পৃথিবী ও অন্য যেকোনো বস্তুর মধ্যে যে আকর্ষণ তাই অবিকর্ষ। অর্থাৎ অভিকর্ষ হলো এমন একটি শক্তি বা বল যার মাধ্যমে পৃথিবী তার কেন্দ্রাভিমুখে সকল বস্তুকে আকর্ষণ করে। বিশেষত এটি পৃথিবীর পৃষ্ঠের কাছাকাছি জিনিসগুলিকে প্রভাবিত করে।…
১৯১৬ সালে মহাকর্ষ তরঙ্গের বিষয়টি প্রথম আলোচনায় আসে। বিষয়টা এসেছে আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব থেকে। বিশেষ করে আইনস্টাইনের মহাকর্ষ বিষয়ক ক্ষেত্রতত্ত্ব থেকে। সূর্য থেকে পৃথিবীতে আলো আসতে সময় লাগে ৮ মিনিট ৫২ সেকেন্ড। এখন ধরা, যাক একটা বড়সড় নক্ষত্র এসে সূর্যের গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। ফলে প্রচ- একটা বিস্ফোরণ ঘটে সেদুটো একসাথে জোড়া লেগে গেল। সেই দৃশ্য দেখব আমরা ৮ মিনিট ৫২ সেকেন্ড পরে। যেহেতু দুটো নক্ষত্র এসাথে জোড়া লেগেছে। তাই তাদের মিলিত ভরও বেড়ে গেছে। এর সংতরাং মহাকর্ষ বলের হেরফের হবে। সূর্যের ভর বেড়ে যাওয়অর কারণে পৃথিবীর প্রতি সূর্যের টানও বেড়ে যাবে। নতুন সূর্য পৃথিবীকে আরও কাছে টেনে নেবে। বদলে যাবে পৃথিভীর কক্ষপথ। কিন্তু মহকর্ষ টান বৃদ্ধির এই ঘটনা কতক্ষণ পর আমরা বুঝব। নিউটনের সূত্রানুযায়ী সেটা তাৎক্ষণিক হবার কথা। অর্থাৎ যখনই সংঘর্ষ ঘটছে তখনই পৃথিবীর তা টের পেয়ে যাবে। এটাই আসলে নিউটনের মহাকর্ষ সূত্রের প্রধান ঘাপলা। মানলাম, তাৎক্ষণিক ঘটনা, কিন্তু সেই খবর কে বয়ে আনবে। আইনস্টাইন বললেন সেই খবর বয়ে আনবে মহাকর্ষ তরঙ্গ।
আইনস্টাই তাঁর স্পেশাল থিয়োরি অব রিলেটিভিটিতে প্রমাণ করেছেন কোনও কিছুর বেগ আলোর বেগের বেশি হতে পারে না। তুড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ আর আলো যেহেতু একই জিনিস, তাই এদের সবার বেগ সমান। তাহলে মহাকর্ষ তরঙ্গের বেগই বা আলোর বেগের সমান হয় কী করে। আইনস্টাইন সে হিসাবও বের করলেন। তিনি বললেন, মহাকর্ষ তরঙ্গের ধর্ম অনেকটা তড়িচ্চুম্বকীয় ধর্মের মতো। তাই মহাকর্ষ তরঙ্গও ছোটে আলোর গতিতে। সুতরাং মহকর্ষ বলের প্রভাব তাৎক্ষণিক হতে পারে না। সূর্য আর অন্য একটা নক্ষত্রের সংঘর্ষের ফলে মহাকর্ষ বলের য়ে রদবদল ঘটবে তা বুঝতে পৃথিবীর সময় লাগবে ৮ মিনিট ৫২ সেকেন্ড।
যে বস্তু যত বেশি ভারী, সে তার চারপাশের স্থান-কাল জ্যামিতিকে দুমড়ে দেয় তত বেশি। আইনস্টাইনের এই ব্যাখ্যা থেকে সিদ্ধান্তে আসা যায়, পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে সূর্যের টানের জন্য নয়, সূর্যের উপস্থিতিতে তার চারপাশের জায়গা দুমড়ে যায় বলে। ওই দোমড়ানো জায়গার মধ্য দিয়ে চলতে গিয়ে পৃথিবীর পথ ক্রমশ একটু-একটু করে বেঁকে যায়। এটাই বক্র জ্যামিতির খেলা। বস্তু ছুটলে অথবা তার ভর বদলালে, চারপাশের স্থান-কালের দোমড়ানোর হেরফের হয়।
জেনারেল থিয়োরি অব রিলেটিভিটি বলে, ওই হেরফেরের প্রভাব বা সংকেত চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
কীভাবে?
