যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া। এক সন্ধ্যায় একজন টিউমারের রোগীর অপারেশন করতে গিয়ে ডাক্তার পল কালানিথি বড় বিব্রত হয়ে পড়লেন। তাঁর হিসাবমতে, অপারেশনের মাঝখানেই রোগীর চুপ হয়ে যাওয়ার কথা, কিন্তু তার কোনো লক্ষণই নেই। সে অনবরত কথা বলে যাচ্ছে, ‘ডাক্তার সাহেব কি টিউমারটা ফেলে দিলেন? আর কতক্ষণ লাগবে? এই সামান্য কাজটা করতে আপনার এত সময় লাগে কেন?’ এবং ইত্যাদি।
সময় লাগার ব্যাপারটা আশ্চর্যের নয়, কারণ সেই রোগীর টিউমারটা ছিল মস্তিষ্কের টিউমার। এই ধরনের টিউমারের অপারেশন করা যে শুধু জটিল—তা–ই নয়, সেটা করতেও হয় অত্যন্ত সাবধানে। এক ইঞ্চি তো বটেই, সামান্য এক মিলিমিটার ডানে-বাঁয়ে অপারেশন করে ফেললেও বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে। তাই প্রায়ই অপারেশন করা হয় রোগীকে জাগিয়ে রেখেই।
তবে পুরোপুরি জাগ্রত রোগীর তো আর মাথা কেটে ভেতরের মস্তিষ্ক নিয়ে নাড়াচাড়া করা সম্ভব নয়, ব্যথাতেই সে চিৎকার করতে করতে অজ্ঞান হয়ে যাবে, তাই মাথার নির্দিষ্ট অংশে প্রথমে অ্যানেসথেসিয়া দেওয়া হয়। এরপর সেই জায়গাটা অবশ হয়ে যায়, রোগীর আর কোনো অনুভূতি কাজ করে না মাথার ওইটুকু অংশে। তখন মাথার চামড়ার নিচে ড্রিল দিয়ে ছোট্ট করে ফুটো করা হয়। সেই ফুটোর ভেতর দিয়ে সার্জনরা অপারেশন করেন। কিন্তু ফুটোটা যে মাথার ঠিক জায়গাতেই করা হয়েছে, সেটা বোঝা যাবে কীভাবে? এই কাজটা করার জন্য মাথার ভেতরে একটা ইলেকট্রোড ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। এই ইলেকট্রোড জিনিসটা দেখতে কিছুটা লম্বা-সরু স্ক্রু ড্রাইভারের মতো। এটার কাজ মস্তিষ্ককে ছোটখাটো বিদ্যুতের শক দেওয়া। সামান্য একটু শক। এতে কেউ ব্যথাও পায় না, মরেও যায় না। তবে ছোটখাটো কিছু লক্ষণ দেখে সার্জনরা বুঝতে পারেন, ঠিক জায়গাতে অপারেশন করা হচ্ছে কি না। এই লক্ষণগুলো দেখার জন্যই রোগীকে জাগিয়ে রাখা প্রয়োজন।
এই যেমন মস্তিষ্কে ইলেকট্রোড ঢুকিয়ে দিয়ে কাউকে হয়তো আঙুল নাড়াতে বলা হয়। যদি নাড়াতে না পারে, এর অর্থ মস্তিষ্কের সেই জায়গাটা মানুষের আঙুল নাড়ানো নিয়ন্ত্রণ করে। সেটা ভুলে কেটে ফেললে রোগীর বাকি জীবনের মতো আঙুল নাড়ানোর ক্ষমতা হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। একইভাবে মস্তিষ্কের যে অংশগুলোর কারণে আমরা কথা বলতে পারি, সেখানে যদি কোনো গোলমাল হয়, তাহলে কথা বলার ক্ষমতাটাও হারিয়ে যেতে পারে। আমাদের মস্তিষ্কের দুটো অংশ আছে, যেগুলো আমাদের ভাষাকে নিয়ন্ত্রণ করে। এগুলোর নাম ভারনিকার স্থান এবং ব্রোকার স্থান। এর প্রথমটা দিয়ে আমরা মানুষের ভাষা বুঝতে পারি। এই