জীবনে উন্নতির অন্যতম হাতিয়ার ইতিবাচক চিন্তা ও আত্মবিশ্বাস। এই বলে বলীয়ান লোকজন যেকোনো ক্ষেত্রেই সাফল্য পান। তবে অতি আত্মবিশ্বাস ভালোর বদলে বিপদ ডেকে আনে। শঙ্কা বাড়ায় ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার।
ইন্দো-এশীয় নিউজ সার্ভিসের (আইএএনএস) খবরে বলা হয়, যাঁরা মনে করেন, বুদ্ধিমত্তা স্থির বিষয় এবং এটা পরিবর্তনযোগ্য নয়, তাঁরাই অতি আত্মবিশ্বাসী হন।
গবেষণাকর্মের অন্যতম লেখক ও যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষক জয়েস আরলিংগার বলেন, ‘ওই ধরনের লোক (যাঁরা মনে করেন, বুদ্ধিমত্তা পরিবর্তনশীল নয়) সহজ কাজে মনোনিবেশ করে তাঁদের অতি আত্মবিশ্বাসের প্রতিফলন ঘটান। বিপরীতে কাজের কঠিন অংশে খুব কমই সময় ব্যয় করেন।’
‘সামান্য বেশি আত্মবিশ্বাস সহায়ক হতে পারে। তবে অতি মাত্রায় আত্মবিশ্বাস লোকজনকে ভুল সিদ্ধান্তে চালিত করতে পারে এবং শেখার সুযোগ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারে।’
গবেষকদের মতে, যেসব লোক মনে করেন, বুদ্ধিমত্তা বাড়ানো যায়, তাঁরা কোনো কাজের কঠিন অংশ নিয়ে বেশি সময় ব্যয় করেন। এভাবে তাঁদের সামর্থ্যের চেয়ে আত্মবিশ্বাসের মাত্রা বেড়ে যায়।
গবেষকরা দেখেছেন, অতি আত্মবিশ্বাস ব্যক্তিগত গাড়ির চালক, মোটরসাইকেলচালক, চিকিৎসক ও আইনজীবীদের সাধারণ একটি সমস্যা।
‘আমরা জন্মাই ডানা নিয়ে, কিন্তু কেন সারাজীবন হামাগুড়ি দিয়ে চলতে চাই?’ জালাল উদ্দীন মুহাম্মদ রুমিও তাঁর উক্তিতে মানুষের চরম সাফল্য অর্জন করতে পারা, বা না পারার পেছনে আত্মবিশ্বাসকেই মুখ্য বিষয় হিসেবে তুলে ধরেছেন।
আত্মবিশ্বাস সম্পূর্ণ মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার। এর প্রভাবে মনে এক নতুন সূচনার আবির্ভাব ঘটে। কিন্তু এর প্রভাব সবসময় বিরাজমান কেন! কেনই বা মুখ্য ভুমিকা পালন করছে? এর প্রয়োজনীয়তাই বা কী মানুষের জীবনে? প্রশ্ন অনেক রকম হতে পারে, কিন্তু উত্তর একটাই, আর তা হলো আত্মবিশ্বাস মানুষের মাঝে তাত্ত্বিক পরিবর্তন ঘটায়, যা নিজের প্রতি নিয়ন্ত্রণ, মনোবল বৃদ্ধি, সাহস এবং আত্মমর্যাদা তৈরিতে বিশেষভাবে সাহায্য করে। এখন প্রশ্ন আসতে পারে, কীভাবে?