তরঙ্গাকারে।
ছুটন্ত ইলেকট্রিক চার্জ যেমন বিদ্যুচ্চুুম্বকীয় তরঙ্গ হিসেবে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে, এক্ষেত্রেও অনেকটা একই রকম ঘটনা ঘটে।
অতএব বিদ্যুচ্চুুম্বকীয় প্রভাব স্থান-কালের মধ্যে তরঙ্গাকারে ছোটে। কিন্তু বস্তু ছুটলে বা ভরের পরিবর্তন হলে, এর যে প্রভাব চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে, তা স্থান-কালের নিজেরই তরঙ্গ। আর এই তরঙ্গই হলো মহাকর্ষীয় তরঙ্গ। নক্ষত্রের বিস্ফোরণ, দুটো নক্ষত্রের মধ্যে সংঘর্ষ কিংবা পরস্পরকে ঘিরে দুটো তারা বা দুটো ব্ল্যাকহোলের ঘূর্ণন–গুলোর সব থেকেই মহাশূন্যে মহাকর্ষ তরঙ্গ ছড়ায়। দুটো ভারী নক্ষত্র বা ব্ল্যাকহোল ঘুরতে-ঘুরতে ক্রমশ কাছাকাছি এলে তাদের মাঝখানের স্থান-কালের দোমড়ানো ভাবটা খুব দ্রুত বদলাতে থাকে। ফলে বেশ শক্তিশালী মহাকর্ষ তরঙ্গ চারদিকে ছড়ায়। এ বিষয়ে আইনস্টাইন কী বলেছিলেন সেটাই আগে দেখা যাক। তিনি বলেছিলেন, ‘দুটো ভারী বস্তু (নক্ষত্র বা ব্ল্যাকহোল) ঘুরতে-ঘুরতে ক্রমেই পরস্পরের কাছাকাছি চলে এলে তাদের মাঝখানের দোমড়ানো ভাবটা খুব দ্রুত বদলাতে থাকে। এর ফলে, চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে খুব শক্তিশালী মহাকর্ষ তরঙ্গ।’
আর যেখানে কোনও ভর নেই, সেখানে তাহলে কী থাকে?
অনেকবার বলা হয়েছে ভারী বস্তু স্থানকালকে বাঁকিয়ে দেয়। স্থাননকালকে একটা চাদর ধরে নিই। ধরা যাক, তার ওপর বসে আছে বিলিয়ন বিলিয়ন ভারী বস্তু। নক্ষত্র, গ্রহ, উপগ্রহ, শ্বেত বামন, লোহিত দানব, নিউটন স্টার, পালসার, কোয়েসার, ব্ল্যাকহোল ইত্যাদি। এরা সবাই আবার কোনও না কোনও গ্যালাক্সির অংশ। মহাকাশে মিলিয়ন মিলিয়ন গ্যালাক্সি রয়েছে। আর এরা সবাই বসে আছে স্থানকালের ওই চাদরের ওপারে। যেখানে যেখানে মহাজাগতিক ভারী বস্তুগুলো বসে আছে সেখানে সেখানে স্থানকাল বিকৃত হয়ে গেছে।
ধরা যাক, মহাবিশ্বের সব ভারি বস্তুগুলো স্থির। তাহলে স্থানকালের চাদরের বক্রতা বজায় থাকবে ঠিকই, কিন্তু বক্রতার হের ফের হবে না। তবে আসল কথা হলো ভারী কেনো বস্তুই স্থিতিশীল নয়। গ্রহগুলো ঘুরছে নক্ষত্রের চারপাশে, নক্ষত্রগুলো ঘুরছে গ্যালাক্সির কেন্দ্রকে কেন্দ্র করে। গ্যালাক্সির কেন্দ্রে থাকে বিশাল আকারের ব্ল্যাকহোল। এছাড়া প্রতিনিয়ত নতুন নতুন নক্ষত্রের জন্ম হচ্ছে। মৃত্যু ঘটছে কতশত নক্ষত্রের। মৃতপ্রায় নক্ষত্রদের কেউ কেউ সুপারনোভা বিস্ফোরণের মাধ্যমে পরিণত হচ্ছে শ্বেত বামনে। কেউ কেউ আমার লোহিত দানব হয়ে পড়ে থাকছে। ভারী নক্ষত্রগুলো আবার মরে গিয়ে ভয়ঙ্কর ব্ল্যাকহোলে পরিণত হচ্ছে। সুতরাং স্থানকালকে চুপটি করে ভালোমানুষের মতো বসে থাকার জো নেই। এসব ঘটনা স্থানকালের বুকে কম্পন তোলে।
