মহাবিশ্বের আকার আকৃতিতে বিশাল, বিপুল। কিন্তু কত বড়? এর উত্তরে বিজ্ঞানীরা একটি হিসাব (৪৬ দশমিক ৫ বিলিয়ন আলোকবর্ষ) দিয়েছেন বটে, কিন্তু মহাবিশ্ব ঠিক কত বড়, তা উপলব্ধি করাও মানুষের পক্ষে কঠিন। এক নক্ষত্র থেকে আরেক নক্ষত্র বা এক ছায়াপথ থেকে আরেকটির দূরত্ব এতই বেশি যে সেগুলো আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত সাধারণ মিটার বা কিলোমিটার এককে প্রকাশ করলে অনেক বড় বড় সংখ্যা পাওয়া যায়। তাই মহাজাগতিক দূরত্ব প্রকাশ করা হয় লাইটইয়ার বা আলোকবর্ষ এবং পারসেক এককে। আলোকবর্ষ হলো আলো এক বছরে যে পথ পাড়ি দেয়, সেই দূরত্ব। আর ৩ দশমিক ২৬ আলোকবর্ষ দূরত্বকে বলা হয় এক পারসেক। মহাবিশ্বে আলোর গতিই সবচেয়ে বেশি বলে বিপুল দূরত্ব প্রকাশ করতে এই এককগুলো ব্যবহার করা হয়। আলো প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৩ লাখ কিলোমিটার (১ লাখ ৮৬ হাজার মাইল) পথ পাড়ি দিতে পারে। সেই হিসাবে আলো এক আলোকবর্ষে পাড়ি দেয় প্রায় ৯ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন কিলোমিটার (৫ দশমিক ৯ ট্রিলিয়ন মাইল)। সূর্য বাদে আমাদের সবচেয়ে কাছের নক্ষত্র প্রক্সিমা সেন্টুরাই ৪ দশমিক ৩৭ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। আমাদের নিজেদের ছায়াপথ মিল্কিওয়ে বা আকাশগঙ্গার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তের দূরত্ব প্রায় ১০ লাখ আলোকবর্ষ।
পৃথিবী থেকে পাঠানো নভোযান ভয়েজার-১ বর্তমানে ঘণ্টায় প্রায় ৬০ হাজার কিলোমিটার (৩৭ হাজার মাইল) বেগে সৌরজগতের সীমানা ছাড়িয়ে আরও দূরে চলে যাচ্ছে। একেই আমাদের বর্তমানে সর্বোচ্চ গতি ধরা হলে এই গতিতে প্রক্সিমা সেন্টুরাই নক্ষত্রব্যবস্থায় পৌঁছাতে সময় লাগবে ৮০ হাজার বছর। বলে রাখা ভালো, ৮০ হাজার বছর আগেই মানবজাতি প্রথম লিখতে শুরু করেছিল। এরপর কত প্রজন্ম পেরিয়ে আমরা বর্তমান অবস্থায় পৌঁছেছি, তার কোনো লেখাজোকা নেই। কাজেই ৮০ হাজার বছর চাট্টিখানি কথা নয়।
তাই সৌরজগৎ ছাড়িয়ে অন্য কোথাও যেতে চাইলে এই বিপুল দূরত্ব পাড়ি দেওয়ার সহজ কোনো উপায় খুঁজে বের করতে হবে। মানুষের বানানো নভোযানের যে গতি, তাতে সৌরজগতের কিনারা পর্যন্ত যেতেই সেগুলোর কয়েক যুগ লেগে যায়। যেমন ভয়েজার-১ ১৯৭৭ সালে উৎক্ষেপণের পর বিগত প্রায় ৪২ বছরে পাড়ি দিয়েছে মাত্র ২১ দশমিক ৭ বিলিয়ন কিলোমিটার। অথচ আলোর হিসাবে এই দূরত্ব মাত্র কয়েক আলোকঘণ্টা। তাই নভোযানের জন্য রাসায়নিক রকেট জ্বালানি প্রযুক্তি বাদ দিয়ে অন্য কোনো উপায় খুঁজতে হবে। সেই প্রযুক্তির কী হতে পারে, তা এখনো আমাদের পুরোটাই অজানা।
পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মকানুন বলে, কোনো কিছুই আলোর গতিতে চলতে পারবে না। ১৯০৫ সালে প্রকাশিত আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব নভোযানের গতির ক্ষেত্রে একটি সীমাবদ্ধতার রেখা টেনে দেয়। কোনো বস্তু ত্বরণপ্রাপ্ত হলে তার মোট শক্তি বাড়ে বটে, তবে বস্তুটির যখন গতি বৃদ্ধি পায়, তখন বিস্ময়কর একটা ঘটনা ঘটে। তখন দেখা যায়, এই শক্তি বস্তুর গতি না বাড়িয়ে তার ভরশক্তি বাড়িয়ে দেয়। এতে ওই বস্তুর গতি আরও বাড়ানো খুবই কঠিন হয়ে পড়ে। কাজেই তাত্ত্বিকভাবে, কোনো বস্তুকে আলোর গতি দিতে অসীম পরিমাণ শক্তির প্রয়োজন হয়। কারণ, বস্তুটি তখন নিজেই অসীম ভরে পরিণত হয়। অবশ্য আপেক্ষিকতার আরেকটি ফলাফল সম্ভাব্য আন্তনাক্ষত্রিক নভোচারীর জন্য বেশ সুবিধাজনক হতে পারে। একে বলে টাইম ডাইলেশন বা সময় প্রসারণ। মানে, আপেক্ষিক গতিতে চলমান কোনো নভোযানের ভেতরে সময়ের গতি নভোযানের বাইরের মহাবিশ্বের স্থির বস্তুদের তুলনায় ধীর হয়ে যাবে। আর নভোযানটির গতি যথেষ্ট বেশি হলে তার ভেতরের নভোচারীদের কয়েক মাসের যাত্রাপথকে বাইরে থেকে ১ হাজার বছরের যাত্রাপথের সমান বলে মনে হবে। এখানে বড় ব্যাপারটি হলো, নভোচারীদের ভবিষ্যতের পথে এই যাত্রা একমুখী। তাঁরা আর তাঁদের আগের সময়ে ফিরে আসতে পারবেন না।
যত দূর জানা গেছে, আলোর গতি হলো অনিবার্য প্রাকৃতিক গতিসীমা। তাই ভর আছে এমন কোনো বস্তুর পক্ষে এই গতিতে পৌঁছানো কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তাই আন্তনাক্ষত্রিক ভ্রমণের জন্য অন্য কোনো উপায়ের খোঁজ করা ছাড়া আর কোনো পথ নেই। কেমন হতো যদি আলোর চেয়ে বেশি গতিতে কোনো নক্ষত্রে যাওয়া যেত? যদি মহাবিশ্বের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে শর্টকাট পথে অল্প সময়েই পৌঁছানো যেত? পদার্থবিজ্ঞানের কোনো নিয়মকানুন লঙ্ঘন না করেই যদি এমন কিছু করা যায়, তাহলে সাপও মরবে, কিন্তু লাঠিও ভাঙবে না। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এমনটি ঘটানো সম্ভব। সেটি করতে প্রকৌশলী আর জ্যোতির্বিদেরা একটি নয়, দুটি উপায় খুঁজে পেয়েছেন। সম্ভাব্য এ উপায় দুটি ওয়ার্মহোল আর র্যাপ ড্রাইভ (Warp drive) নামে পরিচিত। দুটিই বিজ্ঞান কল্পকাহিনিগুলোতে এখন জলভাত হয়ে গেছে। কিন্তু এ ব্যাপারে বিজ্ঞান কী বলে?
