নিউট্রিনো কে ঘোস্ট পার্টিক্যাল বা ভূতুরে কণা বলা হয়..নিউট্রিনো সম্পর্কে কেন জানবেন!
বিগ ব্যাং এর পরবর্তী সময়ে সমান পরিমাণ ম্যাটার এবং এন্টি ম্যাটার তৈরি হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়. কিন্তু আমরা শুধুমাত্র ম্যাটার এর অস্তিত্ব বুঝতে সক্ষম কিন্তু এন্টি ম্যাটার সম্পর্কে গভীর জ্ঞান লাভ এর জন্য নিউট্রিনো সম্পর্কে জানা আবশ্যক।
তাছাড়া মহাবিশ্বে 69 ডার্ক এনার্জি, 26 % ডার্ক ম্যাটার এবং 5% নরমাল ম্যাটার রয়েছে। এই ডার্ক এনার্জির বিশাল শতাংশ জানার জন্য ও নিউট্রিনো বিশাল ভূমিকা রাখতে পারে...
নিউট্রিনো কি?
নিউট্রিনো হচ্ছে মৌলিক ক্ণা। এই কণা ম্যাগনেটিক ফিল্ড কিংবা স্ট্রং নিউক্লিয় ফিল্ড দ্বারাও প্রভাবিত হয় না ফলে এটি ডিটেক্ট করা খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার। আমাদের আশেপাশেই এই কণা বিদ্যমান।
কিন্তু এই কণা এতটাই স্পর্শ বাচিয়ে চলাচল করে যে, আপনি যদি এক আলোকবর্ষ প্রশসস্তের একটি লেড এর প্রাচীর একটি নিউট্রিনোর সামনে স্থাপন করে তবে কণাটির লেড এর সাথে সংঘর্ষ হওয়ার চান্স ৫০%।
নিউট্রিনোর অস্ত্বিত্ব>
পরমাণুর ক্ষুদ্রতম একক হচ্ছে ইলেকট্রন এবং প্রোটন। কিন্তু uranium & plutonium থেকে স্বতস্ফুর্ত ভাবে ইলেক্ট্রন নির্গত হয়। কিন্তু এই ঘটনা শক্তির সংরক্ষণশীলতার পরিপন্থী ।
কেননা ভারী মৌল থেকে ইলেক্ট্রন নির্গত হওয়ার আগে এবং পরে মোট শক্তির পরিবর্তন এক থাকে না। অর্থাৎ কিছু শক্তি হারিয়ে যায়।
তখন বিজ্ঞানী ওল্ফগ্যাং ধারণা করেন যে ভারী মৌল থেকে ইলেক্ট্রন ছাড়াও আরেক ধরণের পার্টিক্যাল নির্গত হয় যেটা ডিটেক্ট করা সম্ভব নয়।
এবং এই পার্টিক্যাল ই হারিয়ে যাওয়া শক্তির বাহক।
এখন এটা অজানা নয় যে ভারী মৌল থেকে ইলেক্ট্রন নির্গত হওয়ার ঘটনাটি হচ্ছে রেডিও এক্টিভিটি।
যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ Bita minus decay > যেখানে পরমাণুর নিউক্লিয়াসে থাকা নিউট্রন প্রোটনে রূপান্তর হয়ে এন্টিনিউট্রিনো এবং ইলেক্ট্রন নির্গত করে।
নিউট্রিনো ডিটেক্ট করার সর্বোত্তম পন্থা হচ্ছে পারমানবিক বোমা কারণ এখানেই সবচেয়ে বেশি পরিমান পরমাণু ভাঙে।
এই শর্তে তাহলে সূর্য থেকেও নিউট্রিনো পাওয়া যাবে কেননা সেখানে পরমাণুর ভাঙনের উলটো ঘটনা ঘটে। অর্থাৎ ছোট ছোট পরমাণু একত্রিত হয়ে বড় পরমানু গঠন করবে।
নিউট্রিনোর প্রকার ভেদ
1.ইলেক্ট্রন নিউট্রিনো
2.মিউন নিউট্রিনো
3. টাও নিউট্রিনো
নিউট্রিনো সৃষ্টির সময় একধরনের ফ্লেভার নিয়ে সৃষ্টি হয় এবং সময়ের কালচক্রে সেটা পরিবর্তন হয় যাকে বলা হয় নিউট্রিনো অসিলেশান
standard model of elementary particles অনুযায়ী নিউট্রিনো হবে ভরহীন, কিন্তু নিউট্রিনো যদি ভরহীন হয় তবে নিউট্রিনোর অসিলেশান সম্ভব না। কেননা ভরহীন বস্তু আলোর বেগে গতিশীল এবং সেক্ষেত্রে সময় স্থির হয়ে যাবে এবং সময় স্থির হয়ে গেলে বস্তুর অসিলেশান অসম্ভব। কিন্তু নিউট্রিনো পৃথিবীর বায়ুমন্ডল এ প্রবেশ করার পর ফ্লেভার চেঞ্জ করতে থাকে। সুতরাং নিউট্রিনোর ভর বিদ্যমান।
কিন্তু এই স্ট্যান্ডার্ড মডেল এখনো ব্যাখ্যা করতে পারছে না যে কেন নিউট্রিনো তে ভর রয়েছে
চতুর্থ নিউট্রিনো....