বিষয়টা আরেকটু খোলসা করা দরকার। আবার আমারা ফিরে যাই একটা চার খুঁটির মাথায় টান টান করে বাঁধা চাদরের কাছে। চাদরের ওপর একটা ভারি লোহার গোলক রাখা হয়েছে। ফলে চাদরটা ঝুলে যাবে নিচের দিকে। অথ্যাৎ চাদরের ওপর বক্রতা তৈরি হবে। এখন গোলকটা যদি সাম্যন্য সরে যায়। তাহলে চাদরের বক্রতাটাও সরে যাবে গোলকের সাথে। আগের বক্র জায়গাটা আবার টানটান হয়ে যাবে। এখন গোলকটা চাদরের ওপর গড়িয়ে দেওয়া যাক। ধরি, ঘর্ষণজনিত কোনও বল গোলকটা ওপর ক্রিয়া করছে না। ক্রিয়া করছে মহাকর্ষ বলও। তাই নিউটনের সূত্রানুসারে চাদরটা একই গতিতে গড়িয়ে চলবে। একেক্ষেত্রে চাদরের বক্রতাও গোলকের সাথে সাথে এগিয়ে যাবে। শুধু বক্রতাই এগিয়ে যাবে, চাদরে সেভাবে কেনও আলোড়ন উঠবে না। সুতরাং সুষম গতিতে চলমান কোনও বস্তু চাদরের ওপর ঢেউ তুলতে পারে না। কিন্তু গোলকের গতি যদি ত্বরিত গতি হয়। অর্থাৎ গোলকটির গতি যদি প্রতি মুহূর্তে বাড়ে তাহলে চাদর আলোড়িত হবে। ঢেউ উঠবে চাদরের পৃষ্ঠতলে।
এখন যদি চাদরের বদলে আমরা স্থানকালকে ধরি। আর গোলকের বদলে যদি গ্রহ-নক্ষত্র-উপগ্রহসহ নানা মহাজাগতিক ভারী বস্তু। এসব ভারী বস্তুগুলো যদি সুষম গতিতে চলত তাহলে স্থানকালের চাদরে কোনো ঢেউ উঠত না। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ভারী বস্তুগুলো সর্বদা গতিশীল। তবে সোজাপথে নয়। চলছে ঘুর্ণন গতিতে। ঘূর্ণন বেগ কিন্তু সুষম বেগ নয়। বেগ ভেক্টর রাশি। তাই তার দিক পরিবর্তন হলে বেগের মানেরও পরিবর্তন হয়। আর বেগের মান পরিবর্তন মানে সে আর সুষম বেগ থাকে না। তখন সেই বস্তুর বেগ হয় ত্বরিত। তাদের ত্বরণের ফলে ঢেউ ওঠে স্থানকালের চারমাত্রিক চাদরে। সেই ঢেউই হলো মহাকর্ষ তরঙ্গ।
তড়ি”ুচম্বকীয় তরঙ্গ চলে চলে স্থানকালের ভেতর দিয়ে। কিন্তু স্থানকালের ওপর সে কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। মহাকর্ষ তরঙ্গ স্থানকালে ঢেউ তুলে এগিয়ে চলে। অর্থাৎ স্থানকালের সংকোচন প্রসারণ ঘটে।
