টাইম ট্রাভেল বা সময় ভ্রমণ। এটি আসলে সময়ের অক্ষ বরাবর ভ্রমণ। আমরা সকলেই তিনটি মাত্রা সম্পর্কে অবগত, দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এবং উচ্চতা। এই তিনটি মাত্রা বরাবর স্থান পরিবর্তন সম্ভব। তবে ন্যূনতম চতুর্মাত্রিক একটি ধারণা হচ্ছে সময়ের ধারণা। আজ পর্যন্ত এই চতুর্থ মাত্রা দিয়ে স্থান পরিবর্তন সম্ভব হয়নি। এই সময়ের অক্ষ বরাবর স্থান পরিবর্তনকে কালমাত্রিক সরণ বলা হয়। এক সময় থেকে আরেক সময়ে পরিভ্রমণকেও আমরা সময় ভ্রমণ বলে থাকি। এটি হতে পারে অতীতে ভ্রমণ, হতে পারে ভবিষ্যতে ভ্রমণ। আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান কিন্তু টাইম ট্রাভেল বা সময় ভ্রমণ নিয়ে একদমই বসে নেই।
পদার্থবিদ্যায় টাইম ট্রাভেল এবং সম্ভাবনা
তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যা বলে যে একটা কথা আছে, সেই অনুযায়ী টাইম ট্রাভেল সম্ভব। কিন্তু এর মাধ্যমে শুধু অতীতে যাওয়া সম্ভব নয়। কেন সম্ভব নয় তা পরে ব্যাখ্যা করছি। কিন্তু হ্যাঁ, ভবিষ্যত ভ্রমণ সম্ভব। তবে সিনেমা বা সায়েন্স ফিকশনের নানা কমিকসের মতো গোল টাইম মেশিন বানিয়ে তা সম্ভব কিনা সে কথা জানা নেই। কিছুদিন আগে বিবিসিতে একটি খবর এসেছিল যে University of Connecticut-এর পদার্থবিদ্যার প্রফেসর রন ম্যালেট একটি ডিভাইস বানিয়েছেন যার আদলে ভবিষ্যতে টাইম মেশিন বানানো যাবে। বেশ আশার আলো দেখতে পাচ্ছি হয়তো! তবে তা কতদূর সম্ভব বা আদৌ সম্ভব কিনা, কিংবা সম্ভব হলেও আমাদের জীবদ্দশায় হবে কিনা সেই ব্যাপারটি পুরোপুরিই অনিশ্চিত। যাই হোক পদার্থবিদ্যায় ফিরে যাই।
অস্ট্রিয়ার প্রখ্যাত গণিতবিদ কুর্ট গডেল গণিতের মাধ্যমেই দেখিয়েছেন যে আমাদের এই ব্রহ্মাণ্ডে কিছু Closed Timelike Curve থাকা সম্ভব যা নির্দেশ করে সময়ভ্রমণও সম্ভব, তবে বিশেষ কিছু শর্তে। অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব অনুসারেও সময় ভ্রমণ সম্ভব। কীভাবে?
