হাইপারলুপ হলো যাত্রী কিংবা মালামাল পরিবহনের জন্যে পরিকল্পিত এবং প্রস্তাবিত একটি পদ্ধতি। ইলন মাস্কের মালিকানাধীন দুটি প্রতিষ্ঠান ‘টেসলা’ এবং ‘স্পেসএক্স’-এর যৌথ উদ্যোগে প্রস্তাবিত একটি ‘ওপেন-সোর্স ভ্যাকট্রেন’-এর নকশাকে বর্ণনা করতে গিয়ে শব্দটি প্রথম বার ব্যবহৃত হয়। ‘ভ্যাকট্রেন’ এর পূর্ণরূপ হলো ‘ভ্যাকুয়াম টিউব ট্রেন’। বায়ুশূন্য টিউব বা টানেলের মধ্য দিয়ে চৌম্বকীয় শক্তির সাহায্যে উচ্চ গতিসম্পন্ন ট্রেনকেই ‘ভ্যাকট্রেন’ বলা হয়।
হাইপারলুপ মূলত একধরনের ভ্যাকট্রেন। হাইপারলুপ প্রযুক্তিতে নিম্ন বায়ুচাপ বিশিষ্ট একধরনের আবদ্ধ নল বা টিউবের সমন্বয়ে তৈরি সিস্টেমের মধ্য দিয়ে চলাচল করা যাবে। যাত্রীরা একধরনের পডের সাহায্যে হাইপারলুপ সিস্টেমে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাতায়াত করতে পারবেন। বায়ুচাপ কম থাকায় টানেলের মধ্য দিয়ে যাত্রী বা মালবাহী এসব পড কোনো ধরনের বাধা বা ঘর্ষণ ছাড়াই চলাচল করতে পারবে।
বিমানের সমান গতি বা হাইপারসনিক গতিতে মানুষ বা মালামাল পরিবহন করতে পারবে হাইপারলুপ প্রযুক্তি। জ্বালানীর দিক দিয়ে চিন্তা করলে প্রযুক্তিটি বর্তমানে ব্যবহৃত উচ্চ গতিসম্পন্ন রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার চাইতেও সাশ্রয়ী হবে। প্রযুক্তিটি যদি সত্যিই বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে এটি একটানা ১৫০০ কিলোমিটার বা ৯৩০ মাইল অনায়াসে পাড়ি দিতে পারবে। এই পরিমাণ দূরত্ব পাড়ি দিতে ট্রেন এবং এয়ারপ্লেনের তুলনায় হাইপারলুপে ভ্রমণের সময়ও অনেক কম লাগবে।
হাইপারলুপ মূলত একটি রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা। এর পরিকল্পনা করা হয়েছে ১৯৭২ সালে প্রস্তাবিত ভেরি হাই-স্পিড ট্রানজিট (ভিএইচএসটি) সিস্টেমের ওপর ভিত্তি করে। সিস্টেমটিতে ম্যাগনেটিক লেভিটেশন বা ম্যাগলেভ ট্রেনের সাথে লো প্রেশার ট্রানজিট টিউবের সমন্বয় নিয়ে পরিকল্পনা করা হয়েছিল। ভিএইচএসটি-র মূল পরিকল্পনাকে আরো সম্প্রসারিত করে হাইপারলুপের নকশা প্রস্তাব করা হলেও এতে ভিএইচএসটি-র মতই টানেল এবং পড অথবা ক্যাপসুল ব্যবহার করে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াতের কথা বলা হচ্ছে।
হাইপারলুপের মাধ্যমে কত বেশি গতিতে ভ্রমণ করা সম্ভব?