ম্যাক্সওয়েলে ফিরে যাই আবার। কোনো চার্জযুক্ত কণা সুষম বেগে চললে তখন কোনো তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ বিকিরণ করে না। কিন্ত যদি সেই কণা ত্বরিত হয় কিংবা প্রতি মুহূর্তে দিক বদলায়, তখন তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ বিকিরণ করে।
তড়িচ্চুম্বকী তরঙ্গ বিকিরণ করার ফলে চার্জিত কণা কিছুটা শক্তি হারায়। তারমানে চড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ উৎপন্ন হতে শক্তির দরকার হয়। সেই শক্তি বহন করেই তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ সামনের দিকে এগিয়ে চলে। এখন কথা হচ্ছে চার্জিত এই কণাগুলো সেই শক্তি কোথায় পায়?
পদর্থবিজ্ঞানে একটা নীতি আছে। শক্তির সংরক্ষণশীলতার নীতি। এই নীতি অনুযায়ী, মহাবিশ্বের মোট শক্তি সব সময় একই থাকে। কখনও তিল পরিমাণ বাড়েও না কমেও না। শক্তি ধ্বংস হয় না, নতুন কোনো শক্তি উৎপন্নও হয় না। শুধু এক অবস্থা থেকে আরেক অবস্থায় রূপান্তরিত হয় মাত্র। এই মোট শক্তি মহাবিশ্বে ছড়িয়ে আছে নানা রূপে, স্থিতিশক্তি, গতিশক্তি, যান্ত্রিক শক্তি, তাপশক্তি, তড়িচ্চুম্বকীয় শক্তি, ডার্ক এনার্জি রূপে। এছাড়া শক্তির আরেকটা রূপ আছে। সেটা হলো বস্তুর ভর। আইনস্টাইন তাঁর সমীকরণে প্রমাণ করেছে বস্তুর ভরকেও শক্তিতে রূপন্তরিত করা যায়। এই সবগুলো শক্তির যে কোনো একটিকে বিশেষ কিছু নিয়মে আরেকটি শক্তিতে রূপান্তর করা যায়।
পরমাণুর ভেতর একটা ইলেক্ট্রন নিউক্লিয়াসের চারপাশে ঘোরে। বিশেষ বিশেষ অবস্থায় ইলেকট্রন শক্তি বিকিরণ করে। সেই শক্তি আমরা দেখি তড়িচ্চুম্বকীয় শক্তিরূপে। ইলেক্ট্রন এই শক্তির যোগন পায় তার গতিশক্তি থেকে। তড়িচ্চুম্বকীয় শক্তি বিকিরণের পর ইলেক্ট্রনের গতিশক্তি কিছুটা কমে যায়। ফলে তার কক্ষপথের হেরফের হয়। ইলেকট্্রন তখন উচ্চশক্তি স্থর থেকে লাফ দিয়ে নিম্ন শক্তিস্তরে নেমে আসে।
তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গের মতো মহাকর্ষ তরঙ্গও শক্তি বহন করে। তবে সেই শক্তি তড়িচ্চুম্বকীয় শক্তির চেয়ে কোটি কোটি গুণ দুর্বল।
একটা বৃহৎ ভরের বস্তু যখন আরেকটা বৃহৎ বস্তুর চারপাশে ঘোরে তখন তারা মহাকর্ষ তরঙ্গ বিকিরণ করে। বিকিরিত সেই তরঙ্গের শক্তি বস্তুদুটির ভর ও তাদের মধ্যবর্তী দূরত্বের ওপর নির্ভর করে। বস্তুদুটির ভর যত বেশি হবে তাদের বিকিরিত মহাকর্ষ তরঙ্গের শক্তি তত বেশি হবে। তাদের মধ্যে দূরত্ব যত বেশি, তরঙ্গের শক্তিও তত কম। বহুদিন আগেই জ্যোর্তিবিজ্ঞানীরা মহাকাশের বহুদূরের বস্তুর দূরত্ব, আয়তন, ভর, ঘূর্ণন বেগ, তাপমাত্রা ইত্যাদি পরিমাপের উপায় বের করেছেন। সেগুলো কী কী প্রকিয়ায় তার আলোচনা এই বইয়ে বাহুল্য মাত্র। তাই ওদিকে আর গেলাম না।
