ঈশ্বর কণাঃ
কোয়ান্টাম ক্ষেত্রতত্ত্ব বিভিন্ন মূলগত কণাদের মধ্যেকার মিথষ্ক্রিয়া ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করে। এই তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে রসায়নের পর্যায়সারণীর মত কণা পদার্থবিদ্যার জন্যও একটি মডেল তৈরি করা হয়েছে। একে ‘স্ট্যান্ডার্ড মডেল’ বলে।
এতে দেখা যাচ্ছে, ৪ প্রকার কণা রয়েছেঃ
কোয়ার্ক (৬ প্রকার),
লেপটন (৬ প্রকার),
গেজ বোসন [৪ প্রকার (যার মধ্যে গ্লুয়ন আবার ৮ রকমের হয় এবং W দুরকম হয়)] এবং স্কেলার বোসন (১ প্রকার)।
এর মধ্যে কোয়ার্ক ও লেপটন হল পদার্থকণা (বিজ্ঞানী এনরিকো ফার্মি-র নামানুসারে এদের বলে ‘ফার্মিয়ন’)। আমাদের জানা সমস্ত পদার্থ এই দুই প্রকার কণা দিয়ে তৈরি। এই কণারা ৩ টি মূলগত বল দ্বারা পরস্পরের মধ্যে মিথষ্ক্রিয়া করেঃ
তড়িৎচুম্বকীয়,
দুর্বল বল ও
সবল বল
গেজ বোসনগুলি হল মূলগত বলগুলির বাহক কণা বা শক্তিকণা (বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বোস-এর নামানুসারে এদের ‘বোসন’ বলে)। ফার্মিয়নরা গেজ বোসন বিনিময়ের মাধ্যমে পরস্পর মিথষ্ক্রিয়া করে।
বাকী রইল স্কেলার বোসন। স্কেলার বোসনও একধরণের বোসন তবে তার কাজ আলাদা। এটি অন্যান্য কণাকে ভর প্রদান করে। স্ট্যান্ডার্ড মডেল গড়ে তোলার সময় পদার্থবিজ্ঞানীদের মনে প্রশ্ন ছিল, সকল কণাকে ভর (mass) কে প্রদান করে? এর সমাধান হিসেবে পিটার হিগস (এবং আরও কয়েকজন সমসাময়িক বিজ্ঞানী স্বাধীনভাবে) ‘হিগস পদ্ধতি’ (Higgs Mechanism) আবিষ্কার করেন যাতে বলা হয়,সমগ্র মহাবিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে আছে একটি ক্ষেত্র। একটি কণা সেই ক্ষেত্রের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় ক্ষেত্রের সাথে মিথষ্ক্রিয়া করে ও ভরলাভ করে। ওই বিশেষ ক্ষেত্রকে বলা হয় ‘হিগস ক্ষেত্র’ ও ওই ক্ষেত্রের একটি কোয়ান্টা/কণাকে বলে ‘হিগস কণা’। এটি ধর্মের দিক দিয়ে একটি ‘বোসন’ তাই কণাটি হল ‘হিগস বোসন’।
কিছুকাল পর এই হিগস কণাকে নিয়ে সাধারণ মানুষের জন্য বই লিখলেন পদার্থবিদ লিও লেডারম্যান। বইয়ের নামঃ “God Particle: If the Universe is the answer, what is the question?”