ক্যারলি টাকাক্স এর কথা মনে আছে? যে নিজের একমাত্র হাতকে পৃথিবীর বুকে সর্বশ্রেষ্ঠ শুটিং হাত বানিয়েছিলেন। দুর্ঘটনা যার স্বপ্ন পুরোনের বাঁধা হতে পারেনি। বরং প্রতিকূল সমাজ তাকে নিজের প্রতি আত্মপ্রত্যয়ী হতে সাহায্য করে। তার কাছে দুটি পথ খোলা ছিল; এক নিজের বেস্ট শুটিং হাত হারানোর শোকে কাতর হয়ে সবার থেকে আলাদা নিজেকে লুকিয়ে রাখা এবং অপরটি হলো নিজের লক্ষ্য অর্জনে অটল থাকা। তিনি দ্বিতীয় পথটি বেছে নিলেন এবং পৃথিবীর বুকে পরপর দুইবার অলিম্পিকে স্বর্ণপদক জিতে নিজের নাম ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিখিয়ে নিলেন।
আত্মবিশ্বাস তাঁর পথকে বরং সহজ করে দেয়। নিজের প্রতি নিয়ন্ত্রণ, মনোবল ধরে রাখা এবং সাহস সঞ্চার করা আত্মবিশ্বাসের বদৌলতেই সম্ভব হয়েছিল তাঁর পক্ষে।
পিথাগোরাস বলেছিলেন, ‘যে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি, সে কখনো স্বাধীন নয়’। তাহলে বলাই যায়, স্বাধীন হতে আত্মবিশ্বাসী হতে হবে। কথায় আছে, অতিরিক্ত কিছুই ভালো না। ঠিক তেমনি আত্মবিশ্বাস থাকা ভালো, কিন্তু অতিরিক্ত থাকা ভালো না।
একটা বাস্তব অভিজ্ঞতা বলি, এক ছেলে অধিক আত্মবিশ্বাসের জোরে ভোরে বাসা থেকে বের হলো লক্ষ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হবে, পিকনিকে যাবে। সেদিনের জন্য অনেক পূর্ব প্রস্তুতি নিয়েছিল। তার আত্মবিশ্বাস ভেঙে গেলো তখন, যখন অস্ত্রধারীরা তার গলা এবং পেটে চাপাতি ঠেকিয়ে সর্বস্ব লুট করে চলে গেলো, কিন্তু ওর কিছুই করার ছিল না। তাই নিজের প্রতি বিশ্বাস যেন নিয়ন্ত্রিত পরিমাণে হয়, সেটা অবশ্যই ভেবে দেখতে হবে।
আর হ্যাঁ, অভিজ্ঞতাটি আমার নিজের সাথে ঘটে যাওয়া। তবে, আঘাতে জরাজীর্ণ না হয়ে বরং তার থেকে শিক্ষা নেওয়া ভালো। অপরাহ উইনফ্রে বলেছেন, ‘আঘাতকে জ্ঞানে রূপান্তরিত কর’।
আত্মবিশ্বাস মানুষের আত্মমর্যাদাবোধ বৃদ্ধি করে। আত্মমর্যাদা হলো, নিজের প্রতি নিজের বিশ্বাস এবং সম্মানবোধ তৈরি হওয়া। যে ব্যক্তি নিজেকে সম্মান করতে জানে না, সে অন্য মানুষকেও সম্মান করতে পারে না।
পিথাগোরাস বলেছিলেন, ‘সবার আগে নিজেকে সম্মান করো’। তবে দিনের পরে যেমন রাত নামে, ঠিক তেমনই অধিক আত্মবিশ্বাস মানুষের মাঝে অহংকার তৈরি করে। অহংকার হলো নিজের মেকি শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে অন্যকে অসম্মান করা।
ভারতের একজন টিভি শোর পরিচালক বলছেন, আমি ছোটবেলায় আমার বাড়িতে টিভি না থাকায় আমি অন্য বাড়িতে টিভি দেখতে যেতাম, আমার বাবা অনেক পিড়াপিড়ি করে নিষেধ করার পরও না মানায় আমার বাবা একদিন আমাকে বলছেন, দেখ বাবা তুমি এমন কাজ কর, যাতে অন্য কেউ তোমাকে টিভিতে দেখে। মানে নিজের আত্মমর্যাদার কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন পিতা। তাই একথা বলাই যায়, আত্মবিশ্বাস প্রয়োজন মতো থাকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
অন্যভাবে বলতে গেলে বলা যায়, আত্মবিশ্বাস সম্পূর্ণ অনুভূতির ব্যাপার। অনুভূতির হরেক পদ থাকলেও একটি-অপরটির সহায়ক। আত্মবিশ্বাসের জোরে আরো একটি অনুভূতির সৃষ্টি হয়, সাহস।
উইনস্টল চার্চিল বলেছেন, ‘সাফল্য স্থায়ী নয়, ব্যর্থতা মানেই মৃত্যু নয়। আসল ব্যাপার হচ্ছে সাহস ধরে রাখা’। তবে, নিজের মনে সাহসের সঞ্চার ঘটবে তখনই, যখন নিজের উপর আত্মবিশ্বাস তৈরি হবে। আত্মবিশ্বাসের বদৌলতে মানুষকে নিজের ক্ষমতার উর্ধে যেতেও দেখেছি আমরা। যখন পেং সুইলিনের মতো মানুষ নিজের শরীরের অর্ধেক অংশ হারানোর পরেও আত্মবিশ্বাস এবং দৃঢ় মনোবলের জোরে এখনো টিকে আছেন, সুস্থ আছেন।
নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠা অনেকটা খড়ের গাদায় সুচ খোঁজার মতো ব্যাপার। কিন্তু একবার এর নাগাল পেলে সাফল্যের সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছানো তার পক্ষে নেহাৎ ডাল-ভাত।
লেখক: শিক্ষার্থী, সাংবাদিকতা এবং গণমাধ্যম অধ্যায়ন বিভাগ,
স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়।