আহসান আহমেদ সানি
পাকস্থলী মানব দেহে পরিপাকতন্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ যা অন্ননালী ও ক্ষুদ্রান্ত্রের মধ্যে অবস্থিত। এটি উদর গহবরের বাম পাশে উপর দিকে থাকে। খাদ্য পরিপাক প্রক্রিয়া প্রধানত পাকস্থলীতে শুরু হয়। বিশেষ করে আমিষ জাতীয় খাদ্যের পরিপাকে পাকস্থলীর ভূমিকা প্রধান। সাধারণত: শর্করা এবং স্নেহ জাতীয় খাদ্য পাকস্থলীতে পরিপাক হয় না।
অন্ননালী ও ডিওডেনাম এর মাঝখানে পাকস্থলী একটি থলির মতো অঙ্গ। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ২৫ সে.মি.। এটি উদরীয় গহ্বরের উপরের বাম দিকে থাকে। এর উপর প্রান্ত ডায়াফ্রামের বিপরীতে থাকে।পাকস্থলির পিছনে অগ্ন্যাশয় আছে। বৃহত্তর বক্রতা(greater curvature) থেকে বৃহত্তর ওমেন্টাম নামে। প্রাচীর পুরু ও পেশিবহুল। পাকস্থলিতে দুটি স্ফিংক্টার থেকে-অন্ননালী এবং পাইলরিক। পাকস্থলী পরাসিমপ্যাথেটিক ও অর্থোসিমপ্যাথেটিক প্লেক্সাস দিয়ে আবদ্ধ থাকে। প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ক্ষেত্রে বিশ্রামরত, প্রায় খালি অবস্থায় পাকস্থলির আয়তন ৪৫ থেকে ৭৫ মিলিলিটার। যেহেতু এটি বর্ধনশীল অঙ্গ, এটি প্রায় এক লিটার খাদ্য ধারণ করতে পারে। সদ্যজাত শিশুর পাকস্থলি মাত্র ৩০ মিলিলিটার খাদ্য ধারণ করতে পারে। সাধারণত, The concentration of hydrochloric acid in the stomach is about 0.5 percent or 5,000 parts per million.
পাকস্থলীতে পরিপাক:
পাকস্থলীর প্রাচীরে অসংখ্য গ্যাস্ট্রিকগ্রন্থি থাকে। গ্যাস্ট্রিক গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত রস খাদ্য পরিপাকে সহায়তা করে। পেরিসস্ট্যালসিস অর্থাৎ পাকস্থলীর পেশি সংকোচন ও প্রসারণের মাধ্যমে খাদ্যবস্তুকে পিষে মন্ডে পরিণত করে। পাকস্থলীতে খাদ্য আসার পর অন্তঃপ্রাচীরের গ্যাস্ট্রিক গ্রন্থি থেকে গ্যাস্ট্রিক রস নিঃসৃত হয়। এই রসে প্রধান যে উপাদানগুলো থাকে তা হলো: হাইড্রোক্লোরিক এসিড, পেপসিন।
হাইড্রোক্লোরিক এসিড খাদ্যের মধ্যে কোনো অনিষ্টকারী ব্যাকটেরিয়া থাকলে তা মেরে ফেলে। নিষ্ক্রিয় পেপসিনোজেনকে সক্রিয় পেপসিনে পরিণত করে এবং পাকস্থলীতে পেপসিনের সুষ্ঠু কাজের জন্য অম্লীয় পরিবেশ সৃষ্টি করে।
একজন মানুষ খাবার খায় তখন পাকস্থলীর প্যারাটাইল কোষ হতে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন হাইড্রোক্লোরিক এসিড নিঃসরণ করে ( যার পি এইচের মাত্রা 1.5 to 3.0 পর্যন্ত থাকে, অর্থাৎ উক্ত এক ফোটা হাইড্রোক্লোরিক এসিড কাগজ বা কাঠের মধ্যে ফেললে সাথে সাথে তা পোড়ে যায়, অথচ আমাদের পেটের পর্দা পোড়েনা মিউকাস এবং ইপিথেয়ালিয়েল কোষের জন্য ! ) ঠিক তখনি ইপিথেয়ালিয়েল কোষ হতে বাই- কার্বোনেট নিঃসরণ করে হাইড্রোক্লোরিক এসিড কে নিউট্রেলাইজ করে, অন্য দিকে পাকস্থলীতে প্রোটেন খাবার সমূহ যাওয়ার পর হাইড্রোক্লোরিক এসিড সক্রিয় হয়ে সেক্রেট এনজাইম পেপ্সিন এসে খাবার সমুহ কে হজম ও মল্ট করতে সহায়তা করে,