ওয়ার্মহোলকে মহাবিশ্বের ভেতরে একধরনের টানেল বা সুড়ঙ্গ হিসেবে ধরে নেওয়া যেতে পারে। তাত্ত্বিকভাবে এই সুড়ঙ্গের দুটি প্রান্ত থাকবে, যারা মহাবিশ্বের বহুদূরের দুটি অঞ্চলকে সংযুক্ত করবে। ওয়ার্মহোলকে আইনস্টাইন-রোজেন ব্রিজও বলা হয়। ধারণাটি এসেছিল আইনস্টাইনের সমীকরণের বিশেষ একটি গাণিতিক সমাধান থেকে। সমীকরণটি ছিল তাঁর বিখ্যাত ক্ষেত্র সমীকরণ। ত্রিমাত্রিক স্থান কীভাবে সময়ের সঙ্গে জোড় বেঁধে চারমাত্রিক স্থান-কাল তৈরি করে, সেটিই ব্যাখ্যা করা হয়েছে এই ক্ষেত্র সমীকরণে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, একটি ওয়ার্মহোলের ভেতরের পথ যদি চারপাশের স্থানের চেয়ে সংক্ষিপ্ত হয়, তাহলে একে স্থান-কালের মধ্যে একটি শর্টকাট পথ হিসেবে ব্যবহার করা সম্ভব। আপেলের ভেতর দিয়ে একটা পোকা যেভাবে অল্প পথ পাড়ি দিয়ে আপেলের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যায়, ওয়ার্মহোলও অনেকটা সে রকম। তাই তাত্ত্বিকভাবে, ওয়ার্মহোল দিয়ে মহাবিশ্বের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে আলোর চেয়ে বেশি বেগে যাওয়া সম্ভব। তবে স্থানীয়ভাবে দেখলে ওয়ার্মহোলের ভেতরের নভোচারী কখনোই আলোর বেগের সীমা অতিক্রম করতে পারেন না।
ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বরের সঙ্গে আমরা কমবেশি সবাই পরিচিত। অতি ভারী কোনো নক্ষত্র তাদের জীবনকালের শেষ পর্যায়ে মহাকর্ষের প্রভাবে চুপসে গিয়ে অতি শক্তিশালী মহাকর্ষীয় বল সৃষ্টি করে। তাতে কৃষ্ণগহ্বরে আগের নক্ষত্রের বস্তুগুলো চুপসে অসীম ঘনত্বের ক্ষুদ্র একটি বিন্দু তৈরি করে। একে বলা হয় সিঙ্গুলারিটি বা পরম বিন্দু। এই বিন্দুর বাইরের প্রান্তের নাম ইভেন্ট হরাইজন বা ঘটনাদিগন্ত। কৃষ্ণগহ্বরের ঘটনা-দিগন্তের মহাকর্ষ বল এতটাই শক্তিশালী যে সেখান থেকে কোনো আলোও আর বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে না। দুটি কৃষ্ণগহ্বর তাদের ঘটনা-দিগন্তের কাছে যুক্ত হয়, যা পরম বিন্দু থেকে অনেক দূরে থাকে। এর মানে হলো, এই অঞ্চলের চারপাশের বক্র ও মসৃণ স্থানকাল থেকে আইনস্টাইন-রোজেন ব্রিজ বা সেতু তৈরি হয়।
ঘটনা-দিগন্ত অঞ্চলে এই সেতু ব্যবহার করে মহাবিশ্বের এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় শর্টকাট উপায়ে যাওয়া সম্ভব এবং সেটি আলোর চেয়েও দ্রুতবেগে। তবে এক কৃষ্ণগহ্বর দিয়ে ঢুকে আরেক কৃষ্ণগহ্বর দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার বিষয়টি আন্তনাক্ষত্রিক অভিযাত্রীদের মনে আশা জাগালেও একটা বিপদও আছে এখানে। কারণ, প্রথম কৃষ্ণগহ্বরের ঘটনাদিগন্তের যতই কাছাকাছি যাওয়া যাবে, ততই মহাকর্ষের টান বাড়তে থাকবে। একসময় আন্তনাক্ষত্রিক অভিযাত্রীসহ তার নভোযান সেমাইয়ের মতো পরমাণুর স্রোতে পরিণত হবে। কাজেই ভবিষ্যতে এই সুড়ঙ্গ ব্যবহার করার আগে একটু ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করে নেওয়া ভালো।