আমাদের পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘুরছে, সূর্য মিল্কিওয়ের কেন্দ্রে থাকা ব্ল্যাকহোলকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। এর ফলেও তৈরি হচ্ছে মহাকর্ষ তরঙ্গ। কিন্তু মহাকর্ষ তরঙ্গ অত্যন্ত দুর্বল প্রকৃতির। তাই পৃথিবী বা সূর্যের ঘূর্ণনের কারণে যে মহাকর্ষ তরঙ্গ তৈরি হচ্ছে তা শণাক্ত করা অসম্ভব। এমনকি বড় বড় সব ডিটেক্টরেও ধরা পড়ে না। তাই বিজ্ঞানীরা অপেক্ষা করেন বড় কোনও ঘটনার জন্য। বড় দুটি ব্ল্যাকহোলের সংঘর্ষ ধুন্ধুমার কা- ঘটে। তার ফলে যে মহাকর্ষ তরঙ্গের জন্ম হয়, তা নির্ণয় করা যেতে পারে। সেই কাজটিই বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি করেছেন।
পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘুরছে। এর ফলে বিকিরিত হচ্ছে মহাকর্ষ তরঙ্গ। সেই তরঙ্গ যে শক্তি বহন করে তার শক্তিও খুব সামান্য। সারা বছরে মাত্র ২০০ ওয়াট। এ দিয়ে দুটো বৈদ্যুতিক বাল্ব জ্বালানো যেতে পারে।
এখন কথা হচ্ছে, মহাকর্ষ তরঙ্গ বিকিরণের এই শক্তির যোগান কে দিচ্ছে?
পৃথিবীর কৌণিক গতিশক্তি থেকে কিছুটা শক্তি মহাকর্ষ তরঙ্গাকারে বেরিয়ে আসে। ফলে পৃথিবীর কক্ষপথ ছোট হয়ে যাচ্ছে প্রতিবছর। তারমানে কক্ষপথের ব্যাসার্ধ কমছে। ফলে প্রতিবছর একটু একটু করে পৃথিবী সূর্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
একথা শুনে অনেকে হয়তো আঁৎকে উঠেছেন। ভাবছেন তাহলে মহকর্ষ তরঙ্গ বিকিরণের কারণেই কি এদিন পৃথিবী সূর্যের ওপর গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়বে? জ্বলে পুড়ে ছাই! কী দরকার ছিল বাপু এমন সর্বনাশা তরঙ্গ আবিষ্কার করার?
ভয় নেই। হিসাবটা শুনলে আপনার আতঙ্ক বাপ বাপ করে পালাবে। মহকর্ষ তরঙ্গ বিকিরণের কারণে প্রতিবছর পৃথিবীর ব্যাসার্ধ কতটুকু কমছে জানেন? শুনলে চোখ ছানাবড়া হয়ে যাবে। বছরে মাত্র ০.০৩ ন্যানোমিটার! একটা পরমাণুর ব্যাসের ৩০০ ভাগের একভাগ মাত্র! পৃথিবীর কক্ষপথের ব্যাসার্ধ এই হারে কমতে থাকলে মাত্র পৃথিবী সূর্যের গায়ে আছড়ে পড়তে সময় লাগবে ১,০০,০০,০০,০০,০০,০০,০০,০০,০০,০০,০০০ বছর।
সূর্য ততদিন বাঁচবে?