লেখাটা আপনি যখন পড়ছেন, তখন আপনার মস্তিষ্কে এই ভারনিকার অংশটুকু কাজ করছে। এ কারণেই লেখাটার অর্থ আপনি বুঝতে পারছেন। আর ব্রোকার অংশের কাজ ঠিক উল্টোটা। এটা কাজ করে কথা বলতে গেলে। কিছু একটা চিন্তা করে আপনি যখন কথা বলেন, তখন আপনার মস্তিষ্কের ব্রোকার অংশটা কাজ করে। মস্তিষ্কের এই দুই অংশে যদি টিউমার হয়, তখন অদ্ভুত কিছু ঘটনা ঘটে। এই টিউমার অপসারণের সময়ও রোগীকে জাগিয়ে রাখতে হয় এবং তাকে সারাক্ষণ কথা বলতে বলা হয়। কখনো আশপাশের জিনিসপত্র দেখিয়ে ওগুলোর নাম জিজ্ঞেস করা হয়। কখনো হয়তো বর্ণমালা পড়তে বলা হয়। একই সঙ্গে তার মাথার ভেতরে ঢোকানো থাকে একটা ইলেকট্রোড। একটু পরপর সেটা দিয়ে বিদ্যুতের সিগন্যাল পাঠানো হয়। রোগী হয়তো বর্ণমালা পড়ছে, ভুল জায়গায় ইলেকট্রোড ঢোকালে তখন সে আর কথা বলতে পারে না, ‘ক, খ, গ, ঘ্ররররর, ভ্রররররমম, হফফফ, ঘ, ঙ, চ, ছ—’ এভাবে কথা বলতে শুরু করে। সেটা দেখে দেখে সার্জনরা ঠিক করেন মস্তিষ্কের কোথায় নিরাপদে অপারেশন করা যাবে, আর কোন জায়গায় একেবারেই হাত দেওয়া যাবে না! তবু কখনো কখনো একেবারেই উপায় থাকে না। হয়তো টিউমারটা এমন এক জায়গায় হয়েছে, সেটা কাটলে ভারনিকা বা ব্রোকার অংশটুকুর পুরোটা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তখন নিরুপায় হয়ে সেই অপারেশনটা করতে হয়।
যদিও কেবল টিউমার নয়, মানুষের মস্তিষ্কের কথা বলার অংশগুলো প্রায়ই ক্ষতিগ্রস্ত হয় স্ট্রোকের কারণে। কারও কারও ক্ষেত্রে মাথায় আঘাত পাওয়ার পরও এই সমস্যা দেখা দিতে পারে। তখন যে অবস্থা হয়, সেটার নাম অ্যাফেশিয়া। মস্তিষ্কের ভারনিকার অংশটুকু মানুষকে ভাষা বুঝতে সাহায্য করে। তাই যদি এই অংশে কোনো সমস্যা হয়, তখন রোগী অন্যদের কথাও বোঝে না, নিজেও কিছু বোঝাতে পারে না। এই ব্যাপারটাকে বলে ভারনিকার অ্যাফেশিয়া। এর অর্থ কিন্তু এই নয়, মানুষটা পাগল হয়ে গেছে। তার মাথার ভেতরে সব আগের মতোই ঠিকঠাক আছে, চিন্তাভাবনাগুলো স্বাভাবিকভাবেই ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু কেবল কথা বলতে গেলে সে আজগুবি-উদ্ভট কিছু শব্দ বলবে। মেগান সাটন নামে একজন প্যাথলজিস্ট আছেন। তাঁর রোগীদের মধ্যে এক বৃদ্ধ আছেন, যিনি ভারনিকার অ্যাফেশিয়ায় আক্রান্ত। সেই বৃদ্ধের সঙ্গে মেগান সাটনের কথোপকথন ছিল এমন—
সাটন: হাই বায়রন, কেমন আছেন?
বৃদ্ধ: আমি খুশি। তুমি কি সুন্দর?
সাটন: কী করছেন আজকে?
বৃদ্ধ: আমরা এদিকে পানির সঙ্গে ছিলাম আর মানুষের সঙ্গে তাদের জন্য ওদিকে কথা বলছিলাম। তারা তাদের জন্য ঝাঁপ দিচ্ছে এখন। কিন্তু তারা এই মুহূর্তে দ্রুত পানি ধরে বেঁচে থাকবে। ছেলেটার জন্য। ভাগ্যক্রমে, ছেলেটার জন্য!
