অনন্ত মহাবিশ্বের ধারনা কিন্তু অনেক পুরোন। সেই যে প্রাচীন দার্শনিক জিওর্দানো ব্রুনো (১৫৪৮-১৬০০)-র কথা আমরা জানি, যিনি কোপার্নিকাসের সূর্যকেন্দ্রিক তত্ত্ব সমর্থন করতে গিয়ে চার্চের বিরাগভাজন হয়েছিলেন, আর যাকে এই বাইবেলবিরোধী তত্ত্ব সমর্থনের অপরাধে ঈশ্বরপুত্রের দল জীবন্ত পুড়িয়ে মেরেছিলো, তিনি ১৫৮৪ সালে একটি ভয়ঙ্কর এক বই লিখেছিলেন De l’Infinito Universo et Mondi নামে, যার বাংলা করলে দাঁড়াবে – ‘অনন্ত মহাবিশ্ব এবং বহু বিশ্ব নিয়ে’ সেখানে তিনি অনন্ত মহাবিশ্ব থাকার জোরালো সম্ভাবনার ব্যাপারটি তুলে ধরেছিলেন। তিনি বলেছিলেন পৃথিবী তো সৌরজগতের কেন্দ্র নয়ই, এমনকি এই মহাবিশ্বের সংখ্যাও একটি নয়, বরং এর সংখ্যা হতে পারে অনন্ত অসীম। ব্রুনো আরো বললেন, এই মহাবিশ্বের অন্যান্য গ্রহেও প্রাণের অস্তিত্ব থাকা সম্ভব। আবার, সেরকম প্রাণওয়ালা একাধিক গ্রহ থাকতে পারে অন্য মহাবিশ্বেও।
এবার আসা যাক বৈজ্ঞানিক দিক দিয়ে । আমাদের মহাবিশ্ব যদি কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনের মধ্য দিয়ে স্থান-কালের শূন্যতার ভিতর দিয়ে আবির্ভূত হয়ে থাকে, তবে এই পুরো প্রক্রিয়াটি কিন্তু একাধিকবার ঘটতে পারে, এবং হয়ত বাস্তবে ঘটেছেও। এই একাধিক মহাবিশ্বের অস্তিত্বের ব্যাপারটি প্রাথমিকভাবে ট্রিয়ন আর পরবর্তীতে মূলতঃ আদ্রে লিন্ডে এবং আলেকজাণ্ডার ভিলেঙ্কিনের গবেষণা থেকে বেরিয়ে এসেছে। সৃষ্টির উষালগ্নে ইনফ্লেশনের মাধ্যমে সম্প্রসারিত বুদ্বুদ (Expanding Bubbles) থেকে আমাদের মহাবিশ্বের মতই অসংখ্য মহাবিশ্ব তৈরী হয়েছে, যেগুলো একটা অপরটা থেকে সংস্পর্শবিহীন অবস্থায় দূরে সরে গেছে। এ ধরনের অসংখ্য মহাবিশ্বের একটিতেই হয়ত আমরা অবস্থান করছি অন্য গুলোর অস্তিত্ব সম্বন্ধে একেবারেই জ্ঞাত না হয়ে। আর এ ব্যাপারগুলোই হলো মাল্টিভার্স বা বহু-মহাবিশ্ব ।
মাল্টিভার্স ব্যাপারে সর্বশেষ
স্টিফেন হকিং-কে চিনেন নাকি? হাহা মজা করলাম কালণ বিজ্ঞানের জ্ঞান যার আছে সে তাকে চিনবেই । তো আমরা মোটামুটি সবাই জানি ২০১৮ সালের ১৪ মার্চ মৃত্যুবরণ করেন স্টিফেন হকিং । তার প্রায় দেড় মাস পরে ২ মে, জার্নাল অফ হাই এনার্জি ফিজিক্সে (Journal of High Energy Physics) তাঁর একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় । ক্যাথলিক ইউনিভার্সিটি লিউভেন (KU Leuven) -এর কসমোলজির অধ্যাপক থমাস হারটগের (Thomas Hertog) সাথে যৌথভাবে লেখা এই গবেষণাপত্রে মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও বিকাশের নতুন তত্ত্ব নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে । গতবছরের জুলাই মাসে, হকিং-এর ৭৫তম জন্মদিনে হারটগ, ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সম্মেলনে তিনি এই নতুন তত্ত্বটি নিয়ে আলোচনা করেন ।