সূর্যের ভেতর যে জ্বালানি আছে তা দিয়ে টেনেটুনে ৫০০ কোটি বছর চলতে পারবে। তারপর সে লোহিত দানব বা রেড জায়ান্টে পরিণত হয়ে ধুঁকতে থাকবে। তার আগে সূর্যের আকার এতটাই বেড়ে যাবে পৃথিবীসহ প্রায় গোটা সৌরজগতটাই গিলে নেবে। অথাৎ সূর্য যে পৃথিবীকে গিলে খাবে তার দোষ মহাকর্ষ তরঙ্গের ঘাড়ে কোনোমতেই চাপানো যায় না।
এতক্ষণ মহকর্ষ তরঙ্গ নিয়েই বকে যাচ্ছি। কিন্তু এই তরঙ্গ কেমন সেটাই তো বলা হয়নি। মহাকর্ষ তরঙ্গ কেমন সেটা জানার আগে জেনে নেওয়া যাক তরঙ্গ আসলে কী?
তরঙ্গ মানে ঢেউ। কম্পন। সমুদ্রের পানিতে বাতাস এসে ধ্বাক্কা মারে। ফলে তৈরি হয় ঢেউ। ছোট-বড় হরেক রকমের ঢেউ। কখনো কখনো আবার ঢেউয়ের আকার পৌঁছে যায় বিশাল বিশাল অট্টালিকার সমান।
পুকুরের পানি এমনিতে শান্ত। হঠাৎ তারওপর একটা ঢিল ছোড়া হলো। তাহলে পানিতে ঢেউ তৈরি হবে। এই ঢেউ হলো পানির তরঙ্গ।
কেন এই ঢেউ তৈরি হয়?
পানিতে যেখানে ঢিলটা পড়ে সেখানকার পানির অনুগুলোতে সেই ঢিল আঘাত করে। অণুগুলোর ভেতর কম্পন তৈরি হয়। কাঁপতে কাঁপতে সেই অণুগুলো তাদের পাশের অণুগুলোর গায়ে ধ্বাক্কা মারে। পাশের অণুগুলো তখন কাঁপতে শুরু করে। তারা আবার তাদের আশপাশের অণুগুলোকে ধাক্কা মারে। সেগুলো আবার ধাক্কা মারে তাদের চারপাশের অণুগুলোকে। এভাবে কম্পন ছড়িয়ে পড়ে পকুর জুড়ে।
শব্দ কিন্তু এক ধরনের তরঙ্গ। কোনো কোনো বস্তু আরেকটা বস্তুতে আঘাত করলে শব্দ হয়। আসলে দুটি বস্তুতে সংঘর্ষের ফলে কেঁপে ওঠে সেগুলোর আশপাশের বায়ুম-ল। সেই কম্পন শব্দ তরঙ্গাকারে ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে।
আলোও একধরনের তরঙ্গ। তবে একটু ভিন্ন প্রকৃতির। অন্যসব তরঙ্গের ছড়িয়ে পড়তে মাধ্যমের দরকার হয়। যেমন শব্দ নিকে কোনও বস্তু বা বস্তুকণা নয়। শুধুই শক্তি। সেই শক্তি বায়ুম-লের অণুগুলোতে আঘাত করতে করতে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। আলো একই সাথে শক্তি আবার ভরহীন কণা। কণা বলে সে নিজেই কাঁপতে পারে। বাতাস তো আর কণা নয়। সে অন্য কণাকে কাঁপাতে পারে নিজের শক্তি দিয়ে। অন্যদিকে আলো নিজের শক্তি দিয়ে নিজের ভরহীন কণাগুলোকে কাঁপিয়ে দিতে পারে। তারপর কম্পন আর শক্তি বয়ে নিয়ে আলোর তখন ছড়িয়ে পড়ে দূর-দূরান্তে।
তাহলে মহাকর্ষ তরঙ্গ কী?
এ প্রশ্নের উত্তরে যাবার আগে সাধারণ কম্পন নিয়ে আরও দুয়েকটা কথা জেনে নেওয়া যাক। সাধারণ অর্থে তরঙ্গ দুই প্রকার। অনুদৈর্ঘ্য আর অনুপ্রস্থ তরঙ্গ।
একটা স্পিংয়ের কথা ভাবা যাক। স্প্রিংকে টানলে প্রসারিত হয়। টানা সিপ্রংকে আবার ছেড়ে দিলে সংকোচন ঘটে। বার বার স্প্রিং টেনে এবং ছেড়ে দিলে স্প্রিংয়ে কম্পনের সৃষ্টি হয়। এই কম্পন এগিয়ে যায় স্পিংয়ের সংকোচন প্রসারণ যেদিকে হয় সেদিকে। বাতাসের একটা চাপ আছে। এই চাপের কারণে বায়ুম-লে সংকোচান-প্রসারণ ঘটে। এই সংকোচন-প্রসারণের ভেতর দিয়েই চলতে হয় শব্দ তরঙ্গকে। এ ধরনের তরঙ্গকে অনুদৈর্ঘ তরঙ্গ বলে। এই তরঙ্গের বেগ সংকোচন-প্রসারণের দিকে হয়।
এই প্রবন্ধটি “মহাকর্ষ তরঙ্গ : শতবছরে সমাধান” বইটির অংশবিশেষ। বইটি ২০১৭ সালের বইমেলায় প্রকাশ করে অন্বেষা প্রকাশন
অনুপ্রস্থ তরঙ্গ অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গের চেয়ে আলাদা। একটা দড়ি নিয়ে পরীক্ষা করা যেতে পারে। ধরা যাক, দড়িটা বাঁধা আছে একটা খুঁটির সাথে। দড়ির খোলা প্রান্ত ধরে ঝাঁকুনি দিলে দড়িতে ঢেউ সৃষ্টি হয়। দড়ির মাঝখানের অংশগুলো ওঠানামা করে। একবার তরঙ্গশীর্ষ ও একবার পাদবিন্দু তৈরি হবে। এক্ষেত্রে কম্পনের বেগ কিন্তু সোজা দড়ির দৈর্ঘ্য বরাবর। অর্থাৎ দড়ির ওঠানামার দিক ও কম্পনের বেগ পরস্পরের লম্ব। এ ধরনের তরঙ্গকে অনুপ্রস্থ তরঙ্গ বলে।
মহাকর্ষ তরঙ্গ কিন্তু একেবারে ভিন্নধর্মী তরঙ্গ। একে অনুদৈর্ঘ্যও বলা চলে না। আবার অনুপ্রস্থও নয়। একে কোয়াড্রুপাল তরঙ্গ বলে। সাধারণ অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গকে দ্বিমাত্রিক তলে আঁকা যায়। কিন্তু মহাকর্ষ তরঙ্গের ছবি দ্বিমাত্রিক নয়। এই তরঙ্গেরও সংকোচন প্রসারণ ঘটছে। তবে সেটা একই সাথে প্রস্থে এবং উচ্চতায়।
তরঙ্গ মানেই সে ছুটে চলবে। মহাকর্ষ তরঙ্গ যেদিকে ছুটবে সেদিকে স্পেস প্রসারিত হবে। যেমনটা হয় পানির তরঙ্গে। তবে পানির তরঙ্গের সাথে মহাকর্ষ তরঙ্গের বিস্তর পার্থক্য। তরঙ্গের প্রবাহের ফলে স্পেস ওপর-নিচে প্রসারিত হবে। পরক্ষণেই ঘটবে উল্টো ব্যাপার। তখন স্পেস সংকুচিত হবে। ওপর নিচে যখন স্পেস সংকুচিত হবে তখন প্রস্থে অর্থাৎ ডানে বায়ে স্পেস প্রাসারিত হবে।