সাটন: আপনি তাহলে নৌকায় করে—
বৃদ্ধ: (মিষ্টি হেসে) আমরা এখানে গুছিয়ে নেব আর তারা ওদিকে তাদের হাত বাঁচাবে। তাদের জন্য।
সাটন: আমরা এইমাত্র কী করছিলাম, বলুন তো?
বৃদ্ধ: উমম, এই মুহূর্তে অবশ্য...কিছুই দেখা যাচ্ছে না...হা হা হা! আমার নিজেকে পাল্টাতে আর হাত পাল্টাতে ভালোই লাগে। আমি খুবই খুশি গলফ খেলে। গাছের মধ্যে বল মারি। আমরা হাত বাঁচিয়ে খেলি। আর প্রচুর হাত বাঁচাই, আর মানুষকে ধরে রাখি আমাদের জন্য। অন্যান্য হাত। আমি জানি না তুমি বুঝতে পারলে কি না, কিন্তু আমি তার জন্য প্রচুর হাত নিয়ে কথা বলি। মাঝেমধ্যে। আর কিছু কি বলা হলো!
সাটন: আচ্ছা, আপনাকে ধন্যবাদ!
বৃদ্ধ: তোমাকেও। এই ব্যাপারটার প্রশংসা করছি। আশা করি পৃথিবীটা তোমার জন্য ঘুরতে থাকবে।
এই বৃদ্ধের মতো যাঁরা ভারনিকার অ্যাফেশিয়ায় আক্রান্ত, তাঁরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নিজেরাও বুঝতে পারেন না যে তাঁদের ভাষাবিষয়ক কোনো সমস্যা আছে। যেহেতু তাঁরা স্বাভাবিকভাবেই চিন্তা করতে পারেন এবং অর্থহীন হলেও গড়গড় করে কথা বলতে পারেন, তাই তাঁদের কাছে সবকিছু ঠিকঠাক মনে হয়।
ব্রোকার অংশের ক্ষতি হলে ঘটে মোটামুটি উল্টো একটা ব্যাপার। তখন রোগী অন্যদের কথাবার্তা সবই বুঝতে পারেন। কেবল নিজে কথা বলতে গেলে আর শব্দ খুঁজে পান না।
আবারও প্যাথলজিস্ট মেগান সাটনেরই উদাহরণ দিই। ব্রোকার অ্যাফেশিয়ায় আক্রান্ত এক প্রৌঢ়ের সঙ্গে তাঁর কথোপকথনটা হয় এ রকম—
সাটন: আপনার নাম বলুন তো?
প্রৌঢ়: (বেশ কষ্ট করে) মাইক...কাপুটো।
সাটন: আপনার পাশে কে বসে আছে এখন?
প্রৌঢ়: আমার...স্ত্রী!
সাটন: তিনি আপনাকে কথা বলায় সাহায্য করছেন কেন?
প্রৌঢ়: উমম...আমি...কথা...উম…(এটুকু বলে আটকে গেলেন)
সাটন: যেন আপনি সহজে কথা বলতে পারেন?
প্রৌঢ়: হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওটাই!
সাটন: দারুণ। আপনি কি একটু আমাকে বলবেন, অ্যাফেশিয়া হলে কেমন লাগে?