আবার অতি ভারী নক্ষত্র চুপসে জন্ম নেওয়া কৃষ্ণগহ্বরের যে সব সময় ওয়ার্মহোল থাকবেই, তারও কোনো গ্যারান্টি নেই। এমনও হতে পারে, ওই কৃষ্ণগহ্বরে শুধু একটিই প্রান্ত তৈরি হলো। অন্য আরেকটি কৃষ্ণগহ্বরের সঙ্গে হয়তো ওই প্রান্তের কোনো সংযোগ তৈরি হলো না। এ রকম ঘটলে আন্তনাক্ষত্রিক অভিযাত্রীদের জন্য বিরাট একটা দুঃসংবাদই বলতে হবে।
পদার্থবিদেরা গতানুগতিক কৃষ্ণগহ্বরগুলোর মধ্যে তাত্ত্বিক সেতুগুলোকে অতিক্রম অযোগ্য ওয়ার্মহোল বলে বর্ণনা করেন। তাহলে কি আর কোনো উপায় আছে? হ্যাঁ আছে। এ ব্যাপারে একটি উপায় বাতলে দিয়েছেন ২০১৭ সালে নোবেল বিজয়ী ক্যালটেকের তাত্ত্বিক পদার্থবিদ কিপ থর্ন। দুটি প্রান্তে থাকা সুড়ঙ্গ তাদের চারপাশের বিশেষ ধরনের পদার্থের বিস্ফোরণে পরিবর্তন করা সম্ভব। এই বিশেষ পদার্থ এক্সোটিক ম্যাটার নামে পরিচিত। মোটা দাগে, এক্সোটিক ম্যাটার হলো নেগেটিভ বা ঋণাত্মক শক্তিসম্পন্ন বস্তু। চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞানে কোনো বস্তুর ঋণাত্মক শক্তি থাকে না। কারণ, পরোক্ষভাবে এতে মাধ্যমে ঋণাত্মক ভর থাকার কথা বলে। তবে কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানে মাইক্রোস্কোপিক স্কেলে ঋণাত্মক শক্তি সহজলভ্য।
তাত্ত্বিকভাবে থর্নের এক্সোটিক ম্যাটার বিস্ফোরণে প্রতিটি কৃষ্ণগহ্বরের জ্যামিতি পাল্টে গিয়ে আইনস্টাইন-রোজেন সেতুর প্রান্তগুলো ঘটনাদিগন্তের বাইরে নিয়ে আসে। আর তাতে সুড়ঙ্গের ভেতর দিয়ে এক প্রান্ত থেকে আলোর চেয়ে বেশি আরেক প্রান্তে পৌঁছানো যাবে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, অতি উন্নত কোনো সভ্যতা হয়তো কোয়ান্টাম কণাকে এমন কোনোভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে এবং তা দিয়ে তাদের পক্ষে একটা ওয়ার্মহোল বানানোও সম্ভব। কিন্তু এ ধরনের দুই প্রান্তওয়ালা ওয়ার্মহোলেরও কিছু সমস্যা আছে। প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট দুটি কৃষ্ণগহ্বর পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে এ রকম সুড়ঙ্গ তৈরি করবে, তারও কোনো গ্যারান্টি নেই।
অবশ্য স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ড্যানিয়েল জ্যাফারিস এবং অ্যারন ওয়াল সম্প্রতি নতুন আরেক ধরনের ওয়ার্মহোল থাকার সম্ভাবনার কথা বলেছেন। এদের প্রান্তগুলো প্রাকৃতিকভাবেই পরস্পর সংযুক্ত হবে। এমনকি এদের মধ্যে সংযোগের জন্য কোনো এক্সোটিক ম্যাটারের দরকার নেই। বিখ্যাত ইপিআর প্যারাডক্স (আইনস্টাইন-পোলানস্কি-রোজেন প্যারাডক্স) নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তাঁরা এই সমাধান পেয়েছেন। ইপিআর প্যারাডক্স অনুযায়ী, একজোড়া কণার মধ্যে বিশেষ একধরনের ধর্ম থাকে, যাকে বলে কোয়ান্টাম অ্যান্টেঙ্গলমেন্ট বা কোয়ান্টাম বিজড়ন। এই ধর্ম অনুযায়ী, মাইক্রো স্কেলের ওয়ার্মহোলের মাধ্যমে মহাবিশ্বের দূর প্রান্তের থেকেও পরস্পরের মধ্যে সংযোগ রক্ষা করে। অ্যান্টেঙ্গলমেন্ট কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যার একটি ধারণা। এটি সাধারণত অতিপারমাণবিক কণাতে ব্যবহার করা হয়। একজোড়া অ্যান্টেঙ্গল ইলেকট্রন তৈরি করা সম্ভব, যাদের ঘূর্ণন বা স্পিন অনিবার্যভাবে পরস্পরের বিপরীত। ইপিআরের অনেক কিছুই এখনো আমাদের অজানা থাকলেও এর মাধ্যমে বোঝা যায় যে একজোড়া অ্যান্টেঙ্গল কৃষ্ণগহ্বরের মধ্যে একটি সুড়ঙ্গ প্রাকৃতিকভাবেই তৈরি হতে পারে। যদিও এই সুড়ঙ্গ নন-ট্রান্সভার্স, অর্থাৎ এর ভেতর দিয়ে আমাদের পক্ষে চলা অসম্ভব।
এ কথা সত্য হলে এক জোড়া কৃষ্ণগহ্বরে কোয়ান্টাম প্রক্রিয়া কাজে লাগিয়ে এ ধরনের ওয়ার্মহোলকে আমাদের চলার উপযোগী বা ট্রান্সভার্স করা সম্ভব। কসমোলজির ইপিআর মডেল সঠিক হলে ওই কৃষ্ণগহ্বর সিস্টেমে কিছু সমতুল্য ঋণাত্মক শক্তি যোগ করে আইনস্টাইন-রোজেন ব্রিজের জ্যামিতি পরিবর্তন করে চলার উপযোগী সুড়ঙ্গ তৈরি করা সম্ভব। আগের দুটি কৃষ্ণগহ্বরের বাইরের পথের সঙ্গে তুলনা করলে এই ওয়ার্মহোলের ঘটনা-দিগন্তের পেছনের পথ সব সময় লম্বা হবে। দুর্ভাগ্যক্রমে এই ধরনের ওয়ার্মহোল দিয়ে আলোর চেয়ে বেশি বেগে মহাবিশ্বের কোনো দূরত্ব পাড়ি দেওয়া সম্ভব নয়। সে কারণেই এখন মনে হচ্ছে, ওয়ার্মহোল ব্যবহার করে দূরের কোনো নক্ষত্র বা ছায়াপথে ভ্রমণে কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তবে ভবিষ্যতের বৈপ্লবিক কোনো আবিষ্কারে এ সীমাবদ্ধতা ঝেড়ে ফেলার কোনো সম্ভাবনা নেই, সেটা ভাবাও বোকামি হবে। তখন হয়তো আলোর চেয়েও বেশি বেগে পথ পাড়ি দেওয়ার কোনো উপায়ও হাতের মুঠোয় চলে আসতে পারে।
আলোর গতিসীমার চোখে ধুলো দেওয়ার জন্য ওয়ার্মহোল ছাড়াও আরেকটি পদ্ধতির নাম র৵াপ ড্রাইভ। এই পদ্ধতিতে বাবল তৈরি করে কোনো নভোযানের চারদিকের স্থান-কাল সরাসরি বাঁকিয়ে দেওয়া হয়। এখানে নভোযানের ভেতরেও আলোর স্থানীয় বেগ কখনো সীমা ছাড়ায় না। তবে বিশেষ আপেক্ষিকতা সূত্র অনুসারে, এতটাই বাঁকানো সম্ভব, যাতে বাবল বা বুদবুদটি নিজেই মহাকাশের বিপুল স্থানজুড়ে আলোর চেয়ে বেশি বেগে চলতে পারে। আর বুদবুদটি সঙ্গে করে নভোযানটাও নিয়ে যাবে।
ষাটের দশক থেকেই বিজ্ঞান কল্পকাহিনিগুলোতে র্যাপ ড্রাইভ ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে ১৯৯৪ সালেই প্রথমবারের মতো মেক্সিকান পদার্থবিদ মিগুয়েল আলকুবিরি বাস্তবে কাজ করতে পারার মতো কোনো র্যাপ ড্রাইভের প্রস্তাব দেন। সাধারণ আপেক্ষিকতায় স্থানের যে নমনীয়তা আছে, সেটি স্থানের মধ্যে একটি তরঙ্গের সৃষ্টি করতে পারবে বলেও দেখিয়েছেন মিগুয়েল। এই তরঙ্গের মধ্যেই চলমান কোনো নভোযানের সামনের স্থান সংকুচিত হয়ে যাবে এবং তার পেছনের স্থান প্রসারিত হবে। এখানে নভোযানটি বুদবুদের ভেতরে তরঙ্গের ঠিক মধ্যখানে স্বাভাবিক সমতল স্থানে থাকতে পারবে। তরঙ্গটি নিজেই আলোর চেয়ে বেশি বেগে মহাবিশ্বের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে কার্যকরভাবে তরঙ্গায়িত হতে থাকবে।