“God particle” কেন? প্রথমে বিজ্ঞানী কিন্তু তার নাম “হিগস বোসন”-ই রেখেছিলেন। প্রকাশক ওইরকম খটোমটো নামে অরাজি। বেশ কয়েকবার নাম বদলানোর পরেও প্রকাশকের পছন্দ না হওয়ায় ক্ষেপে গিয়ে বিজ্ঞানী নাম দিয়ে বসলেন “Goddamn particle” অর্থাৎ “দূরছাই কণা”। প্রকাশক কি করলেন? “damn” টুকু বাদ দিয়ে সেটাকে করে দিলেন “God particle”। এইরকম নাম কি জনপ্রিয় না হয়ে যায়? সেই থেকে সাধারণ মানুষ ও গনমাধ্যমে স্ট্যান্ডার্ড মডেলের ভরপ্রদায়ী কণা হয়ে গেল “ঈশ্বরকণা”।
তবে বিজ্ঞানী লেডারম্যান তাঁর বইয়ে দুটি যুক্তি দিয়েছেন এর স্বপক্ষে।
এক, একে শনাক্ত করাটা ছিল এতটাই কঠিন, এত খরচ, এমন এলাহী আয়োজন, বিজ্ঞানীরা ৪-৫ দশক ধরে নাজেহাল যে তিনি সেটাকে বলেছিলেন “দূরছাই কণা”।
ফান্স-সুইজারল্যান্ড সীমান্তে অবস্থিত ২৭ কিলোমিটার পরিধির কণা-ত্বরকযন্ত্র LHC (Large Hadron Collider) যাতে খুঁজে পাওয়া গেছে ‘ঈশ্বরকণা’
LHC-র ভেতরের কিছু চিত্রঃ
দুই, বাইবেলের এক কাহিনী। সেই ব্যাবেল টাওয়ার নির্মাণের গল্প। মানুষ বানাচ্ছে স্বর্গের সমান উঁচু টাওয়ার। সবার ভাষা এক, খুব মিলমিশ। ঈশ্বর তাই দেখে ক্রুদ্ধ হয়ে নেমে এলেন মর্ত্যে। সবার ভাষা করে দিলেন আলাদা। চরম বিশৃঙ্খলা। কেউ বোঝেনা কারও কথা। তৈরি হলনা মিনার। এই কাহিনীর প্যারোডি করে বিজ্ঞানী লিখলেন নতুন কাহিনী। মানুষ বানাচ্ছে পেল্লায় মেশিন যাতে বিশৃঙ্খল কণা পদার্থবিদ্যায় শৃঙ্খলা আনা যায়। দেখে ঈশ্বরের করুণা হল। নেমে এলেন মর্ত্যে। মানুষের হাতে তুলে দিতে চাইলেন ‘ঈশ্বরকণা’ যাতে জটিলতার আবরণ সরিয়ে সে দেখতে পায় ঈশ্বরসৃষ্ট ব্রহ্মাণ্ড কত সুন্দর!
এইভাবেই সাধারণ মানুষের কাছে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল ‘ঈশ্বরকণা’ নাম। তবে বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞরা এই নাম সাধারণত ব্যবহার করেন না। বৈজ্ঞানিক আলোচনার সময় তো নয়ই। ‘হিগস বোসন’ বা সংক্ষেপে ‘হিগস’-ই ব্যবহার হয়।
হিগস বোসনে সত্যেন্দ্রনাথ বোস-এর নামের উপস্থিতিঃ
আমরা ওপরেই দেখলাম, সত্যেন্দ্রনাথ বোসের নাম শুধুমাত্র হিগসের সাথে জড়িয়ে নেই। তিনি হিগসের আবিষ্কারের সাথে জড়িতও ছিলেন না কোনভাবেই। চলুন দেখা যাক তিনি আসলে কী কাজ করেছিলেন।
কোয়ান্টাম মেকানিক্সে কণাজগতের একটি তন্ত্র (System) সম্পর্কে যা কিছু জানা সম্ভব তাকে যে গাণিতিক নিয়মে প্রকাশ করা হয় তাকে ‘কোয়ান্টাম স্টেট’ (আরও সূক্ষ্মভাবে বললে, কোয়ান্টাম স্টেট ভেক্টর’) বলে। [একই স্টেটকে নানাভাবে প্রকাশ করা যায় যাদের ‘Basis’ বা ‘Representation’ বলে। যেমন- Position basis, Momentum Basis, Energy basis ইত্যাদি।]
দেখা যায়, কোয়ান্টাম কণারা একটি কোয়ান্টাম স্টেটে দুইভাবে স্থানাধিকার করতে পারে। এর মধ্যে একটি ধরণ আবিষ্কার করেন পাউলি, ফার্মি ও ডিরাক। আরেকটি ধরণ আবিষ্কার করেন বোস ও আইনস্টাইন।