প্রৌঢ়: উম, এটা...এটা...এটা কষ্টের। এটা...উম...কথা। এটা হচ্ছে...কথা বোঝা যাবে না...। মাথায় আবার সব ঠিক, কিন্তু...উমম...কথা হচ্ছে...জানি না...কথা এমন যে...ইয়াক! (হেসে ফেললেন)
অর্থাৎ ব্রোকার অ্যাফেশিয়ায় আক্রান্ত মানুষের ভাষা বুঝতে কোনো সমস্যা হয় না, তিনি শব্দগুলোও সব জানেন, কিন্তু নিজে কথা বলতে গিয়ে কিছুতেই সেগুলো মনে করতে পারেন না।
ভারনিকা বা ব্রোকা ছাড়াও আরও বেশ কিছু ধরনের অ্যাফেশিয়া হতে পারে মানুষের।
এমন আরও একজন অ্যাফেশিয়া রোগীর কথা পল কালানিথি লিখেছেন তাঁর বই হোয়েন ব্রেথ বিকামস এয়ার-এ। তিনি মেডিকেলে পড়ার সময় এক সকালে হাসপাতালের ভেতরে হাঁটছিলেন। তখন এক রোগী এসে তাঁর সামনে দাঁড়ায় এবং শান্ত কণ্ঠে বলে, ‘চার ছয় এক আট নয়।’
পল লিখেছেন, তিনি বেশ কিছুক্ষণ সেই রোগীর সঙ্গে কথা বলেছিলেন। চেষ্টা করেছিলেন এসব সংখ্যার ভেতর থেকে ভাবনাগুলো উদ্ধার করতে। কিন্তু নিখাদ সংখ্যার চেয়ে বেশি কিছু বলা সেই রোগীর পক্ষে সম্ভব ছিল না। পলের পক্ষেও স্রেফ সংখ্যা শুনে কিছু বোঝার উপায় ছিল না। সেদিন তিনি ফিরে আসার আগে সেই রোগী তাঁর হাত ধরে বারবার মিনতি করে বলেছিল, ‘চৌদ্দ এক দুই আট, চৌদ্দ এক দুই আট!’
এর চেয়েও নিদারুণ ব্যাপার পৃথিবীতে ঘটে। কিছু অ্যাফেশিয়ার রোগী শুধু একটা শব্দ বলতে পারে। কেউ হয়তো কেবল ‘মাটি’ শব্দটা বলে। সে যা–ই চিন্তা করুক, কথা বলার সময় ক্রমাগত সে ‘মাটি-মাটি-মাটি’ বলতে থাকবে।
একটা কথা মনে রাখা প্রয়োজন যে এই রোগীদের সমস্যাটা কেবল ভাষা নিয়ে। তাদের আবেগ-অনুভূতি-আনন্দ-দুঃখ—সবই আগের মতো থাকে। ফলে একটা শব্দও যদি তারা বলতে পারে, সেটাই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বিভিন্ন সুরে দিন–রাত বলতে থাকে।
এই রোগীদের কী হয়?
অ্যাফেশিয়ার সমস্যাটাকে খানিকটা জটিলই বলতে হবে। যেহেতু মস্তিষ্কের ক্ষতি হওয়ার কারণে এই সমস্যা তৈরি হয়, তাই দু-এক দিনে এর নিরাময়ও করা যায় না। এদিকে অ্যাফেশিয়া রোগীরা যেহেতু অন্য মানুষের সঙ্গে ঠিকঠাকমতো যোগাযোগ করতে পারে না, তাদের অনেকেই শেষ পর্যন্ত হতাশা, বিষাদগ্রস্ততার মতো বিভিন্ন মানসিক সমস্যায় ভুগতে শুরু করে।
তবে কিছু থেরাপি আছে, যেগুলো দিলে রোগীর অবস্থা ধীরে ধীরে ভালো হতে থাকে। যেমন ব্রোকার অ্যাফেশিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের একটা চিকিৎসা হলো তাদের হাতে ছবির তালিকা ধরিয়ে দেওয়া। সেখানে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের ছবি দেওয়া থাকে, সঙ্গে নামও দেওয়া থাকে। রোগী যদি কথা বলার সময় কোনো কিছুর নাম একেবারেই মনে করতে না পারে, তখন সে ছবির তালিকা থেকে সাহায্য নেয়।
এই থেরাপিগুলো সহজ ও বেশ কাজের।
সারা বিশ্বেই অ্যাফেশিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের সামাজিকভাবে অবহেলা করার একটা সংস্কৃতি আছে। এমন রোগীর সঙ্গে কথাবার্তা চালিয়ে যাওয়াও ধৈর্যসাপেক্ষ ব্যাপার বটে। তবু চারপাশের মানুষের একটু সাহায্য পেলে অ্যাফেশিয়ার সমস্যাগুলো অনেকখানি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
লেখক: শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়
সূত্র: হোয়েন ব্রেথ বিকামস এয়ার, পল কালানিথি ও ট্যাকটাসথেরাপি ডট কম
বিজ্ঞানচিন্তা থেকে সংগৃহীত