তানজিনা সুলতানা শাহীন: লেদার শব্দটা শুনলে যে বিষয়টা প্রথমে মাথায় আসে, আরে এতে তো অনেক প্রাণীর চামড়া প্রয়োজন! জ্যাকেট, প্যান্ট, জুতা, ব্যাগ, বেল্ট তৈরিতে চামড়ার ব্যবহার অনেক আগে থেকেই। দিন দিন এসব পণ্যের চাহিদা আরও বাড়ছে। আর এর প্রয়োজন মেটাতে হত্যা করা হয় কুমির, ঘড়িয়াল, গন্ডার, সাপ, গিরগিটির মতো বন্য প্রাণীসহ লাখ লাখ প্রাণীকে। বন্যপ্রাণীহত্যা ও চামড়া প্রক্রিয়াজাতের ফলে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। চামড়ার পণ্যের জন্য সবচেয়ে বেশি কাজে লাগানো হয় গরুর চামড়া। এই প্রাণী প্রচুর গ্রিনহাউস গ্যাস ও বর্জ্য উৎপাদন করে। তা ছাড়া চামড়া ট্যানিংয়ের সময় যে বর্জ্য নিঃসৃত হয় এবং যেসব কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়, উভয়ই পরিবেশের পাশাপাশি শ্রমিকদের শরীরের জন্যও ক্ষতিকর।
তবে আজ এমন এক ধরনের লেদার নিয়ে কথা বলব, যা তৈরি করতে কোন প্রাণী হত্যার প্রয়োজন নেই। এ ধরনের লেদারকে বলা হয় ভেগান লেদার, যা তৈরিতে কোন প্রাণীর চামড়া ব্যবহৃত হয় না, একে কৃত্রিম চামড়াও বলা হয়। তবে প্রাকৃতিক চামড়ার মতোই, তেমন কোন পার্থক্য নেই। বিভিন্ন উপায়ে ভেগান লেদার তৈরি করা হয়। তবে আমরা আজকে আলোচনা করবো, আম থেকে কিভাবে ভেগান লেদার তৈরি করা হয় তা নিয়ে।
ফ্রুটলেদার নামে একটি ডাচ কোম্পানি আম( যেসব আম সাধারণত নষ্ট বলে ফেলে দেয়া হয়) থেকে ভেগান চামড়া উৎপাদন শুরু করেন। ফ্রুটলেদারের প্রতিষ্ঠাতা হুগো ডি বুন এবং সহ-প্রতিষ্ঠাতা কোয়েন মেরকার্ক ২০১৫ সালে ফ্রুটলেদারের জন্য প্রথম ধারণা নিয়ে আসেন। হুগো এবং তার পরিবার ১৯৫২ সাল থেকে চামড়া ব্যবসায় রয়েছে, কিন্তু এই প্রথম তারা ভেগান চামড়া প্রক্রিয়াজাত করছে। সহ-প্রতিষ্ঠাতার স্বপ্ন চামড়া শিল্পকে আরও পরিবেশবান্ধব করার পাশাপাশি খাদ্যের অপচয় কমানো।
ভেগান চামড়া তৈরি করা হয় হাজার হাজার নষ্ট আম থেকে,যা সাধারণত ফেলে দেয়া হয়। এখন এই অপ্রয়োজনীয় আমই মানিব্যাগ, হ্যান্ডব্যাগ এবং জুতা তৈরিতে ব্যবহার করা হচ্ছে। ভেগান লেদার প্রক্রিয়ার প্রধান কাজ কোন ফল ব্যবহার করতে হবে তা নির্ধারণ করে। প্রথমে তারা তরমুজ ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন কিন্তু তরমুজের ভিতরে তেমন ফাইবার নেই, আছে মূলত জল। পরে তারা জানতে পেরেছিলেন যে ইউরোপের অর্ধেকেরও বেশি আম নেদারল্যান্ডে আমদানি হয় এবং নেদারল্যান্ডে আমের প্রায় ১২% নষ্ট হয়। তাই তারা এই নষ্ট আমই তাদের পদ্ধতির জন্য ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেন।
প্রথমে আমদানিকারকের কাছ থেকে প্রতি সপ্তাহে প্রায় ১৫০০ আম সংগ্রহ করা হয়। আম কেটে একটি মেশিনে প্রবেশ করানো হয় যেখানে পাথর থাকলে তা আলাদা হয়ে যায়। তারপর আমগুলোকে পাল্পে পরিণত করা হয়। তারপরে একটি টিউবের মাধ্যমে পাল্পের মিশ্রণটি একটি বড় ভ্যাটে স্থানান্তর করা হয়। পরে কিছু অ্যাডিটিভ মিশ্রিত করা হয় যা আমের পাল্পকে চামড়ার মতো উপাদানে পরিণত করে। উপাদানের পরিমাপ সঠিক কিনা তা পরীক্ষা করার জন্য একটি মিটার ব্যবহার করা হয়। যখন পরিমাপ সঠিক দেখায় মিশ্রণটিকে ধাতব বেকিং ট্রে-তে ঢেলে দেয়া হয় এবং মিশ্রণটিকে মসৃণ করা হয় যেন ট্রে-তে পুরোটা জুড়ে সমান পুরুত্ব তৈরি করে।
তারপর ট্রেগুলো এক রাত ডিহাইড্রেটরে যান রাখা হয়। শুকানোর আগে সবসময় মিশ্রণটি হালকা ক্রিম রঙের থাকে কিন্তু শুকানোর পর আমের ধরন অনুযায়ী এটি দেখতে একেবারেই আলাদা হয়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ, পামার আম হলে এর রঙ বাদামী হয় এবং কেইট আম হলে কালো হয়। তারপর শীটগুলো লেদার-ফিনিশিং এ যায়, যেখানে এদের উপর একটি প্রতিরক্ষামূলক গ্লেজ দিয়ে এক ধরনের প্রলেপ দেয়া হয়। শীটগুলোকে একটি পরিবাহকের সাহায্য ওভেনের মধ্যে দিয়ে পাস করানো হয়, সেখানে ১০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপ প্রলেপটিকে শুকাতে সাহায্য করে। তারপরে শীটগুলো সম্পূর্ণরূপে ঠান্ডা করা এবং শুকানো হয়। শীটগুলোকে আরও বেশি টেকসই করতে একাধিকবার এই প্রক্রিয়াটি পুনরাবৃত্তি করা হয় মানে একাধিক প্রলেপ দেয়া হয় শীটগুলোর উপর। এরপর একটা মেশিনের সাহায্যে একাধিক প্রলেপের স্তরগুলিকে একত্রিত করার জন্য তাপ এবং চাপ প্রয়োগ করা হয়।
ভেগান লেদার উৎপাদনের চূড়ান্ত ধাপ হল নকশা। এই প্রক্রিয়ার জন্য একটি এমবসিং মেশিন ব্যবহার করা হয় যা ভেগান লেদারকে ঠিক পশুর চামড়ার মতো দেখতে তৈরি করে। তারপর সারা বিশ্বের ডিজাইনারদের কাছে এই লেদার বিক্রি করা হয়।