মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণীর বুদ্ধি নিয়েই যেখানে সংশয় আছে বিজ্ঞানীদের মধ্যে, সেখানে ফোটনের মতো এক জড় শক্তির বুদ্ধি আছে কি না, প্রশ্ন তোলাটা বোকামি মনে হতে পারে। কিন্তু ফোটনের অদ্ভুত সব কর্মকাণ্ডই এ প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। যেমন সাধারণ কাচ বেশ স্বচ্ছ। বেশির ভাগ দৃশ্যমান আলোই এর ভেতর দিয়ে চলে যেতে পারে। বেশির ভাগ, পুরোটা নয় কিন্তু। কিছু আলো স্বচ্ছ কাচ থেকেও প্রতিফলিত হয়। সবচেয়ে স্বচ্ছ কাচেও ৪ শতাংশ আলো প্রতিফলন করতে পারে। আলোর প্রতিফলন-প্রতিসরণ নির্ভর করে আলোর কণা ফোটনের ওপর। তার মানে আলোর কণাধর্মই নির্ধারণ করে আলো কাচ বা অন্য বস্তুর ওপর পড়লে সেটা ওই বস্তুর ভেতর দিয়ে বেরিয়ে যাবে নাকি প্রতিফলিত হয়ে ফিরে আসবে। নিউটন আলোর কণাধর্মের ধারণা দিয়েছিলেন। তিনি আসলে আপাদমস্তক কণাবাদী। বস্তুকে যেমন অসংখ্য খুদে কণিকার সমাবেশ মনে করতেন, তেমনি আলোকরশ্মিকেও তিনি মনে করতেন অসংখ্য ভরহীন কণার সমাবেশ। ঊনবিংশ শতাব্দীতে আলোর কণাতত্ত্ব ধামাচাপা পড়ে যায়। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর শুরুতেই সেই কণাতত্ত্ব ভিন্নভাবে ফিরিয়ে আনেন আলবার্ট আইনস্টাইন। কোয়ান্টাম তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা হয় আলোর কণাতত্ত্বের ওপর দাঁড়িয়েই।
নিউটনই স্বচ্ছ কাচে আলোর কণাদের প্রতিফলনের বিষয়টা লক্ষ করেন। তিনি নিশ্চিত হন আলোর পরিমাণ যত কমই হোক আর যত বেশিই হোক, প্রতিফলিত আলোর হার সমান। তখনই সমস্যাটা তাঁর মাথায় আসে। যেসব আলোর কণা প্রতিফলিত হয়, তারা কীভাবে বোঝে স্বচ্ছ কাচে প্রতিফলিত হয়ে তাদের ফিরে আসতে হবে? তাহলে আলোর কণাদের কি বুদ্ধি আছে? তারা কি জানে কারা স্বচ্ছ কাচ ভেদ করে যাবে আর কারা প্রতিফলিত হবে?
নিউটনের সময় আলোর ফোটনদের আলাদা করে শনাক্ত করা সম্ভব ছিল না। তাই অনেক প্রশ্নের জবাব খুঁজে পাওয়া তাঁর জন্য অসম্ভব ছিল। কিন্তু এই কোয়ান্টাম বলবিদ্যার যুগে আলোর ফোটনদের আলাদা করে শনাক্ত করার জন্য শক্তিশালী ডিটেকটর আছে। সেসব ডিটেকটর দিয়ে পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে, স্বচ্ছ কাচের প্রতিফলনের রহস্য ভেদ করার চেষ্টা করা হয়েছে। বিখ্যাত মার্কিন পদার্থবিদ রিচার্ড ফাইনম্যানের বিখ্যাত বই কিউইডির প্রথম অধ্যায়েই আলোচনা করা হয়েছে এই সমস্যা নিয়ে। বিস্তারিত ব্যাখ্যাও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সমস্যাটা যে তিমিরে রয়ে গেছে সেই তিমিরেই। ফাইনম্যানও পারেননি স্বচ্ছ কাচে আলোর কণাদের এই প্রতিফলন রহস্যের সমাধান দিতে। তিনি দেখিয়েছেন, আলোর কাচের পুরুত্ব বাড়লে প্রতিফলনক্ষমতা বাড়তে পারে। কিন্তু কখনোই শতভাগ ফোটন ভেদ করে যেতে পারে এমন কাচ কখনোই পাওয়া যাবে না। সেই সঙ্গে তিনি আরেকটা বিষয়ও দেখিয়েছেন, আলোর কাচের পুরুত্ব বাড়ালে কাচের প্রতিফলনক্ষমতা যতই বাড়ুক, কখনোই সেটা ১৬ শতাংশের বেশি হবে না। অর্থাৎ কাচের আলো প্রতিফলনক্ষমতা সর্বনিম্ন ৪ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ১৬ শতাংশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে।
এখন একটা প্রশ্ন আসতে পারে, বাজারে অনেক কাচ আছে যেগুলো খুব কালো, তার ভেতর দিয়ে খুব কম আলো বেরিয়ে যেতে পারে। যেমন ভিআইপিদের গাড়ির জানালায় এ ধরনের কাচ রাখা হয়। ধরা যাক, একটা কালো কাচের প্রতিফলনক্ষমতা ৫০ শতাংশ। অর্থাৎ সেই কাচে যে পরিমাণ ফোটন এসে পড়ে তার অর্ধেকই সে ফিরিয়ে দিতে পারে। কাচের বেশি বেশি আলো প্রতিফলনক্ষমতা এমনি বাড়েনি। তার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে কৃত্রিম পদ্ধতি। মানুষ কৃত্রিম উপায়ে কাচ তৈরির সময় কেমিক্যাল মিশিয়ে বাড়িয়েছে। কিন্তু এই কাচেও তো পুরোনো সমস্যাটা রয়ে গেছে। সেই কাচ কোন ৫০ শতাংশ আলো ফিরিয়ে দিচ্ছে, কেন ফিরিয়ে দিচ্ছে, সেটার সমাধান কিন্তু মেলেনি।
তাহলে কি ধরে নেব ফোটনদের বুদ্ধি আছে? ৪ শতাংশ ফোটন জানে তাদের প্রতিফলিত হতে হবে? না, ফোটনের বুদ্ধি থাকার প্রশ্নই ওঠে না। সমস্যাটার গভীরে এখনো বিজ্ঞানীরা যেতে পারেননি। সমস্যাটা অতি প্রাচীন। সেই নিউটনের যুগের। সাড়ে তিন শ বছরেও এর সমাধান মেলেনি। আদৌ এর সমাধান মিলবে কি না, বলা যায় না। তবে কোয়ান্টাম বলবিদ্যায় তো কত ভুতুড়ে কাণ্ড ঘটে। সেগুলোর কিছু কিছুর সমাধান তো আছেই। এই সমস্যাটার সমাধানও কি কোয়ান্টাম বলবিদ্যা দেবে? এর উত্তর পেতে আমাদের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে।