শরীরের পক্ষে কফি ভালো। ক্যাফেইনের অনেক উপকারিতা রয়েছে। কিন্তু খালি পেটে কফি শরীরের পক্ষে মারাত্মক। আর তা যদি হয় ব্ল্যাক কফি, তাহলে ক্ষতির পরিমাণ কয়েক গুন বেড়ে যায়।
ঘুম থেকে উঠে সরাসরি এই পানীয় পান করলে কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়ে। শুধু তাই নয়, রাতভর শরীরে নানা রকম প্রক্রিয়া চলার কারণে পাকস্থলিতে অতিরিক্ত অ্যাসিড ক্ষরণ হয়। এই অবস্থায় খালিপেটে কফি পড়লে, গা গুলোনো ও বমির মতো সমস্যা দেখা দেয়।
তাই দিনের যে সব সময় দেহে কোলেস্টেরলের মাত্রা কম থাকে, তখন এই পানীয় পান করাই বুদ্ধিমানের কাজ। অর্থাত্ সকাল ৯ টা থেকে ১১ টা পর্যন্ত খাওয়ার আদর্শ সময়।
তবে লাঞ্চ বা ডিনারের পর এই পানীয় এড়িয়ে চলাই ভালো। এতে রাতের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে।
কফি পানের ভাল-মন্দগুলো এক নজরে দেখে নেয়া যাক।
কফি পানের উপকারিতা
খেলাধুলায় উন্নতি
ক্যাফেইন যুক্ত এই পানীয় পান করলে খেলাধুলায় প্রাণ পাওয়া যায়। যদিও হৃদপিণ্ডের গতি বাড়ায়, তারপরও এটি শরীরে উদ্যম ও উৎসাহ তৈরি করে। তাই যে কোনো খেলার আগে এই পানীয় পান শরীরে আনে আলাদা শক্তি।
মানসিক শক্তি বৃদ্ধি
গবেষণায় দেখা গেছে মানসিক চাপের সময়, ২০০ মি.গ্রাম ক্যাফেইন শরীরে গেলে মনযোগ বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে প্রমাণ মিলেছে আলঝেইমার (স্মৃতিভ্রংশ) রোগের ক্ষেত্রে বিশেষ উপকারী পদার্থ ক্যাফেইন।
ক্যান্সারের বিরুদ্ধে খুব কার্যকর
সম্প্রতি এক গবেষণায় উঠে আসে, ক্যান্সারের বিরুদ্ধেও লড়াই করে কফি। না, সব ধরণের ক্যান্সার নয়। তবে বেশ কিছু ক্যান্সারের বিরুদ্ধে কাজ করে এই পানীয়টি। মুখগহ্বরের ক্যান্সার, মস্তিষ্ক কিংবা জরায়ুর ক্যান্সারের বিরুদ্ধে কাজ করে কফি। তাই প্রতিদিন চার বা এর বেশী কাপ কফি পান করে খুব সহজেই নিজেকে ক্যান্সারের হাত থেকে সুরক্ষিত রাখতে পারবেন আপনি।
ডায়াবেটিস প্রতিরোধ
কফি পানের অভ্যাস যে আপনাকে কেবল মানসিকভাবেই সতেজ করে তোলে তা নয়, পাশাপাশি এটি আপনার শরীরে প্রচুর পরিমাণে এডিপোনেক্টিন (adiponectin) উৎপন্ন করে। এডিপোনেক্টিন হলো সেই উপাদান যেটি আমাদের শরীরে সুগার লেভেল এবং ইনসুলিনের (insulin) মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। এই ছোট্ট উপাদানটির সাথে খানিকটা ম্যাগনেসিয়াম (magnesium) আর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট (anti-oxident) মিলে তৈরি হয় ডায়াবেটিসকে দূর করার মতন এক উপকারী পানীয়। তবে তাই বলে যাদের এর ভেতরেই ডায়াবেটিস হয়ে গিয়েছে, তারা কফির এই সুফলটি পাবেন না।
চোখ ভাল রাখে
বর্তমান সময়ে দৃষ্টিশক্তির সমস্যায় ভুগছেন না এমন খুব কম মানুষ আছেন। এই সমস্যায় কফি আপনাকে সাহায্য করতে পারে । কফিতে আছে ক্লোরোজেনিল অ্যাসিড। এই অ্যাসিড আমাদের চোখকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।
রোগের ঝুঁকি কমায়
ক্যাফেইন যুক্ত বা বিহীন, যে কোনো ধরনের কফি টাইপ-টু ডায়াবেটিস রোগের ঝুঁকি কমায়। সেই সঙ্গে দেখা গেছে কিছু ক্যান্সারের ঝুঁকিও কমায় এই পানীয়।
কলিজার রক্ষাকবজ
অ্যালকোহল সেবন ও স্থুলতা, যকৃতে মেদ জমার পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। ব্যথার পাশাপাশি যকৃতের অতিরিক্ত মেদ থেকে হতে পারে লিভার সিরোসিস। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, কোনো কোনো সময় লিভার বা যকৃতের মেদ কমাতে ক্যাফেইন কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
আনন্দ অনুভুতি
সত্যি বলতে কফির গন্ধই আপনাকে অনেকখানি চাঙা করে দেয়। আর এই পানীয় পেটে পড়লে মনের বিষাদভাব কাটতে বেশি সময় লাগে না।
ওজন কমানোর মহৌষধ
আপনি কি জানেন, কালো কফি আপনার ওজনকে অনেক বেশি কমিয়ে আনে? বিশুদ্ধ কালো কফি পান করেন, তাদের জন্য সুখবর। কফিতে প্রচুর পরিমাণে ক্লোরোজেনিক অ্যাসিড থাকে। এই ক্লোরোজেনিক অ্যাসিড কার্বোহাইড্রেট বিপাকের গতিকে ধীর করে দিয়ে শরীরের ওজন বৃদ্ধিকেও কমিয়ে দেয়। তবে তাই বলে অতিরিক্ত কফি পানের কোনো মানে নেই। কারণ, অতিরিক্ত কফি পান করলে ধীরে ধীরে শরীরের ওজনের উপর কফির এই প্রভাব কেটে যাবে।
সুতরাং, আপনি যদি ডায়েট করে থাকেন তাহলে কফি পান হয়তো অনেকক্ষণের জন্যে না হলেও অল্প সময়ের জন্য আপনার শরীরের পক্ষে অনেক বেশী উপকারী একটা ব্যাপার হতে পারে। একটি কথা মনে রাখা প্রয়োজন। কফি স্বাস্থ্যকর হওয়ার জন্য এই সাথে ক্রিম বা অতিরিখ চিনি মেশাবেন না।
কফি পানের অপকারিতা
হার্টের জন্য ভালো নয়
কিছু গবেষণায় দেখা গেছে ক্যাফেইন হৃদপিণ্ডের রক্তসরবরাহকরী ধমনীতে রক্ত চলাচল ধীর করে দেয়। বিশেষ করে যখন বেশি দরকার, যেমন: ব্যায়ামের সময়। তাছাড়া বুকধড়ফড়ানি, অনিয়মিত হৃদস্পন্দন বা উচ্চ রক্তচাপের জন্যেও শরীরের অতিরিক্ত ক্যাফেইন দায়ী।
ঘুমের ব্যঘাত
এক কথা অনেকেই জানেন, চা বা কফি খেলে ঘুম কম হয়। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, যারা দিনে তিন কাপের বেশি এই পানীয় পান করেন তাদের শান্তির ঘুম খুব কমই হয়। আরেক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা ক্যাফেইন গ্রহণ করেন না তাদের থেকে এই পানীয় পানকারীদের ৭৯ মিনিট কম ঘুম হয়। তাই ঘুমের সমস্যা থাকলে কফিকে না বলুন।
চিনির সঙ্গে আত্মিয়
যদিও অনেকে চিনি ছাড়া কফি পান করেন। তবে এই পানীয়র সঙ্গে কেক, বিস্কুট বা সকালের নাস্তার অনেক পদেই থাকে চিনি। সবমিলিয়ে দেখা যায়, সারা দিনে হয়তো ১১ টেবিল-চামচ চিনি খাওয়া হয়ে যাচ্ছে। তাই যারা ওজন কমানোর চেষ্টায় আছেন, তাদের চেষ্টা তখন বিফলে যাবে।
মেজাজের জন্য খারাপ
ক্যাফেইন শরীরের অ্যাড্রেনালিন নামক একধরনের হরমোনের মাত্রা বাড়ায়। যে কারণে শরীরের টানটান উত্তেজনা বা ঘাবড়িয়ে যাওয়ার অনুভুতির মাত্রা বাড়িয়ে দেয়।
সন্তান ধারণে অক্ষমতা
দৈনিক পাঁচ কাপের বেশি কফি খেলে গর্ভধারণের ক্ষমতা কমে যেতে পারে। যদি মা হতে চান, তবে অবশ্যই এই পানীয় খাওয়ার পরিমাণ কমাতে হবে। আর গর্ভধারেণের পর এই পানীয় বাদ দিন। কারণ দৈনিক ২০০ মি.গ্রাম ক্যাফেইন শরীরে গেলে গর্ভের শিশুর ক্ষতি হওয়ার পাশাপাশি জন্মক্রটি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
অস্ট্রেলিয়ার স্নায়ুবিজ্ঞান বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, যাঁরা হরমোনের সমস্যায় ভুগছেন তাঁদের কফি এড়িয়ে চলাই শ্রেয়। তাঁদের মতে, এই পানীয়র মধ্যে থাকা ক্যাফেইন কিছু হরমোন ক্ষরণে ব্যাঘাত ঘটায়। এর ফলে শরীরে বিভিন্ন জটিল সমস্যা সৃষ্টি হয়।
কফি খাবেন? ঠাণ্ডা, না, গরম?
বাসায় অতিথি এলে, বা, বন্ধুকে নিয়ে ফাস্ট ফুডের দোকানে গিয়ে জিজ্ঞাসা করা হয়, তারা কিভাবে কফি খেতে পছন্দ করেন, ঠাণ্ডা, না, গরম? এই পানীয় গরম অবস্থায়, নাকি, ঠাণ্ডা অবস্থায় শরীরের জন্য উপকারী, সেটা নিয়েও গবেষকদের মাথা-ব্যাথার কমতি ছিল না। তারা গবেষণা করে লক্ষ্য করেছেন, ঠাণ্ডা (cold coffee) অবস্থায় এই পানীয় পান করা গ্যাস্ট্রিক রোগীদের জন্য ইতিবাচক ফলাফল বয়ে আনে। কারণ, ঠাণ্ডা অবস্থায় এই পানীয়’র ৬৭% অ্যাসিডিটি কমে যায়। আর, ঠাণ্ডা কফিতে ক্যাফেইন ঘনীভূত অবস্থায় থাকে।
সুতরাং, গরমে যাদের অস্বস্থি বেড়ে যায়, তারা গরম বাদ দিয়ে ঠাণ্ডা অবস্থায় এই পানীয় পান করতে চিকিৎসকগণ পরামর্শ দিয়েছেন।
আপনি কি জানেন?
কত অদ্ভূত এই পৃথিবী? তা না হলে কফি’র মত পানীয় নিষিদ্ধ করতে হয়! হ্যা,এই পানীয় বিভিন্ন সময়ে ৫ বার নিষিদ্ধের তালিকায় উঠেছিল।
১. প্রথমে ১৫১১ সালে মক্কায়। সেবার অভিযোগ ছিল, কফি খেলে মাথায় উল্টাপাল্টা চিন্তা-ভাবনার উদ্রেক হয়। সুতরা, এটা নিষিদ্ধ কর।
২. এরপর, ষোড়শ শতকে রোমের ধর্মীয় নেতারাও কফি নিষিদ্ধ করেছিলেন, কারণ তাদের বিশ্বাস ছিলো এই পানীয় খেয়ে শয়তানের আছড় হয়।
৩. তারপর, কফি নিষিদ্ধ করলে তুরস্কের অটোমান সম্রাট চতুর্থ মুরাদ। এখানে থেমে যান নি তিনি, এই পানীয় পানকারী বিরুদ্ধে শাস্তির রুল জারি করলেন; প্রহার থেকে শুরু করে সমুদ্রে নিক্ষেপ পর্যন্ত!
৪. সুইডিশ সরকার ১৭৪৬ সালে কফি’র সাথে কফি খাওয়ার জিনিসপত্রও নিষিদ্ধ ঘোষনা করে দিলেন।
৫. আর, সর্বশেষ ১৭৭৭ সালে প্রুশিয়ার রাজা ফেড্রিক দা গ্রেট কফি নিষিদ্ধ করেছিলেন। কারণ তিনি ভয় পাচ্ছিলেন, তাদের নিজের পানীয় বিয়ার থেকে না কফির জনপ্রিয়তা বেশি হয়ে যায়!
তথ্যসূত্র : ইন্টারনেট