হাইপারলুপকে স্বল্প দূরত্বের বিমান যাত্রার বিকল্প হিসেবে কল্পনা করা হচ্ছে। এই সিস্টেমটি হবে বর্তমান রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা থেকে দ্রুতগামী এবং বিমান যাত্রার তুলনায় ঝামেলাহীন। তবে হাইপারলুপে সর্বোচ্চ গতিতে চলাচল করা সম্ভব নয়। কারণ এই প্রযুক্তিতে চলাচলের সময় বাঁক নেয়ার ক্ষেত্রে মাধ্যাকর্ষণ বল অনেক বেশি অনুভূত হয়। ফলে সর্বোচ্চ গতিতে যাত্রী বা মালামাল পরিবহন করাটা সমস্যাজনক হয়ে দাঁড়ায়। তাই হাইপারলুপে যাত্রার জন্যে ঘণ্টায় ৭০০ মাইল গতিকে আদর্শ ধরে নেয়া হয়েছে।
স্বল্প দূরত্বে ভ্রমণের ক্ষেত্রে যাত্রার শুরু বা শেষে যাত্রীদের ওপর ত্বরণের বৃদ্ধি এবং হ্রাসের প্রভাব যাতে না পড়ে, সেটাও বিবেচনায় রাখতে হয়। বর্তমানে এই প্রযুক্তি নির্মাণে একাধিক প্রকল্পের অধীনে কাজ চলছে। এর মধ্যে দু’টি প্রকল্প সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক:
ইলন মাস্কের হাইপারলুপ যেভাবে কাজ করে:
গতিশীল যেকোনো যানবাহনের ক্ষেত্রেই সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো ঘর্ষণ। পড বা ক্যাপসুলের পৃষ্ঠতলের পাশাপাশি যেই পরিবেশের মধ্য দিয়ে পড চলাচল করবে, তার ওপরেও প্রভাব ফেলবে এই ঘর্ষণ। প্রচলিত চাকার পরিবর্তে পড চলাচলের জন্যে হাইপারলুপে এয়ার বিয়ারিংস ব্যবহার করা হবে। এর ফলে পডগুলি বতাসে ভাসমান থাকবে। তাড়িৎ চুম্বকীয় প্রযুক্তির ম্যাগলেভ ট্রেনের মতো অনেকটা একই পদ্ধতিতে কাজ করবে হাইপারলুপ। সাধারণত ইলেকট্রোম্যাগনেটিক লেভিটেশন প্রযুক্তির কারণে ম্যাগলেভ ট্রেনের সাথে রেলপথের ঘর্ষণ হয় না। এভাবেই জাপানে প্রচলিত ঘণ্টায় ৫০০ কিলোমিটার গতিসম্পন্ন ম্যাগলেভ ট্রেনের মতো ট্রেনগুলি উচ্চ গতিতে চলতে পারে।
ইলন মাস্কের প্রকল্প ছাড়াও বর্তমানে 'ভার্জিন হাইপারলুপ ওয়ান' নামের একটি প্রকল্প চলমান রয়েছে। এই হাইপারলুপে ম্যাগলেভ ট্রেনের মতোই প্যাসিভ ম্যাগনেটিক লেভিটেশন প্রযুক্তি ব্যবহৃত হবে। অর্থাৎ যাত্রীবাহী ক্যাপসুলে ম্যাগনেট যুক্ত থাকবে, যা মূলত অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি ট্র্যাকের ওপরে চলাচল করবে। বর্তমানে ম্যাগলেভ প্রযুক্তি প্রয়োগের জন্য কপার কয়েল ট্র্যাকের প্রয়োজন হয়, যা বেশ ব্যয়সাধ্য। ইলন মাস্কের হাইপারলুপ লো প্রেশার টিউবের মাধ্যমে হাইপারলুপ প্রযুক্তিকে আরেক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে।
যেভাবে কাজ করবে ভার্জিন হাইপারলুপ ওয়ান:
ভার্জিন হাইপারলুপ ওয়ান লস অ্যাঞ্জেলসের একটি স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠান। পরিবহন ব্যবস্থাকে নতুন করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠানটি একটি হাইপারলুপ ট্রেন তৈরির চেষ্টা করছে। ভার্জিন হাইপারলুপ সিস্টেম তৈরি হবে মাটির নিচে অবস্থিত টানেলের মাধ্যমে। এটি সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে কাজ করে। ফলে চালকের ভুল বা আবহাওয়া বিপর্যয় সংক্রান্ত জটিলতার আশঙ্কা কম। পরিবেশবান্ধব এই প্রযুক্তিতে কার্বন নিঃসরণেরও কোনো সুযোগ নেই। এই প্রকল্পে লিনিয়ার ইলেক্ট্রিক মোটর, ম্যাগলেভ এবং ভ্যাকুয়াম পাম্পের মতো যেসব প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে, তার মধ্যে অনেকগুলিই বেশ কয়েক বছর ধরে প্রযুক্তি বিশ্বে প্রচলিত।
এই পরিবহন ব্যবস্থায় প্রথমে যাত্রী বা পণ্য হাইপারলুপ বাহনে তোলা হবে এবং লো প্রেশার টিউবে ইলেক্ট্রিক প্রোপালশনের মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে এর গতি বৃদ্ধি করা হয়। বাহনগুলি ট্র্যাকের ওপরে ম্যাগনেটিক লেভিটেশন ব্যবহার করে ভাসতে থাকে। 'ভার্জিন হাইপারলুপ ওয়ান' থেকে জানানো হয়েছে যে, হাইপারলুপে ভ্রমণ করার সময় যাত্রীদের মনে হবে তারা লিফট কিংবা যাত্রীবাহী প্লেনে অবস্থান করছেন।
তথ্যসূত্র : City Touch