে যায়। সেই সঙ্গে তার মস্তিষ্কের আলফা স্তরে ঢেউ খেলতে থাকে। এই সময় ওই ব্যক্তিকে কোনো একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে বা বিশেষ কোনো নির্দেশনা প্রদান করা হয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানে এর ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে এই বিদ্যাকে ব্যবহার করতেন ইংল্যান্ডের ডাক্তার এস ডেল। তিনি সম্মোহনের সাহায্যে রোগীকে ঘুম পাড়িয়ে দাঁত তুলতেন, ছোটখাটো অপারেশনও করতেন।
ব্রিটিশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন কর্তৃক নিযুক্ত একটি কমিটি বিস্তর অনুসন্ধানের পর রায় দেয় যে, হিপনোটিজম একটি বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি। এরপর যত দিন এগোচ্ছে, বড় বড় চিকিৎসক-বিজ্ঞানীরা এই বিদ্যাটির উপর অত্যুৎসাহী হয়ে বিভিন্ন গবেষণা চালিয়ে আসছেন। বর্তমানে এটি সর্বজনস্বীকৃত যে, হিপনোটিজম একটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি।
অনেকেরই একটি ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে যে, প্রবল ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন মানুষকে হিপনোটাইজ করা যায় না। মূলত সব মানুষকেই হিপনোটাইজ করা সম্ভব। মোটামুটিভাবে কোনো জনসংখ্যার ৯০ শতাংশকে হিপনোটাইজ করা যায়। বাকিদের ক্রমশ উপযুক্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে হিপনোথেরাপিতে অভ্যস্ত করে তোলা যায়। হিপনোথেরাপি পদ্ধতি খুব সহজ। অবশ্য হিপনোথেরাপির আসল জোর মোটেই পদ্ধতিতে নয়, সাজেশনে। হিপনোথেরাপির উদ্দেশ্য কাউকে হিপনোটাইজ করা নয়, রোগীকে তার সমস্যা থেকে উদ্ধার করা। হিপনোথেরাপি হলো ‘প্রোগ্রামিং অব সাবকনসাস মাইন্ড’ যা সমস্যার মূলে সরাসরি আঘাত হানতে পারে। তবে অভিভাবন ঠিকঠাক না হলে মনের উপর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে।
কারো কারো ক্ষেত্রে একটি-দুটি অতিরিক্ত শব্দ গ্রহণ বা বর্জন সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে। অতএব যথেষ্ট অভিজ্ঞ ও প্রশিক্ষিত হিপনোথেরাপিস্ট ছাড়া অন্য কারও কাছে থেরাপি নেওয়া উচিত নয়। বহু রকমের অসুখ-বিসুখ সারানো সম্ভব হিপনোথেরাপির মাধ্যমে।
সারানো যায় বললে কম বলা হয়, বলা যায় একেবারে নির্মূল করা যায়, তাও বিনা ঔষধে। ব্যক্তিত্ব ও ক্যারিয়ার গঠনেও হিপনোথেরাপি ভালো কাজ করে। এছাড়াও পড়াশোনায় অমনোযোগ, অনিদ্রা, স্থূলতা, ডিপ্রেশন, রাগ কমানো, ক্ষুধামন্দা এসবের জন্য রয়েছে আলাদা আলাদা পদ্ধতির হিপনোটাইজ থিওরি।
আশা করছি বিস্তারিত বুঝতে পারছেন। এবং এই উওরটি আপনাকে কিছু হলেও সাহায্য করবে।
সূত্র: ডেইলি বাংলাদেশ