ফার্মি ল্যাব এর গবেষণায় দেখা যায় যে মাত্র ৫০০ মিটার দূরত্বে ডিটেক্টর স্থাপন করে নিওন টাইপ নিউট্রিনো নিক্ষেপ করলে স্বাভাবিক এর চেয়ে বেশি পরিমাণ ইলেকট্রন টাইপ নিউট্রিনো পাওয়া যায়।
যেটা থিওরিতে প্রেডিক্ট করা সময়ের চেয়ে কম সময়ে অসিলাশান ঘটছে।
এর ফলে বিজ্ঞানদের ধারনা করাটাই স্বাভাবিক যে হয়তবা চতুর্থ কোন নিউট্রিনো রয়েছে এবং এর নাম দেওয়া হয় স্টেরল নিউট্রিনো।
এই স্টেরল নিউট্রিনো অতিমাত্রায় নিষ্ক্রিয় অর্থাৎ কোন ম্যাটার এর সংস্পর্শে আসে না। হয়ত এই নিউট্রিনো ডিটেক্ট করা অসম্ভব কিন্তু এদের উপস্থিতি বুঝা সম্ভব।
এই নিউট্রিনো হতে পারে স্ট্যান্ডার্ড মডেল এর মিসিং পার্টিকেল এবং এটা আবিষ্কৃত হলে ডার্ক এনার্জির দুয়ার উন্মোচিত হতে পারে।
নিউট্রিনো কণা সম্পর্কে সর্বপ্রথম ধারণা পোষণ করেন বিজ্ঞানী "ওল্ফগ্যাং পাউলি".... বিজ্ঞানীরা যখন খেয়াল করে দেখলেন যে ভারী মৌল থেকে ইলেক্ট্রন নির্গত হওয়ার ঘটনা শক্তির সংরক্ষণশীলতা নীতি তে মেনে চলে না তখন বিজ্ঞানী ওল্ফগ্যাং ধারণা করেন যে এই কণা গুলো থেকে এমন এক অদৃশ্য শক্তি বেরিয়ে যাচ্ছে যেটা ডিটেক্ট করা সম্ভব নয়।
তখন এই বিষয়টি নিয়ে কেও মাতামাতি না করলেও কিছু বিজ্ঞানী এই ধারণা নিয়ে গবেষণা চালিয়ে জান। তাদের মধ্যে বিজ্ঞানী [এনরিকো ফার্মি] অন্যতম। তিনি চার্জবিহীন পার্টিকেল এর সন্ধ্যান করতে থাকেন যা কিনা ইলেক্ট্রন থেকে ক্ষুদ্রতর এবং চলাচলের সময় কোন পরমাণুর সংঘর্ষ এড়িয়ে চলে। তিনিই সর্বপ্রথম এই পার্টিকেল এর নাম দেন নিউট্রিনো। পরমাণু ভাঙনের ফলে নিউট্রিনো নির্গত হয়। তাহলে নিউট্রিনো খুজে পাওয়ার সর্বোত্তম পন্থা হচ্ছে পারমানবিক বিস্ফোরণ। ১৯৫১ সালে বিজ্ঞানী "ফ্রেডরিক রাইন্স "এবং ক্লাইড "লরেইন ক্যায়োন "এই পারমানবিক বিস্ফোরণ থেকে নিউট্রিনো ডিটেক্ট করার পরিকল্পনা করে একটি মডেল তৈরী করেন।
মডেল অনুযায়ী নিউট্রিনো ডিটেক্টর টি বিষ্ফোরণ এর স্থানে বসানো হবে এবং এটি মাটি থেকে ১৫০ ফিট গভীরে থাকবে।
যদিও এমন পরিক্ষা বাস্তবসম্মত নয়। তাই তারা অন্য কোন উপায়ে নিউট্রিনো ডিটেক্ট করার উপায় খুজতে থাকেন, এবং তারা চিন্তা করতে থাকেন পরমাণুর নিউক্লিয়াস থেকে যেমন ইলেক্ট্রন এবং নিউট্রিনো নির্গত হয় ঠিক তার উলটো ঘটনা অর্থাৎ নিউট্রিনো যদি নিউক্লিয়াস এর সাথে সংঘর্ষ করে তাহলে নিউক্লিয়াস থেকে পজিট্রন এবং নিউট্রন নির্গত হবে। যদি এই দুটি কণা কে স্বতন্ত্র কোন তরল এর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত করা যায় তাহলে পরপর দুটি লাইট ফ্ল্যাশ দেখা যাবে। এইভাবে নিউট্রিনোর উপস্থিতি নির্ণয় করা সম্ভব।
বিষয়টি এমন,,, এন্টিনউট্রিনো প্রোটন এর সাথে যুক্ত হয়ে নিউট্রন এবং পজিট্রন উৎপাদন করবে...
Anti-neutrino + proton → neutron + positron
এবং এই দুইটি উৎপাদ এর ফলে আলাদা করে দুটি লাইটফ্লাশ দেখা যাবে।
এই ত্বত্ত্ব অনুসারে বিজ্ঞানী রাইন্স এবং ক্যায়োন একটি ট্যাঙ্ক আকারের ডিটেক্টর তৈরী করেন যেটা তরল দিয়ে পরিপূর্ণ ছিলো যার চারলাশে ছিলো লাইট সেন্সর। ডিটেক্টর টি একটি পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে স্থাপন করা হয়।
স্থাপন করার 5 বছর পড় অর্থাৎ ১৯৫৬ সালে তারা প্রথম নিউট্রিনো ডিটেক্ট করতে সক্ষম হন।
এই আবিষ্কারের ৪০ বছর পর রাইন্স কে নোবেল পুরষ্কার দেওয়া হয়। কিন্তু কোয়্যান মৃত্যুবরণ করেন ততদিনে। ( নোবেল শুধু জীবিত মানুষদের ই দেওয়া হয়)
এর পর নিউট্রিনো নিয়ে মানুষের আগ্রহ বেড়ে যায় এবং মানুষ ব্যাপক গবেষণা চালাতে থাকেন। সূর্য থেকেও নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়ার মাধ্যমে নিউট্রিনো নির্গত হয় ফলে সূর্য সম্পর্কে অনেক কিছুই জানা সম্ভব এই নিউট্রিনো কে ব্যাবহার করে।
এই উদ্দ্যেশে বিজ্ঞানী "রেয়মন্ড ডেভিস" ১৯৬৫ সালে একটি খণির নিচে ডিটেক্টর স্থাপন করেন যাতে কসমিক রশ্মি এর কারণে এর ফলাফল প্রভাবিত না হয়। ডেভিস বিশাল আকৃতির ট্যাঙ্ক তৈরি করেন যেটাকে C2Cl4 (টেট্রাক্লোরোমিথেন) দ্বারা পূর্ণ করা হয়।
সূর্য থেকে আসা নিউট্রিনো যদি কোন ক্লোরিন পরমাণুর এর সাথে বিক্রিয়া করে তাহলে ক্লোরিন এর অই পরমাণুটি রেডিওএক্টিভ আর্গন এ রূপান্তরিত হবে। এর ফলে নিউট্রিনো ডিটেক্ট করা সম্ভব হবে।
বিজ্ঞানীরা হিসাব করে দেখেন প্রতি মিনিটে প্রায় কয়েক মিলিয়ন ট্রিলিয়ন নিউট্রিনো এই ট্যাঙ্ক এর মধ্যে থাকা ক্লোরিন এর মধ্য দিয়ে অতিক্রম করবে কিন্তু বিক্রিয়া করার সম্ভাবনা খুবই কম।
বিজ্ঞানী ডেভিস ধারণা করেছিলেম হয়ত সপ্তাহে ১০ টি এই বিক্রিয়া সংঘটিত হবে। কিন্তু মাত্র 3 ভাগের 1 ভাগ নিউট্রিনো ডিটেক্ট হচ্ছিলো যেটা নতুন এক সমস্যার সৃষ্টি করে যেটাকে বলা হয় সোলার নিউট্রিনো প্রব্লেম (solar neutrino problem)....
পরবর্তীতে বিজ্ঞানী 'ব্রুনো পন্টিকভো' ১৯৭০ সালে ধারণা করেন যে নিউট্রিনো 3 ধরণের হতে পারে। তিনি নিউট্রিনোর ফ্লেভার চেঞ্জ এর ধারণাও প্রতিষ্ঠিত করেন যেটাকে নিউট্রিনো অসিলেশান বলা হয়।
যেখানে নিউট্রিনো সময়ের সাথে সাথে 3 টি আকার ধারন করে।
কিন্তু এটা যদি সঠিক হয় তাহলে রে ডেভিস এর ডিটেক্টর কেন সম্পূর্ণ নিউট্রিনো ডিটেক্ট করতে পারছে না তার ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব। তবে এক্ষেত্রে নতুন সমস্যার সৃষ্টি হয়।
"Standard model of elementary particles " অনুযায়ী নিউট্রিনো হবে ভরহীন। নিউট্রিনো যদি ভরহীন হয় তবে তা আলোর বেগে গতিশীল হবে। এবং আলোর বেগে গতিশীল থাকার ফলে তার জন্য সময় স্থির হয়ে যাবে। যদি সময় স্থির হয়ে যায় তবে নিউট্রিনোর অসিলেশান ঘটাও সম্ভব না। এর ফলস্বরুপ standard model এবং রে ডেভিস এর প্রাপ্ত ফলাফল পূর্নতা লাভ করে না।
কিন্তু রে ডেভিস তার গবেষণা চালিয়ে যেতে থাকেন
১৯৯০ সালে জাপানে একটি অত্যাধুনিক নিউট্রিনো ডিটেক্টর স্থাপন করা হয় যার নাম দেওয়া হয়
#'Super kamio kande' এটি মাটির নিচে স্থাপন করা তাতে ১১ হাজার লাইট বালব লাগানো হয়। লাইট বালব গুলো সাধারণ নিয়মের ব্যাতিক্রম। এই বালব গুলো আলো শোষণ করার মাধ্যমে ইলেক্ট্রিক সিগনাল তৈরি করে।
লাইট বালব এর পাশাপাশি এতে ৫০ হাজার টন ১০০% বিশুদ্ধ পানি ব্যাবহার করা হয়েছে।
নিউট্রিনো যখন পানির সাথে ইন্টারেক্ট করে তখন এতে আলোর সৃষ্টি হয় এবং সেই আলো লাইট বালব গুলো শোষন করে নিউট্রিনোর গতিপথ এবং প্রকৃতি নির্ণয় করে।
এই ডিটেক্টর আগের সকল অমীমাংসিত প্রশ্নের জবাব দেয়। নিউট্রিনো পৃথিবীর বায়মন্ডলে প্রবেশের সাথে সাথে ফ্লেভার চেঞ্জ করতে থাকে সুতরাং নিউট্রিনো ভরহীন নয়। এতে ভর রয়েছে কিন্তু সেটা খুবই সামান্য।
এই নিউট্রিনো অসিলেশাল এর কারণেই রে ডেভিস এর ডিটেক্টর এ বাকি 2 ভাগ নিউট্রিনো ডিটেক্ট করা সম্ভব হয় নি। কারণ রে ডেভিস এর ডিটেক্টর মাত্র ১ টাইপ নিউট্রিনো ডিটেক্ট করতে সক্ষম ছিল। যেটা ছিল ইলেক্ট্রন নিউট্রিনো।
রে ডেভিস তার কাজের জন্য ২০০২ সালে নোভেল পান। এবং ব্রুনো পন্টিকভো ততদিনে মৃত্যুবরণ করেন।
লিখেছেনঃ Abid Hasan Abir