আপেক্ষিকতা অনুসারে কোনো বস্তু যখন আলোর গতিতে চলবে তখন তা হয়ে যাবে ভরশূন্য। আর যদি আলোর গতিতে চলে যায় তবে সময় স্থির হবে, মানে টাইম ট্রাভেল হবে। তার মানে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা অনুযায়ী তাত্ত্বিকভাবে সময় ভ্রমণ সম্ভব।
এখানে t হচ্ছে কোনো স্থির বস্তুর সাপেক্ষে সময়, t হচ্ছে গতিশীল বস্তুর সাপেক্ষে সময় এবং v ও c হচ্ছে যথাক্রমে বেগ ও গতি। এখন v যদি আলোর বেগের কাছাকাছি কোনো বেগ হয় তাহলে t কমতে থাকবে
ধরুন, আপনাকে আলোর গতিতে ছুটে চলতে পারে এমন কোনো একটি মহাকাশযানে উঠিয়ে দেয়া হল এবং আপনি ভ্রমণে বেরিয়ে পড়লেন মহাজগতের এপার থেকে ওপার। কিন্তু পৃথিবীতে এসে দেখবেন অনেক বছর সময় কেটে গেছে যেখানে আপনার কাছে মনে হবে মাত্র অল্প কিছু সময়। এভাবেই আইনস্টাইনের থিওরীতে সময় ভ্রমণের ফর্মুলা লুকিয়ে আছে।
এখন আসি ব্ল্যাকহোলের ব্যাপারে। ব্ল্যাকহোলের মাধ্যমে সময় ভ্রমণ কীভাবে সম্ভব? ব্ল্যাকহোল কী? ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বর হলো তারার খুব দুর্দশাপূর্ণ অবস্থা। তারাগুলো একেবারে চুপসে গিয়ে ভর একদম একটি বিন্দুতে এসে পৌঁছায়, যার ফলে স্থান কালের মাত্রা অসীম হয়ে যায়। সেখানে আলো প্রবেশ করলেও আর বের হয়ে আসতে পারে না। আবার আইনস্টাইনের Theory Of General Relativity অনুসারে ভর বেশি যতো, সময় ধীর হবে ততো।
আপনি যদি কোনো মহাকাশযান নিয়ে ব্ল্যাকহোলের আশপাশে ভ্রমণ করতে থাকেন আর অন্য একটি মহাকাশযান যদি পৃথিবীর চারদিকে ভ্রমণ করতে থাকে তবে ব্ল্যাকহোল ভ্রমণকারীর বয়স, পৃথিবীর চারপাশে ঘোরা ব্যক্তির বয়সের অর্ধেক হবে।
প্রশ্ন করতে পারেন আমি কেন ব্ল্যাকহোলের চারপাশে ঘোরার কথা বললাম। এর উত্তর হলো, ব্ল্যাকহোলে ঢুকলে আপনি আর বের হতে পারবেন না। সেখানে মহাকর্ষ বল অত্যধিক। আলোও বের হয়ে আসতে পারে না, যা আগেই বলেছি। ব্ল্যাকহোলের গ্রাভিটেশনাল ফিল্ডের শেষ সীমানাকে বলা হয় ঘটনা দিগন্ত, যা অতিক্রম করে ফেললে আপনাকে আর কোনোদিনও পাওয়া যাবে না। তাহলে ব্ল্যাকহোলের চারপাশে ঘুরপাক খাবেন আর সময় স্থির হতে থাকবে, পৃথিবীতে তার দ্বিগুণের মত সময় অতিবাহিত হয়ে যাবে।
এবার আসি ওয়ার্মহোলের ব্যাপারে। বলা হয়ে থাকে এটিই সবচেয়ে সম্ভাবনাময় উপায়। আমাদের একটি বিষয় জানা থাকা প্রয়োজন যে স্পেস বা মহাশূন্যের পথ কখনোই সমতল নয়। অর্থাৎ এটি বাঁকা পথে চলে। তাই আলো যখন মহাশূন্যের ভেতর দিয়ে ভ্রমণ করে, তখন এই বাঁকানো স্পেসের ভেতর দিয়ে একটি বাঁকানো পথে চলতে বাধ্য হয়। কিন্তু এই বাঁকা পথের পাশাপাশি আরও একটি সংক্ষিপ্ত রাস্তাও আছে। এই সংক্ষিপ্ত পথই হচ্ছে ওয়ার্মহোল।
ওয়ার্মহোলকে অনেক সময় আইনস্টাইন-রজেন ব্রিজ নামেও ডাকা হয়ে থাকে। ধরুন, আমাদের সৌরজগৎ থেকে আলফা সেন্টরাইতে যাবেন, আলোর গতিতে গেলে লাগবে ৪.৩ বছর। আবার আপনি ভরযুক্ত, তাই আপনার পক্ষে আলোর গতিতে ভ্রমণ সম্ভব নয়। কিন্তু ওয়ার্মহোলের মাধ্যমে সংক্ষিপ্ত পথ তৈরি করে আপনি সহজেই আলফা সেন্টরাইতে প্রবেশ করতে পারবেন, আবার নিজের সৌরজগতেও ফিরে আসতে পারবেন। তার মানে আপনি ভবিষ্যতেও যেতে পারবেন আবার অতীতেও ফিরে আসতে পারবেন। তবে অতীতে ফিরে আসা কতটুকু সম্ভব তা নিয়ে পরে আলোচনা করছি।
