মানুষ স্মোকিং কেনো করে?
শান্তির জন্য খায়। এবং অশান্তি থেকে পালাবার জন্য খায়। এই দুটো জিনিসই মানুষকে দেয় নিকোটিন। যারা নিকোটিনে আসক্ত নন, তাঁরা নিকোটিনে শান্তি মিলবে সেই আশায় সিগারেট খান। আর যাঁরা নিকোটিনে আসক্ত তাঁরা সিগারেট খান অশান্তি থেকে বাঁচার জন্য। মস্তিস্কে নির্দিষ্ট মাত্রায় নিকোটিন না থাকলে তাঁদের অশান্তি লাগে। সেই অশান্তি নাছোড়বান্দা অশান্তি। অদৃশ্য-নীরব সেই অশান্তির মতো অশান্তি আর কোনো মাদকে হয়না।
নিকোটিনের প্রতি আসক্তি কেনো আসে?
শরীরের সব কার্জকর্ম নানান সংকেতের মাধ্যমে হয়, সে তো আপনারা জানেনই। তেঁতুল দেখলে আপনার জিভে জল আসে কেন? তেঁতুল দর্শনের অনুভূতি প্রক্রিয়াজাত করে আপনার মস্তিস্ক জিহ্বার লালাগ্রন্থিগুলোকে খুঁচিয়ে রাগিয়ে দেয় বলেই জিভে জল আসে। কিন্তু মস্তিস্ক কি আর হাতে ধরে লালাগ্রন্থিকে খোঁচাতে পারে? পারে না। খোঁচাখুঁচির জন্য মস্তিস্কের রয়েছে খোঁচানো রাসায়নিক। খোঁচাখুঁচি করার মস্তিস্কের এসব রাসায়নিককে বলে নিউরোট্রান্সমিটার। নিকোটিন মস্তিস্কে অ্যাসিটাইলকোলিন নামের এক নিউরোট্রান্সমিটার ছাড়তে অনুপ্রাণিত করে। খটোমট নামের এই কচুটার কাজ হচ্ছে আপনার মস্তিস্ক এবং শরীরকে উত্তেজিত করা। কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য সতর্ক করা। পরীক্ষার আগের মুহূর্তে বইয়ের পাতা ওল্টানোর যে সতর্ক ব্যস্ততা সেইরকমের সতর্কতা। পাগলা কুকুরে তাড়া করলে দৌড়াবার যে উত্তেজনা, সেইরকমের উত্তেজনা।
ধূমপায়ীরা এজন্য সিগারেট খেলে সতেজ এবং "এনার্জেটিক' বোধ করেন। জটিল চিন্তায় মনোনিবেশ করা সহজ হয়ে যায় সিগারেটে একটা টান দিলেই। এইসব অনুভূতি যে ভালো লাগার অনুভূতি তাতে সন্দেহ নেই। সাধারণত ধূমপায়ীরা সিগারেট খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই ভালো লাগার অনুভূতিকে মিলিয়ে নেন। একটা সময় পর, তাঁরা অচেতন ভাবেই নিকোটিন গ্রহন করে ভালো থাকতে শুরু করেন। সিগারেট নিয়ে ম্যাচ হাতে বারান্দায় দাঁড়িয়েই মনে হতে থাকে, বেশ ভালো লাগছে। যদিও তখনো নিকোটিন মস্তিস্কে প্রবেশ করেনি। কিন্তু ধূমপায়ীর মস্তিস্ক হচ্ছে এমন। ভালো থাকার অনুভূতির সঙ্গে সিগারেটকে সে মিলিয়ে নিয়েছে। মস্তিস্কে নিকোটিনের পরিমাণ কম হলেই তখন তার "খারাপ থাকা'র অনুভূতি শুরু হয়।
নিকোটিনের সঙ্গে ভালো থাকার অনুভূতির সংযোগটাকে শক্ত করে ডোপামিন নামের আরেক নিউরোট্রান্সমিটার। এই ব্যাটা হচ্ছে সুখানুভূতির যোগানদার। ডোপামিনের বাংলা নাম হচ্ছে লোভ। যেখানেই লোভ সেখানেই ডোপামিন। বায়োলজিস্টরা এইখানে আমার কথা খানিকটা তেরছা হয়েছে বলে কাঁইকুঁই করতে পারেন। কিন্তু আমরা তো কোনো সাতেপাঁচে নেই, তাই আমাদের খানিকটা তেরছা করে বিজ্ঞান বুঝলেই চলে।
স্মোকিং এর এত ভালো দিক রয়েছে।তাহলে কি এনার্জেটিক থাকার জন্য ,ভালোভাবে কাজ করার জন্য,চিল করার জন্য,মনোযোগ বৃদ্ধি করার জন্য স্মোকিং করবেন?