অধ্যাপক বোস একটি বণ্টন অপেক্ষক (Distribution function) তৈরি করেন যা বর্ণনা করে একটি নির্দিষ্ট পরম উষ্ণতায় বিভিন্ন শক্তিস্তরে (যা আসলে Energy basis এ represent করা বিভিন্ন কোয়ান্টাম স্টেট) কীভাবে ফোটনের মত কণাগুলি স্থান দখল করে। বোসের এই পদ্ধতি থেকে বিজ্ঞানী প্লাঙ্কের বিখ্যাত Distribution function (যা আলোর কণা ফোটনের জন্য প্রযোজ্য ও যার মাধ্যমে কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যার জন্ম) পাওয়া যায়। সুতরাং, বোসের অবদান ছিল কোয়ান্টাম কণাদের একটি জাতের জন্য একটি নতুন Distribution function যা প্ল্যাঙ্কের সূত্রে পৌঁছানোর একটি নতুন উপায় এবং আরও বেশী কিছু। আমরা জানি বিভিন্ন জার্নাল যখন বোসের কাজকে প্রত্যাখ্যান করছিল তখন আইনস্টাইন প্রথম তাকে মর্যাদা দেন ও কাজটিকে আরও এগিয়ে নিয়ে যান (উদাহরণ- Quantum theory of ideal gas)। এই কাজ ‘বোস-আইনস্টাইন সংখ্যায়ন’ বা শুধু ‘বোস সংখ্যায়ন’ (Bose Statistics) নামে পদার্থবিদ্যার জগতে পরিচিত। (স্টেট দখল করার আরেকটি ধরণ থেকে আসে ‘ফার্মি-ডিরাক সংখ্যায়ন’)
এখন, প্রকৃতিতে পাওয়া কণাগুলিকে দুটি ধরণে/জাতে ভাগ করা যায়ঃ
১) যারা ফার্মি-ডিরাক সংখ্যায়ন ও পাউলি অপবর্জন নীতি (Pauli Exclusion Principle) মেনে চলে এবং অর্ধ সংখ্যার স্পিন (১/২, ৩/২, ৫/২ ইত্যাদি) দেখায়। এদের ‘ফার্মিয়ন’ বলে।
২) যারা বোস-আইনস্টাইন সংখ্যায়ন মেনে চলে, পাউলি অপবর্জন নীতি মান্য করে না এবং শূন্য বা পূর্ণসংখ্যার স্পিন (০, ১, ২ ইত্যাদি) দেখায়। এদেরই ‘বোসন’ বলে।
মূলগত কণাদের মধ্যে ৬ ধরণের বোসন পাওয়া যায়ঃ
ফোটন (পাওয়া গেছে)
গ্লুয়ন (পাওয়া গেছে)
W (পাওয়া গেছে)
Z (পাওয়া গেছে)
হিগস/ঈশ্বরকণা (পাওয়া গেছে)
গ্র্যাভিটন (প্রকল্পিত, এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি)
বিভিন্ন বোসনগুলি বিভিন্ন সময় আলাদা আলাদা বিজ্ঞানী/গবেষক দল/সংগঠন আবিষ্কার করেছেন।
তাহলে দেখা গেল যে বোস যা করেছিলেন তা হল তিনি ‘বোসন’ নামক এক ধরণের কণা (A CLASS of particles) আবিষ্কার করেছিলেন, বা আরও সঠিকভাবে বললে, তিনি সেই নিয়মটি আবিষ্কার করেছিলেন যা দুই ধরণের কণার মধ্যে একটি ধরণের কণারা (যাদের ‘বোসন’ বলে) মেনে চলে। সেইজন্যই কণাদের ওই জাতটিকে ‘বোসন’ নাম দেওয়া হয়েছে। ওই জাতের নির্দিষ্ট একটি কণা (যেমন- W বা হিগস) আবিষ্কারের সাথে তিনি জড়িত ছিলেন না।
একজন বাঙালীর নাম যুক্ত হওয়াকে কীভাবে দেখিঃ
অবশ্যই ভাবতে ভালো লাগে। অনুপ্রেরণা হিসেবে দেখি। যেভাবে ব্রিটিশ আমলে স্বল্প পরিকাঠামোয় বা প্রতিকূল পরিবেশে তিনি (বা তাঁর মত অন্যান্যরা যেমন আচার্য জগদীশচন্দ্র বোস, আচার্য মেঘনাদ সাহা বা আচার্য অমলকুমার রায়চৌধুরী প্রমুখ) এত উচ্চমানের কাজ করেছিলেন তা বর্তমানের বিজ্ঞানপ্রেমী বা গবেষকদের কাছে সত্যিই প্রেরণা হতে পারে।
লিখেছেন তীর্থ চক্রবর্তী