ওয়ার্মহোল প্রসঙ্গে স্টিফেন হকিং বলেন, ‘আসলে ব্ল্যাকহোলে পতিত কোনো বস্তু একেবারেই হারিয়ে যায় না, এটি কণিকারূপে ব্ল্যাকহোল থেকে নির্গত হয়। হকিং-বিকিরণ তত্ত্বানুযায়ী এই কণিকা যে পথে নির্গত হয়, সে পথটিই হলো ওয়ার্মহোল। অর্থাৎ ব্ল্যাকহোলে পড়লেই যে আপনি একদম হারিয়ে যাবেন, তা স্টিফেন হকিং মানতে নারাজ। তবে ওয়ার্মহোলের অস্তিত্ত্ব প্রমাণ হলে আপনি কণিকারুপে সেই ওয়ার্মহোল থেকে বের হয়ে আসবেন।
আবার আরেকটু লক্ষ্য করুন, বিশাল ভরের কারণে ব্ল্যাকহোলের চারপাশের স্থান-কালের একটি অসীম বক্রতা সৃষ্টি হয়। লক্ষকোটি আলোকবর্ষ দূরবর্তী স্থান-কালগুলো বক্রতার কারণে একটি ক্ষুদ্র বিন্দুতে পরিণত হয়। এখন আমরা আমাদের অবস্থান থেকে কোনো বস্তুকে যদি ব্ল্যাকহোলে নিক্ষেপ করি, তাহলে এর কণিকাগুলো ওয়ার্মহোল দিয়ে নির্গত হয়ে খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে লক্ষকোটি আলোকবর্ষ দূরের কোনো জগতে পৌঁছে যাবে। অর্থাৎ স্বাভাবিক সময়ে যে স্থান-কালে পৌঁছতে ওই বস্তুর কোটি কোটি বছর লাগত তাকে আমরা ওয়ার্মহোল ব্যবহারে খুব কম সময়ে এ দূরত্বটুকু অতিক্রম করিয়ে অন্য জগতে প্রবেশ করাতে পারবো। তাহলে ওয়ার্মহোল সম্পর্কে আমরা প্রাথমিক ধারণা পেয়েছি?
অনেকেই ভেবে থাকেন যে ওয়ার্মহোল হচ্ছে ব্ল্যাকহোল এবং হোয়াইটহোলের একটি মিলিত পথ। কিন্তু ওয়ার্মহোল আজও প্রমাণিত নয়, কারণ কোন ওয়ার্মহোল এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। ঠিক আবার হোয়াইটহোলও প্রমাণিত নয় কারণ আজও এটি হাইপোথিসিসরূপেই আমাদের আশা দেখিয়ে আসছে। তবে ওয়ার্মহোলের ব্যাপারে একটি আশার ব্যাপার হচ্ছে বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং, কিপ থর্নের মতে ওয়ার্মহোল বাস্তবে পাওয়া সম্ভব, আর এটা দিয়েই টাইম ট্রাভেল সবচেয়ে সম্ভাবনাময় হবে। দেখা যাচ্ছে আইনস্টাইন, হকিং, থর্ন সবাই একসাথে ওয়ার্মহোলের ব্যাপারে সহমত প্রকাশ করেছেন, অপেক্ষা শুধু কবে বাস্তবে সশরীরে দেখা দেবে এই ওয়ার্মহোল!
অপরদিকে ফ্রাঙ্ক টিপলার তাত্ত্বিকভাবে প্রমাণ করেন যে, নিজের অক্ষের চারদিকে দ্রুত ঘূর্ণায়মান এক অসীম দৈর্ঘ্যের চোঙ আসলে একটি টাইম মেশিন। তাহলে অবশ্যই এর দ্বারা সময় ভ্রমণ সম্ভব। টিপলার অনুমান করেছিলেন যে, যথেষ্ট বেগে ঘূর্ণায়মান সসীম দৈর্ঘ্যের চোঙের সাহায্যেও সময় ভ্রমণের ধারণাটি বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। পরবর্তী সময়ে হকিং প্রমাণ করেন যে, কখনোই কোন সসীম দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এবং উচ্চতা বিশিষ্ট টাইম মেশিন নির্মাণ করা সম্ভব নয়। তার মানে টাইম মেশিন দিয়ে টাইম ট্রাভেল হকিং-এর মতে একদম অসম্ভব।