সেটা নিচের লিখাগুলো পড়ে নিজ দায়িত্বে বুঝে নিন।
সিগারেটের মূল আশক্তি নিকোটিনে। কিন্তু নিকোটিন নেয়ার জন্য আমরা তামাক পুড়িয়ে ধোঁয়া গ্রহন করি ফুসফুসে। সিগারেটের ধোঁয়াতে থাকে অন্তত ৭ হাজার (সাত হাজার) [ঠিকই বলছি, অন্তত ৭ হাজার] রকমের রাসায়নিক। মজার বিষয় হচ্ছে এই সাত হাজার রাসায়নিকের বেশিরভাগই মানুষের শরীরে (কোষে) কীরকমের প্রভাব ফেলতে পারে তা আমাদের জানা নেই। সুনির্দিষ্ট গবেষণা করে সেসব বের করার সুযোগ খুবই কম। কিন্তু সব যে আমাদের অজানা তা নয়। আমরা জানি এই সাত হাজার রাসায়নিকের মধ্যে অন্ততপক্ষে ৬০ টি হচ্ছে কারসিনোজেন। এর বেশিও হতে পারে, আমাদের জানা নেই। কিন্তু অন্তত ৬০টি কারসিনোজেন যে আছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
কারসিনোজেন হচ্ছে সেই জিনিস যা ক্যান্সারের কারণ। ক্যান্সার মানে তো আমরা জানিই। কোষের বৃদ্ধিতে যখন আর নিয়ন্ত্রণ থাকেনা তখন সেটা ক্যান্সার কোষ। কোষের নিয়ন্ত্রণ নষ্ট হওয়ার কারণের হিসেব এই লেখাতে আমরা না করি। একটা গাড়িকে যতো উপায়ে নষ্ট করা যায় তারচে বেশি উপায়ে কোষের চরিত্র নষ্ট করা যায়। কারসিনোজেন হচ্ছে কোষের চরিত্র নষ্ট করার উপাদান। একজন ধূমপায়ী যখন ফুসফুসে তামাকের ধোঁয়া গ্রহন করেন তখন অন্তত ৬০ টি কারসিনোজেন তাঁর ফুসফুসের অগণিত কোষের সংস্পর্শে আসে। কেউ যদি একশোটা ঢিল নিয়ে একটি দেয়ালের গায়ে ছুঁড়ে মারে তাহলে সর্বোচ্চ সেই দেয়ালের একশোটা ইট ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে। কিন্তু কেউ যদি ঘরের ভেতর আগুন জ্বালিয়ে ধোঁয়া তৈরি করে তাহলে সেই ধোঁয়া ওই ঘরের দেয়ালের কোন ইটটির সংস্পর্শে আসবে না?
প্রতিটান সিগারেটের ধোঁয়ার সঙ্গে অন্তত ৬০টি রাসায়নিক গিয়ে ফুসফুসের কোষগুলোকে ক্যান্সার কোষ বানাতে চেষ্টা করে। এবং তারা নিয়মিতই সফল হয়। জ্বি হ্যাঁ, ঘটনা সত্যি। কিন্তু মানুষের শরীরে রয়েছে শক্ত রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা। শরীরের রোগপ্রতিরোধী কোষেরা যে কেবল বহিরাগত রোগজীবাণু মেরে নিকেশ করে তা নয়। তারা শরীরের বিগড়ে যাওয়া কোষগুলোকেও মেরে শেষ করে। ধূমপায়ীর শরীরে প্রতিনিয়ত তৈরি হওয়া ক্যান্সার কোষেরা সেজন্য বাঁচতে পারেনা। তাদেরকে মেরে ফেলে শরীরের রোগপ্রতিরোধী কোষেরা। (আয়রনি হচ্ছে, ধূমপানের ফলে শরীরের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থাও দূর্বল হয়ে যায়।) কিন্তু হারজিতের এই খেলা অনন্তকাল চলেনা। সেরকম যদি হতো তাহলে এই পৃথিবীর মানুষেদের কখনো ক্যান্সার হতনা। সব ক্যান্সার কোষকে শরীরের রোগপ্রতিরোধী কোষেরা মারতে পারেনা। কেউ কেউ টিকে যায়। আর অনন্তকাল ধরে বাড়তে থাকে। তখন হয় সত্যিকারের ক্যান্সার। প্রতিদিন একঘন্টা পরপর আপনাকে একলক্ষ গুলি করা হলে আপনি কতটা গুলি এড়িয়ে যেতে পারবেন? কতকাল ধরে কতটাগুলি এড়িয়ে যেতে পারবেন? সেজন্য ধূমপান করলে যে ফুসফুসে ক্যান্সার হবে সেটা অবাস্তব কিছু নয়, ক্যান্সার না হলেই বরং সেটা অবাক করার মতো বিষয়!
আমেরিকায় প্রতি ১০টি ক্যান্সারের ৩টির কারণ ধূমপান। হয়তো আরো বেশি। আমাদের জানা নেই। সারাপৃথিবীতে এই সংখ্যা আরো বেশি। তৃতীয়বিশ্বের মানুষেরা ভোগেন সবচে বেশি ক্যান্সার ঝুঁকিতে। কিন্তু ক্যান্সার প্রসঙ্গই শেষ নয়। ক্যান্সার প্রসঙ্গ এমনকি শুরুও নয়। ধূমপানের ফলে আর যা যা হতে পারে তাতে ক্যান্সার না হলেও কিছু এসেযেত না!