অর্থাৎ সে সময় হাইড্রোক্লোরিক এসিড প্রোটেন জাতীয় খাবার থেকে এমাইনো এসিড তৈরি হতে সহায়তা করে, তারপর তা ডিউডেনামে পাটিয়ে দেয়। কিন্তু যদি খাদ্য খাওয়ার ২০ থেকে ৩০ মিনিটের ভিতর এই হাইড্রোক্লোরিক এসিড যথাযত পরিমাণে অথবা ঠিক সময় মত না আসে তখন দেখা দেয় বিপত্তি – ( যেমন, খাওয়ার ঠিক সময় মত এসিড না এসে পরে আসে এবং তখন এসিড পরিপাক তন্ত্রের ভিতর জমা হয়ে পেট ফুলা, ঢেঁকুর উঠা সহ উপর দিকে চলে গিয়ে বুক জ্বলা দেখা দেয়, ইত্যাদি ) অন্য দিকে এসিডের স্বল্পতায় প্রোটেন খাদ্য সমুহকে পরিপাক করতে না পারায় তা ডিউডেনামে গিয়ে সামান্য পচন ক্রিয়া করে প্রায় অর্ধেক অপচনশীল খাবার রেক্টামে গিয়ে মল হিসাবে বাহির হয়ে যায়। একই সাথে কার্বোহাইড্রেট খাবার সমূহের হজম কমে গিয়ে বেশিপরিমান বায়ুর সৃষ্টি করে। যার আরেকটি প্রধান কারন আই বি এস এবং স্যালিয়াক জাতীয় অসুখের।
আগেই বলেছি হাইড্রোক্লরিকের পি এইচের মাত্রা 1.5 to 3.0 পর্যন্ত থাকে, অর্থাৎ উক্ত এক ফোঁটা হাইড্রোক্লোরিক এসিড কাগজ বা রুখের মধ্যে ফেললে সাথে সাথে তা পোড়ে যায়। যার ফলে উক্ত এসিড খাবারে যে বিষাক্ত ব্যাক্টোরিয়া, ভাইরাস এবং ছত্রাক থাকে-তা সাথে সাথে ধ্বংস করে দেয়। অর্থাৎ ১০০% এসিড একটি জীবাণু নাশক বা পাকস্থলী দূষণ মুক্ত কারক ক্ষার পদার্থ। যদি কোন কারনে এসিড কম উৎপাদন হয় তা হলে ফুড-পয়জন জাতীয় অসুখে বারে বারে আক্রান্ত হওয়াই স্বাভাবিক এবং প্রথম প্রথম লক্ষণ হিসাবে খাওয়ার ২- ৩০ মিনিট পর ই পেট ফুলে উঠা, বায়ু তৈরি হওয়া, গুড় গুড় শব্দ বা ঢেঁকুর উঠা সহ কলিক ব্যথা ও দেখা দিতে পারে এবং দীর্ঘ দিন ভুগতে থাকলে পাকস্থলীর ঝিল্লীর ভাঁজ সমূহ কে উত্তেজিত করার পক্ষের ব্যাক্টোরিয়া, প্যারাসাইট ও ভাইরাসসমূহ কে বিপক্ষে টেনে নেয় – অবশেষে এর পরিনতি খুবই ভয়াবহ হয়ে থাকে ( ৭০% বেলায় আই বি এস বা অনিয়ন্ত্রিত পায়খানা, ১০% স্যালিয়াক এবং ৩% পাকস্থলীর ক্যানসার হতে পারে )। নতুন গবেষণা অনুসারে Epstein-Barr virus, Coxsackie virus, Echovirus ( সংক্রামণ জাতীয় ভাইরাস )-ই পাকস্থলীর ঝিল্লী সমূহে কোষের মুখ কে স্থায়ী ভাবে বন্ধ করে দেয় ফলে পাকস্থলী ও ডিউডেনামের শোষণ ক্যামতা একেবারে কমিয়ে দেয়, তখন দেখা যায় অল্প কিছু খাবার খাওয়ার পর পরই পেট ফুলে উঠে বা ভরে যায় মনে হয় এবং পরবতিতে অন্যান্য লক্ষণ দেখা দেয়।
সদ্য গবেষণা অনুসারে দেখা যায়, হাইড্রোক্লোরিক এসিডের ঘাটতির ফলে খাদ্য এলার্জি, আইবিএস ( অনিয়ন্ত্রিত পায়খানা ) সহ ক্ষুদ্রান্ত্রের প্রদাহ জনিত প্রতিক্রিয়া দ্বিগুণ মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়ে থাকে যা অনেক সময় সাধারণ চিকিৎসায় সুস্থ হওয়া যায়না – বা প্রকৃত অসুখটি ধরা পড়তে অনেক বিলম্বিত হয় ।
