কুড়ির দশকের মার্কিন বিমান বাহিনীর ক্যাপ্টেন অ্যাডওয়ার্ড মারফির নাম শুনেছেন? না শুনলেও অবশ্য কিছু ক্ষতি নেই। মারফি নামক এই ভদ্রলোকের সঙ্গে প্রতিদিনই আপনার দেখা হয়। দেখা হয় বলার চেয়ে সংষ্পর্শে আসা হয় বলাটাই ভালো। যখন আপনি ঘরের তালায় তাড়াহুড়োয় ভুল চাবি প্রবেশ করান কিংবা বাসের জন্য অপেক্ষা করেন তখন এই মারফি সাহেব আপনার দিকে চেয়ে মুচকি মুচকি হাসেন।
ঘটনার শুরু ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে। আমেরিকার মিউরোক ফিল্ড এয়ার বেস-এ উড়োজাহাজ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। সেই প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত ছিলেন একজন ডাক্তার আর আমাদের মারফি সাহেব। একদিন সহকারীর ভুলে রাগ আর ক্ষোভে এডওয়ার্ড মারফি মন্তব্য করেছিলেন যে, যা কিছু ভুল করা যায়- ওই সহকারীটি তা করবেই। ব্যস। প্রকল্পের ম্যানেজার এডওয়ার্ড মারফির এই মন্তব্যকে 'মারফি'স ল' নাম দিয়ে নথিভুক্ত করে রাখলেন।
কি বলে এই মারফির সূত্র? এক কথায় বলতে গেলে- 'If anything can go wrong, it will'। অর্থাৎ যেখানে ভুলের সম্ভাবনা আছে, সেখানে ভুল হবেই। সোজা বাংলাটি হয়ত অধিক পরিচিত- যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে রাত্রি হয়। কিছু উদাহরণ দিলে হয়তো ব্যাপারটা আরো পরিষ্কার হবে-
ধরুন, বারান্দার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে বাইরে ফেলে দেয়ার জন্য কিছু ছুঁড়ে মারলেন। ওটি গ্রিলের লোহার গায়ে লেগে গেল ফিরে এলো। আরো কয়েকবার চেষ্টা করলেও দেখবেন অধিকাংশ সময় ফলাফল একই। আবার আপনার বাচ্চাটি টেনিস বল নিয়ে ঐ বারান্দায় খেলছিলো, দেখবেন মেঝেতে ড্রপ খেয়ে বলটি একবারেই গ্রিলের জানালা গলে নিচে পড়ে গেছে।
পুরনো প্যান্ট পড়ছেন অনেকদিন। বেশ চলছিলো। একদিন শখ করে একটা নতুন প্যান্ট কিনে আনলেন। সেই প্যান্ট পড়ে প্রথমদিনেই বাড়ি ফিরে দেখলেন যে বাসের সিটের সাথে লেগে ছিঁড়ে গেছে আপনার সাধের প্যান্টটা।
একটা ড্রয়ারের চাবি সারাদিন এখানে-ওখানে পড়ে থাকে। একবার দরকার হলেই দেখবেন চাবিটা আর খুঁজে পাচ্ছেন না। সারা বাড়ি তন্ন তন্ন করেও পাবেন না- যেন উধাও হয়ে গেছে।
খুব সাধারন কিছু কথাতে মারফি'স ল কিছু অসাধারণ কথা বলে। যেমন-
# কোনো কাজ অতি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হতে দেখলে নিশ্চিত থাকুন, কোথাও কোনো গড়মিল অবশ্যই ঘটছে যা এখনো আপনি খেয়াল করেননি। অর্থাৎ যদি সবকিছুই পরিপাটি মনে হয়, তাহলে ইতোমধ্যে ভুল যা হবার তা হয়ে বসে আছে।
# আজ হাসুন, আগামীকালটা আরো খারাপ হতে পারে।
# খুব দুঃখেও ভেঙ্গে পড়বেন না, চরম শোচনীয় অবস্থা এখনো আসেনি।
# প্রতিটি সমাধান থেকেই নতুন সমস্যার উদ্ভব হয়।
# কোনো কিছুই এতো সহজ নয় তা দেখে যতোখানি সহজ মনে হয়।
# যে কোনো কাজ শেষ করতে অনুমানের চেয়ে বেশি সময় লাগে।
# পাউরুটি কোন্‌ অংশে মাখন মাখবেন তা কখনোই আগে-ভাগে স্থির করতে পারবেন না। কার্পেট যতো দামি হবে, ব্রেডের বাটার মাখানো অংশটি ঐ কার্পেটের ওপর পতিত হবার সম্ভাবনা ততো বেশি।
# একটি পতনশীল বস্তু সর্বদাই এমন জায়গায় পতিত হবে যেখান থেকে সবচাইতে বেশি ক্ষতিসাধন সম্ভব।
# কোথাও পৌঁছাতে আপনার দেরি হয়ে যাচ্ছে, দেখবেন আপনি যতো দ্রুত পৌঁছতে চাইছেন রাস্তায় জ্যামের পরিমাণও ততো বেড়ে যাচ্ছে।
# পাড়ার মাঠে ক্রিকেট খেললে দেখবেন দুর্দান্ত ব্যাটিং করছেন। আর যখন আপনার খেলা দেখিয়ে কোনো সুন্দরীকে মুগ্ধ করতে চাইছেন- প্রথম বলেই বোল্ড হয়ে গেছেন।
এরকম আরো নানা মজার ব্যাপার আছে মারফির সূত্রতে। মারফির সূত্রের সাথে নিয়তিবাদের কিছুটা মিল আছে। তবে বৈজ্ঞানিকভাবেও তা ফেলনা নয়। কারণ থার্মোডায়ানামিক্সের ২য় সূত্র জগতের এনট্রপি বৃদ্ধির কথা বলে। অর্থাৎ জগতে বিশৃঙ্খলা বাড়তে থাকবে, সেইদিক বিবেচনায় এই সূত্র সঠিক। আমরা যত সাবধানেই কাজ করি না কেন, তাতে কিছু ভুল ঘটনা ঘটবেই।
শেষ করা যাক মারফির মৃত্যুর ঘটনা দিয়ে। কথিত আছে যে, গাড়ির পেট্রোল ফুরিয়ে যাওয়ায় তিনি সাদা পোশাক পরে সন্ধ্যার অন্ধকারে রাস্তার ডান দিকে দাঁড়িয়েছিলেন তখন এক ব্রিটিশ ট্যুরিস্ট উল্টো দিক থেকে গাড়ি চালিয়ে এসে তাঁকে ধাক্কা মারে। কারণ ব্রিটেনে বাঁ দিকে ঘেঁষে গাড়ি চালানো সঠিক। কিন্তু আমেরিকায় তা ভুল- সেখানে ডান দিক ঘেষে চলে গাড়ি। আর সেদিন চালকের সেই ভুল সংঘটিত হওয়ার ফলেই ভুলের সূত্রের জনক মারফির মৃত্যু হয়।