বর্তমানে আমরা যাকে চাঁদ (বা চাঁদ মামা) বলে ডাকি, তিনি পৃথিবীর বুকে অতীতে আছড়ে পড়েন নি, ভবিষ্যতেও পড়বেন না। কিন্তু ছোট-বড় অনেক বস্তুই অতীতে আছড়ে পড়েছে, এখনো পড়ছে, ভবিষ্যতেও পড়বে। যারা অতীতে আছড়ে পড়েছে, তাদের অনেকেই অনেকদিন ধরে পৃথিবীর চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে ধীরে কাছে এসেছে, তারপর আছড়ে পড়েছে। অথচ, তাদেরকে আমরা কখনো ঘূর্ণায়মান থাকতে দেখিনি। সেসব আছড়ে পড়া বস্তুগুলোর সম্মিলিত রূপটিই হলো আমাদের আজকের পৃথিবী। এমনকি পৃথিবীর যত সমুদ্র আর তাতে যত পানি এসবই এসেছে বাইরে থেকে। রাতের আকাশে আমরা যেসব তারার মত আলোর বিন্দুগুলোকে ছুটে যেতে দেখি (তারা ঝরে পড়া) সেগুলো আসলে এরকম ছোটছোট বস্তুর ঝরে পড়া। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের সাথে ঘর্ষনের ফলে তারা জ্বলে ওঠে বলেই আমরা তাদেরকে দেখতে পাই।
এখন মনে করুন, অতীতে কোন এক কালে আমাদের এই বড় চাঁদটিও যদি কোনদিন আছড়ে পড়েই গিয়ে থাকত, আর মিশে যেত পৃথিবীর সাথে (অতীতে অন্যান্য বস্তু পড়েছে, চাঁদও পড়তে পারত), তাহলে তো চাঁদটিকে এখন আর আকাশে দেখতে পেতাম না, তাই না? তখন আমরা বলতাম পৃথিবীর কোন চাঁদ নেই। এই মুহূর্তে আমরা যেসব বস্তু আকাশে দেখি, সেগুলো পড়ে যায়নি বলেই দেখি।
আবার এমনও হতে পারত যে, পৃথিবীর আকর্ষন ছিন্ন করে কোন এক অতীত কালে চাঁদটা বহু দুরে চলে গিয়েছিল। তাহলেও কিন্তু চাঁদ নিয়ে আমাদের এত কৌতুহল হতো না। আমরা জানতেই পারতাম না যে কোনকালে চাঁদ ছিল আমাদেরপ্রতিবেশী। অনেক বস্তু এরকম চলে গিয়েছে। সত্যি বলতে কী! চাঁদটাও প্রতিনিয়ত একটু করে দুরে চলে যাচ্ছে, তবে অত্যন্ত ধীরে।
সেকারণে, চাঁদ আর পৃথিবীর মধ্যে একটা সাময়িক সাম্যাবস্থা এই মুহূর্তে বিরাজ করছে। কিন্তু সেটাও পুরোপুরি সাম্যাবস্থা নয়। একটি দীর্ঘ সময় ধরে ওরকম অবস্থায় ঘুরতে থাকার কারণে আমরা ভাবছি এটাই চিরন্তন। আমাদের মনে হয় যেন কেউ বুঝি ওকে ধরে ঠিকঠাক সেট করে ওখানে বসিয়ে দিয়েছে। আসলে বিষয়টা ওরকম নয়। একে অপরের প্রতি আকর্ষণের কারণেই তারা একে অপরের অভিমুখে পড়তে শুরু করে। কিন্তু সেই পড়ে যাওয়াটা সবসময় মুখোমুখি হয় না, পাশ কেটে চলে যায়। যেতে যেতে আবার পিছুটান অনুভব করে। একটু করে গতি কমতে থাকে। একসময় আবার উল্টোদিকে পড়তে শুরু করে। এভাবে সবাই নিরন্তর সবার দিকে পড়ে যাচ্ছে, কিন্তু আদি বেগের দিকের কারণে মিশে যেতে পারছে না। মিশে যদি যেতই, তাহলে আর ঘুরতে দেখতাম না।
আমরা আসলে বর্তমানে যাকে যে অবস্থায় দেখি, যেরকম চক্রে আবর্তিত হতে দেখি, সেগুলো সবটুকুই হলো একটা সাময়িক অবস্থা এবং অসংখ্য অনেক সম্ভাবনার মধ্যে থেকে একটা আপাত স্থিতিশীল পরিস্থিতি।
©