কিছু খনিজ, ভিটামিন ও পুষ্টিজাত খাবার সমূহ শোষণে সহায়তা করা। যদি কোন কারনে পাকস্থলীতে হাইড্রোক্লোরিক এসিডের মাত্রা কমে যায় ( পি এইচ মাত্রা 1.5 নিছে চলে আসে ) তখন ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, জিঙ্ক, আয়রন, সেলিনিয়াম, ইত্যাদি খনিজ সমূহ শোষিত হতে ব্যাঘাত ঘটে বিধায় এর অভাবে যে অসুখ দিয়ে থাকে সেই সব রোগের লক্ষণ বিদ্যমান থাকবে বিশেষ করে বিধায় রক্তে আয়রনের পভাব দেখা দিবেই। সেই সাথে অন্ত্রের ভিটামিন বি -১২ শোষণ ক্যামতা হারিয়ে ফেলতে থাকে ( জেনে রাখা ভালঃ যাহারা বুক জ্বালা বা আলসার জাতীয় অসুখের জন্য দীর্ঘ দিন ওমিপ্রাজল জাতীয় ঔষধ সেবন করেন তাদের বেলায় ভিটামিন বি-১২ এর ঘাটতি দেখা দিয়ে থাকে বিধায়, অন্ত্রের শোষণ ক্যামতা ঠিক রাখার জন্য বাড়তি ভিটামিন বি-১২ সেবন করা উচিৎ ) কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাট, ভিটামিন এবং মিনারেল - হাইড্রোক্লোরিক এসিড অবশ্যই কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাট হজম করতে সহায়তা করে সেই সাথে ভিটামিন এ এবং ই-কে স্টিমোলেট করে – প্যাঙ্ক্রিয়েটিক এনজাইম এবং পিত্তরস ক্ষুদ্রান্ত্রে নিঃসরণ করতে বিশেষ ভুমিকা পালন করে এবং ফলিক এসিড, এস্কারবিক এসিড, বিটা ক্যারোটিন, এবং আয়রন সমূহ খাদ্য থেকে আরোহণ করতে বিশেষ সহায়তা করে। গবেষণা অনুসারে দেখা যায় যে, হাইড্রোক্লোরিক এসিডের স্বল্পতায় মানব দেহের বিশেষ খনিজ – যেমন ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, জিংক, কোপার, ক্রোমিয়াম, সেলিনিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ভেনাডেনিয়াম, মলিভিডেনাম এবং কোবাল্ট খনিজ সমূহের শোষণ ক্যামতা কমে গিয়ে লক্ষণ বিহীন অনেক ধরনের সমস্যা দেখা দেইয়ে থাকে এবং ক্রমান্বয়ে এসিডের স্বল্পতায় রুগীর হজম শক্তির টান-পোড়ন চলতে থাকে।
গবেষণা অনুসারে কিছু তথ্য - থিউরি অনুসারে যদি ও বলা হয় অতিরিক্ত এসিডের কারনেই বুক জ্বলার সৃষ্টি হয় তা সত্য কিন্তু ৪০% বেলায় পাকস্থলীর উৎপাদিত স্টমাক এসিড পাকস্থলীর হজম ক্রিয়ায় অংশগ্রহণ না করে ফিজিওলজিক্যাল অন্যান্য কারনে তা অন্ননালীর উপরের দিকে চলে যায় এবং তখন সেখানের পাতলা মিউকাস মেমব্রেনকে পুড়িয়ে দেয়- যাকে আমরা বুক জ্বলা বা হার্ট বার্ন বলে থাকি – ফল হিসাবে পাকস্থলীর এসিড তখন কমে যায়, কিন্তু পিন পয়েন্ট অনুসারে দেখা যায় উক্ত হাইড্রোক্লোরিক এসিড কমানুর জন্য আমরা এন্টাসিড, ওমিপ্রাজল ঔষধ সেবন করে এসিড কে ধমিয়ে রাখি অথবা কমিয়ে ফেলি, অথচ নিজের হজম শক্তির প্রয়োজনিয় এসিডকে নস্ট করার ফলেই পরবর্তীতে নীচের অসুখ সমূহের যে কোন একটি দেখা দিতে পারে এবং লক্ষণ অনুসারে ঔষধ সেবন করলে অনেক সময় সুস্থ না ও হতে পারেন।