মহাবিশ্বের বিকাশের পূর্বের তত্ত্বটি হলো চিরস্থায়ী স্ফীতি (eternal inflation) তত্ত্ব। এই তত্ত্বের আলোকে বিগব্যাং এর পরবর্তী সময়ে সেকেন্ডের ভগ্নাংশ সময়ের মধ্যে মহাবিশ্ব একটি পর্যায়ক্রমিক সুচকীয় স্ফীতির (exponential inflation) মধ্য দিয়ে যায় । অতঃপর এই প্রক্রিয়া ধীর হতে থাকে এবং শক্তিসমূহ পদার্থ এবং বিকিরণে রূপান্তরিত হয় । তবে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে বিশ্বাস রয়েছে, স্ফীতি শুরু হলেও সবজায়গায় এটি কখনো বন্ধ হয়নি । ধারনা করা হয়, মহাবিশ্বের কিছু কিছু অঞ্চলে কোয়ান্টাম প্রভাবে চিরস্থায়ীভাবে বুদবুদের মতো স্ফীতি চলমান এবং সার্বিকভাবে তাই স্ফীতি চিরস্থায়ী । এর আলোকে বলা যায়, আমাদের পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বটি সার্বিক মহাবিশ্বের বাসযোগ্য একটি পকেট যেখানে স্ফীতি থেমে গিয়ে নক্ষত্র ও গ্যালাক্সির জন্ম হয়েছে । স্থানের অন্যান্য বুদবুদে স্ফীতির মাধ্যমে অসীম সংখ্যক মহাবিশ্ব তথা মাল্টিভার্সের উদ্ভব ঘটে চলছে । কি স্ট্যান লি-এর স্পাইডার-ম্যানের মাল্টিভার্সের কথা মনে পরে গেল নাকি? তো এই তত্ত্ব অনুযায়ী আমরা যে মহাবিশ্ব পর্যবেক্ষণ করি তা কেবল এ ধরনের একটি মাত্র বুদবুদ ।
হকিং এক সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেছিলেন,
“প্রচলিত তত্ত্ব অনুযায়ী, সার্বিক মহাবিশ্ব একটি অসীম ফ্র্যাক্টালের মতো, যেখানে বিভিন্ন স্থানে পকেট মহাবিশ্বের মোজাইক সৃষ্টি হয়েছে । এগুলো স্ফীতির মহাসমুদ্রের মাধ্যমে পৃথক । স্থানীয়ভাবে পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নের সূত্রগুলো বিভিন্ন পকেট মহাবিশ্বে বিভিন্ন হতে পারে এবং এদের সমষ্টি নিয়েই গঠিত হয় মাল্টিভার্স । তবে আমি কখনো মাল্টিভার্সের ভক্ত ছিলাম না । যদি মাল্টিভার্সের বিভিন্ন পকেটে ইউনিভার্সের স্কেল আলাদা হয় কিংবা অসীম হয় তাহলে এই তত্ত্ব পরীক্ষাযোগ্য হবে না ।”
নতুন গবেষণাপত্রটিতে হকিং এবং হারটগ মহাবিশ্বের উৎপত্তিতে চিরস্থায়ী স্ফীত তত্ত্বকে ভুল বলে উল্লেখ করেছেন । স্ফীতি তত্ত্বের একটি সমস্যা হলো এটি একটি পটভৌমিক মহাবিশ্ব (background universe) কল্পনা করে নেয় যা আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব মেনে বিকাশিত হয় এবং কোয়ান্টাম প্রভাবসমূহ ছোট ছোট বিচ্যুতি হিসেবে বিদ্যমান থাকে । তবে, চিরস্থায়ী স্ফীতির গতিতত্ব চিরায়ত এবং কোয়ান্টাম তত্ত্বের মধ্যে পার্থক্য করতে ব্যর্থ, ফলে এতে আইনস্টাইনের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করা কঠিন ।