৭০০০ রাসায়নিকের ৬০টির হিসেব করছিলাম আমরা। যে ৬০টা সম্পর্কে আমরা নিশ্চিত যে সেগুলো ক্যান্সারের কারণ। বাকি ৬ হাজার ৯শ ৪০টি রাসায়নিক কী করে শরীরে গিয়ে?
আমরা তো সব জানিনা। কিছু কিছু জানি। সায়ানাইড, এমোনিয়া, এসিটাইলিন, মিথানল, বেনজিন, ফরমালডিহাইড এইসব রাসায়নিকগুলোর নাম তো আমরা সবাই জানি তাইনা? এইসব নিয়ে অনেক বর্ণনা করার সময় নেই। আমরা আমাদের মূল প্রসঙ্গে আসব। এইখানে কেবল জানিয়ে রাখি যে, এইসব রাসায়নিক যেকোন একটি দিয়ে মানুষ মেরে ফেলা যায়। অন্তত সায়ানাইড বিষটি তো সাহিত্য-নাটক-সিনেমার তারকা!
ধূমপানের কারণে কী কী হতে পারে সেসব তো আমরা জানিই। আমি দুইলাইনে আবার বলব:
প্রথম লাইন: ধূমপানের কারণে অন্তত ১০ রকমের ক্যান্সার হয়।
দ্বিতীয় লাইন: ধূমপানের কারণে আরো অন্তত ১০ রকমের রোগ হয় যা ক্যান্সারের মত মারাত্মক।
বোনাস লাইন: এইগুলো সম্ভাবণার কথা নয়, কিছু না কিছু হবেই।
সমস্যা হচ্ছে, কেউ ধূমপানের ফলে ক্ষতিকার কিছু চোখের সামনে দুম করে ঘটতে দেখেন না। কিন্তু বৈজ্ঞানিক সত্য মেনে না নিলেই সে মিথ্যে হয়ে যায়না। ধূমপায়ীরা প্রত্যেকেই তাঁদের জীবনে সরাসরি ধূমপানের কুফল ভোগ করেন। সেই কুফল খুব সহজ এবং স্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু বেশিরভাগেই জানেন না যে তাদের স্বাস্থ্যগত সমস্যাগুলি ধূমপানের ফলে হচ্ছে। রসায়নের নিয়মগুলো খুব সহজ এবং বাস্তব। একটি কোষের উপর একটি রাসায়নিক প্রয়োগ করলেই সেই কোষটি ওই রসায়নিকের প্রেক্ষিতে আচরণ করে। একটি কোষের উপর ৭ হাজার রাসায়নিক প্রয়োগ করলে কী হবে?
এই মুহুর্তে ধূমপায়ীদের যাঁরা এই লেখাটি পড়ছেন তারা অনেকেই একটা বিশেষ অনুভূতিতে আছেন। একটা অস্থিরতার অনুভূতি, অস্বস্তির অনুভূতি। শেষ একটা সিগারেট না খেতে পারার আতঙ্কের অনুভূতি। সিগারেট নিয়ে এতগুলো কথা পড়ার ফলে, এতবার সিগারেট শব্দটা পড়ার ফলে তৈরি হওয়া এক অদ্ভুত অনুভূতি। ডোপামিনের অভাবের অনুভূতি। খানিকটা বেশি ডোপামিন না থাকার অনুভূতি! মজার বিষয় হচ্ছে এই সকল সমস্যাই আর মাত্র একটি সিগারেট খেয়ে উপশম হয়ে যাবে। সিগারেটের প্রথম কয়েকটি টান দেয়ার পরেই সব অস্বস্তির শেষ হয়ে যাবে। তখন মনে হবে, সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দেয়া যেতে পারে। ছেড়ে দেয়াই ভালো। তখন আপনি জানবেন এই সিগারেটটিই আপনার শেষ সিগারেট। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে শেষ সিগারেটটিতে। শেষ সিগারেটটি না খেয়ে থাকা অসম্ভব একটি কাজ।
বৈজ্ঞানিকভাবে, মানুষের মস্তিস্কের পুরষ্কার পাওয়ার অনুভূতি তৈরি করতে পারে এমন সকল কিছুই আসক্তি। পুরষ্কার পাওয়ার অনুভূতি তৈরি করে ডোপামিন। ডোপামিন আপনার মধ্যে সেই অনুভূতি তৈরি করে যা বারবার পাওয়ার জন্য আপনার আকাঙ্খা তৈরি হবে। হতেই হবে। মানুষ হিসেবের বাইরের কোনো প্রাণি নয়। মানুষের এমনকি প্রেম-ভালোবাসা-স্নেহ-মমতার অলৌকিক বাংলসিনেমা সব অনুভূতিরও সহজ বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা রয়েছে।