ওয়ার্মহোলের মতো একটি কার্যকর র্যাপ ড্রাইভ বানানোর ক্ষেত্রেও আমাদের বিপুল প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এখানেও তরঙ্গের কাঠামো সৃষ্টির জন্য এক্সোটিক ম্যাটার প্রয়োজন। কিন্তু কীভাবে করা সম্ভব, সেটি চিন্তা করতে গিয়ে পদার্থবিদেরা যেসব পদ্ধতির কথা বলেন, তা হয়তো অতি উন্নত কোনো সভ্যতার পক্ষেই অর্জন করা সম্ভব। কারণ, এ ধরনের কোনো তরঙ্গ কাঠামো তৈরির জন্য বৃহস্পতির মতো দানবীয় কোনো গ্রহের সমান শক্তি দরকার।
এদিকে ২০১১ সালে নাসার জনসন স্পেস সেন্টারের অ্যাডভান্সড প্রোপালশন ফিজিকস ল্যাবরেটরির প্রকৌশলী হ্যারল্ড জি সোনি হোয়াইট একটু অন্য রকম র্যাপ ড্রাইভের প্রস্তাব করেছেন। এতে সমতল স্থানসম্পন্ন বুদবুদ প্রয়োজন হবে না। এখানে শক্তিও লাগবে অনেক কম। এটি মাত্র কয়েক কিলোগ্রাম ভর-শক্তি হলেই চলবে। অবশ্য বর্তমানের হিসাবে এটি বিপুল পরিমাণ শক্তি। এর মাধ্যমে এমন বড় আর টেকসই তরঙ্গ তৈরি করা সম্ভব হবে যে তা দিয়ে গোটা একটা স্পেসশিপ চালিয়ে নেওয়া যাবে।
এসব দেখে মনে হয়, আলোর চেয়ে বেশি বেগে চলার কোনো উপায় হয়তো আছে। মজার ব্যাপার হলো, নাসার গবেষণাগারে তাত্ত্বিকভাবে র্যাপ ড্রাইভ পরীক্ষা করে দেখার চেষ্টা করা হচ্ছে। সে জন্য যে যন্ত্রটি ব্যবহার করা হচ্ছে, তার নাম র্যাপ ফিল্ড ইন্টারফেরোমিটার। তাত্ত্বিকভাবে যন্ত্রটি সম্ভাব্য র্যাপ সৃষ্টিকারী কোনো যন্ত্রের মাধ্যমে সৃষ্ট স্থানের জ্যামিতিতে খুবই ক্ষুদ্র পরিবর্তন শনাক্ত করতে পারবে।
তাত্ত্বিক পদার্থবিদ মিচিও কাকুর মতে, টাইপ থ্রির মতো উন্নত কোনো এলিয়েন সভ্যতা হয়তো এরই মধ্যে আলোর গতির সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে পেরেছে। তবে এ ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করতে যে পরিমাণ শক্তির প্রয়োজন, তা অর্জন করতে আমাদের মতো কোনো সভ্যতার আরও এক হাজার বছর কিংবা তার চেয়ে বেশি সময় লেগে যেতে পারে। তাই আপাতত এক হাজার বছর অপেক্ষা করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। আমাদের মতো মরণশীলদের জন্য সময়টা হয়তো একটু বেশিই হয়ে যায়। তাই তত দিন অপেক্ষা না করে হয় নতুন কোনো উপায় খুঁজে বের করতে হবে, নয়তো সময়টা অন্য কাজে লাগানোই ভালো।
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা
সূত্র: অল অ্যাবাউট স্পেস ম্যাগাজিন এবং উই হ্যাভ নো আইডিয়া/ জর্জ চাম ও ড্যানিয়েল হোয়াইটসন; ফিজিকস অব দ্য ইম্পসিবল/মিচিও কাকু