হকিং-এর মতে, মহাবিশ্ব যথেষ্ট মসৃন এবং সর্বিকভাবে সসীম । তাঁরা তাঁদের তত্ত্বটিকে স্ট্রিং তত্ত্ব অনুযায়ী ব্যাখ্যা করেন । স্ট্রিং তত্ত্ব তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার একটি শাখা যেখানে মহাকর্ষ এবং সাধারণ আপেক্ষিকতাকে কোয়ান্টাম তত্ত্বের আলোকে একীভূত করা হয় এবং এদের স্পন্দিত স্ট্রিং তথা তন্তু হিসেবে দেখা হয় (স্ট্রিং তত্ত্ব নিয়ে অদূর ভবিষ্যতে লেখা প্রকাশ করব ) । এই অতিক্ষুদ্র স্পন্দিত তন্তুগুলোকে মহাবিশ্বের গাঠনিক একক হিসেবে বিবেচনা করা হয় । তাঁদের এই ধারনা অনুযায়ী মহাবিশ্বকে একটি ত্রিমাত্রিক হলোগ্রাম হিসেবে কল্পনা করা যেতে পারে যেটিকে গাণিতিকভাবে একটি দ্বিমাত্রিক পর্দায় প্রক্ষেপিত করা যায় ।
হকিং এবং হারটগ হলোগ্রাফির এই তত্ত্বটির একটি বিশেষ প্রকরণ প্রতিষ্ঠা করেন এবং মাত্রা হিসেবে ‘সময়’-কে চিরস্থায়ী স্ফীতি হতে পৃথক করেন । এর ফলে চিরস্থায়ী স্ফীতি তত্ত্বকে আইনস্টাইনের তত্ত্বের উপর আর নির্ভর করতে হয় না । তাঁদের নতুন তত্ত্বে চীরস্থায়ী স্ফিতিকে সময়হীন করে একটি স্থানিক পৃষ্ঠে সময়ের পূর্বে আবদ্ধ করা হয়। এই বিষয়ে হারটগ বলেন,
“আমরা মহাবিশ্বের বিবর্তনে সময়ের উল্টোদিকে গিয়ে এমন একটি অবস্থায় পৌঁছেছি যেখানে সময়ের ধারনাটি অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে।”
১৯৮৩ সালে হকিং এবং আরেকজন পদার্থবিদ জেমস হার্টল (James Hartle) যৌথভাবে ‘সীমানাবিহীন তত্ত্ব (no boundary theory) প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন যেটি হার্টল-হকিং তত্ত্ব হিসেবে পরিচিত। হারটক বলেন,
“সীমানাবিহীন তত্ত্ব ধারনা করেছিলো, যদি আপনি সময়ের বিপরীত দিকে গিয়ে মহাবিশ্বের প্রারম্ভিক বিন্দুতে পৌঁছান তাহলে মহাবিশ্বকে একটি ক্ষুদ্র গোলাক হিসেবে পাবেন। তবে নতুন এই গবেষণাটি কিছুটা ভিন্ন ধরনা পোষণ করে। এখন আমরা বলতে চাই অতীতে মহাবিশ্বের একটি সীমানা ছিলো ।”
হকিং এবং হারটগ মহাবিশ্বের সার্বিক কাঠামোর বিষয়ে বিশ্বাসযোগ্য অনুমান নির্ধারণ করতে তাঁদের নতুন তত্ত্বটি কাজে লাগিয়েছেন । তাঁদের ধারনা অনুযায়ী, ইতিপূর্বেকার চিরস্থায়ী স্ফীতি তত্ত্ব অনুযায়ী মহাবিশ্বকে যেমন জটিল অসীম ও ফ্র্যাক্টাল কাঠামো বলে ভাবা হয়েছিলো এটি তার চেয়ে অনেক সরল এবং সসীম । অন্যান্য পরীক্ষার মাধ্যমে যদি এই তত্ত্বটির যথার্থতা নিশ্চিত করা যায় তাহলে এটি মাল্টিভার্সের ধারনাটিকে সম্পূর্ন ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করবে। এর ফলে মাল্টিভার্স তত্ত্বটি আরো যথাযথ এবং পরীক্ষার উপযোগী হবে । তো আমরা আর বড়জোড় কি করতে পারি, অপেক্ষায় থাকতে পারি অথবা এটা নিয়ে গভেষণা করতে পারি (অবশ্যই তত্ত্বীয়ভাবে) ।
তো এই ছিল আমার জ্ঞানে থাকা মাল্টিভার্সের তথ্য
ধন্যবাদ
তথ্যসুত্রঃ
স্টিফেন হকিং-এর শেষ তত্ত্ব | Tanvir Rana Rabbi