আবার স্পেস যখন ওপর-নিচে প্রাসারিত হবে তখন স্পেস ডানে-বাঁয়ে সংকুচিত হবে। এ বিষয় থেকে একটা ব্যাপার নিশ্চিত স্পেসের সংকোচন ও প্রসারণ পরস্পরের লম্ব বরাবর ঘটে। স্পেসের যখন ওপর নিচে প্রসারণ হয় তখন তার সংকোচন হয় লম্বদিকে। অর্থাৎ ডানে-বাঁয়ে।
পশ্চিমবঙ্গের দৈনিক আনন্দবাজারের বিজ্ঞানবিষয়ক সম্পাদক পথিকগুহ তাঁর ‘ইশ্বরকণা মানুষ ইত্যাদি’ বইয়ে মহাকর্ষ তরঙ্গের ফলে স্পেসটাইমের সংকোচন-প্রসারণ বোঝাতে ছোট্ট তিনটি চিত্র এঁকেছিলেন। আমরাও সেরকম কিছু করতে পারি। তার আগে আরেকটা বিষয় নিশ্চিত করত হবে। মহাকর্ষ তরঙ্গ স্পেস টাইমে ঢেউ তোলে। ফলে স্পেসটাইমের সংকোচন-প্রসারণ হয়। মহাবিশ্বের বস্তুগুলোর তখন কী দশা হয়? পৃথিবী, সুর্য অন্যান্য গ্রহ, উপগ্রহ, নক্ষত্র, বামনগ্রহ, ধূমকেতু এসব বস্তুগুলোর কী অবস্থা হয় তখন? আপনার সামনে যে বইটি রয়েছে সেটার ওপরেই বা মহাকর্ষ তরঙ্গ কী প্রভাব ফেলে।
স্থানকালের সংকোচান প্রসারণের প্রভাব অবশ্যই বস্তুর ওপর পড়বে। যে সেটা পৃথিবী, সূর্য কিংবা কোনও মহাজাগতিক বস্তুই হোক আর আপনার কম্পিউটারের এই ওয়েব পজটিই হোক।
ওপরে একটা বাঘের ছবি রয়েছে। বাঘটা দাঁড়িয়ে আছে। ছবিটা স্বাভাবিক অবস্থার। ধরা যাক, খুব শক্তিশালী একটা মহাকর্ষ তরঙ্গ বয়ে গেল স্পেসটাইমের ওপর দিয়ে। কোনো এক মুহূর্তে তরঙ্গটির একটি কম্পন ভেদ করে গেল বাংলামেই এই পেজটিকে। তখন এই পেজটি ওপর-নিচ বরাবর প্রসারিত হবে। আর প্রস্থ বরাবর সংকুচিত হবে। এর ফলে বাঘের ছবিটা উচ্চতা বরাবর লম্বা হয়ে যাবে। এবং সামনে-পেছনে সংকুচিত হবে। ঠিক নিচের ছবিটার মতো।
এর ঠিক পরের মুহূর্তে যে কম্পনটা আসবে সেই মুহূর্তে বইয়ের বাঘটা ওপর নিচ-বরাবর সংকুচিত হবে। এবং ডানে-বাঁয়ে প্রসারিত হবে। নিচের ছবির দিকে লক্ষ্য করুন।
ফেসবুকের পাতা দ্বিমাত্রিক কোনোভাবেই চারমাত্রিক স্পেসটাইমের সাথে একে মেলানো যাবে না। তবে ত্রিমাত্রিক বাঘটা যেহেতু এই দ্বিমাত্রিক তলে আঁকতে পেরেছি, সুতরাং কিছুটা হলেও সংকোচন প্রসারণের বিষয়টা বোঝা উচিৎ।
আরেকটা কথা বলে নিই, পৃথিবীতে বসে এত শক্তিশালী মহাকর্ষ তরঙ্গও পাবেন না যে বইয়ের এই ছোট্ট একটা বাঘকে এতটা সংকোচন-প্রসারণ ঘটাবে। অবশ্য ব্ল্যাকহোল খুব শক্তিশালী মহাকর্ষ তরঙ্গ ছড়ায়। কিন্তু ব্ল্যাকহোল থেকে পৃথিবী এতদূরে যে, এতটা পথ পাড়ি দিতে গিয়ে তরঙ্গ অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ে।