আজকাল যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা সৌন্দর্য পিপাসুদের নতুন ট্রেন্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে। চুলে রং করা তাদের মধ্যে অন্যতম। নিজেকে সাজানোর জন্য শুধু নারীরা নন, পুরুষরা চুলে রং করেন। সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য চুলে সোনালি, মেরুন, মেহগনিসহ আরও নানা রং করা হয়। এটি ফ্যাশন ধরে রাখার পাশাপাশি সাজপোশাকেও বৈচিত্র্য আনে। দেখতে সুন্দর লাগলেও এটি কিন্তু চুলের জন্য ক্ষতিকর। গবেষকরা বলেছেন, চুলে রং করলে চুলের নানা ক্ষতি হয়। কেননা, হেয়ার কালারে উপস্থিত অক্সিডাইজিং এজেন্ট হাইড্রোজেন পার অক্সাইড ও একটি অ্যালকালাইজিং এজেন্ট অ্যামোনিয়া ব্যবহার করা হয়, যা একটি কেমিক্যাল রিঅ্যাকশনের মাধ্যমে চুলের মেলানিনকে হালকা করে নেয় ও হেয়ার কালারের রঙিন পিগমেন্টকে চুলের শ্যাফটের ভেতর ঢুকতে সাহায্য করে। এতে পরবর্তী সময়ে চুলের ওপর নানা নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। অনেকের ত্বক অনেক বেশি সংবেদনশীল (সেনসিটিভ) হয়ে থাকে। ফলে সামান্য রাসায়নিকের সংস্পর্শে আসা মাত্রই অ্যালার্জির সমস্যা শুরু হয়ে যায়। পিপিডি অনেক বেশি অ্যালার্জি উদ্রেককারী রাসায়নিক যার প্রভাবে মাথার ত্বকে চুলকানি, জ¦ালা, পুলে যাওয়া, হ্রাশ ওঠা, খুশকি সমস্যা দেখা দিতে পারে। এ ছাড়াও অ্যালার্জি যদি মারাত্মক পর্যায়ে চলে যায় তাহলে চোখ ফুলে যাওয়া, চোখ, নাক ও মুখের চারপাশের ত্বকে অ্যালার্জির প্রকোপ দেখা দিতে পারে। অতিরিক্ত চুলের রঙ ব্যবহার করলে চুল ঝরে যাওয়ার মাত্রা বেড়ে যেতে পারে। চুল রংয়ের ক্ষতিকর রাসায়নিক চুলের ফলিকল একেবারেই নষ্ট করে দেয়। ফলে চুলের মাঝখান থেকে চুল ভেঙে যেতে শুরু করে এবং নতুন চুল গজানোতেও বাধা সৃষ্টি করে। এ ক্ষেত্রে চুলে রং করলে নানা ক্ষতির কথা উলেস্নখ্য করেছেন গবেষকরা। এগুলো হলো-
চুলের বাইরের স্তর নষ্ট করে
চুলে রং করা মাত্র সেটি বেশ কয়েকটি বাধা পেরিয়ে তারপর চুলের অন্দরে গিয়ে পৌঁছায়। তবেই কালারটা দীর্ঘদিন স্থায়ী হয়। গবেষকরা বলেন, এই বাধাগুলো পেরনোর সময় ধীরে ধীরে চুলের মারাত্মক ক্ষতি হয়। প্রথমে চুলের একেবারে বাইরের যে দেয়াল রয়েছে সেটিকে ভেঙে দেয় অ্যামোনিয়া, তবেই হেয়ার কালারটি ভিতরে ঢুকতে পারে। আর এই দেয়ালটা ভেঙে যাওয়ার কারণে চুলের প্রথম রক্ষাকবচটা আর কর্মক্ষম তাকে না। ফলে চুলের ক্ষতি শুরু হয়ে যায়।
চুলের প্রকৃত রঙকে তুলে দেয়
চুলের প্রথম রক্ষাকবচ ভেঙে দেয়ার পর দ্বিতীয় ধাপে হেয়ার কালারে উপস্থিত বিস্নচ বা পারোঅক্সাইড ধীরে ধীরে আমাদের চুলের যে কালো রং রয়েছে তাকে ঘষে ঘষে তুলে দিতে শুরু করে। আর প্রাকৃতিক কালারের জায়গা নেয় কৃত্রিম কালার। এই পুরো প্রক্রিয়াটি যতটা সহজ মনে হয়, আদতে কিন্তু তা নয়। একদিকে চুলের রক্ষাকবচ নষ্ট, অন্যদিকে পরোক্সাইডের মতো বিষ চুলের ভেতরে প্রবেশ করছে। এমনটা হলে চুলের স্বাস্থ্য একেবারেই ভালো থাকে না।
অ্যামোনিয়া ফ্রি রঙও ক্ষতিকর
অ্যামোনিয়া ছাড়া যে রংগুলো পাওয়া যায় সেগুলো একেবারেই ক্ষতিকারক নয়? এই ধারণাও ভুল। অ্যামোনিয়া ফ্রি কালারও চুলের ক্ষতি করে। একটা সহজ বিষয় হয়, চুলের প্রাকৃতিক রং না ওঠা পর্যন্ত কৃত্রিম রং নিজের জায়গা করবে কীভাবে! আর এমনটা যখনই হবে, তখনই তো চুলের দফারফা হয়ে যাবে। প্রসঙ্গত, অ্যামিনিয়া ছাড়া যে রংগুলো পাওয়া যায় সেগুলো চুলের কিছুটা কম ক্ষতি করে, যা কোনো পার্থক্য নেই।
দীর্ঘস্থায়ী রঙের বেশি ক্ষতি
রং যত বেশি সময় চুলে রাখবেন, তত বেশি ক্ষতি হবে। রং লাগানোর পর অনেকেই দীর্ঘ সময় পর স্নান করেন। ভাবেন, যত বেশি সময় রাখবেন, তত ভালো রং হবে। তবে একথা ঠিক যে, ডাইটা বেশি সময় রাখলে চুলের রং আরও উজ্জ্বল হয়। কিন্তু সেই সঙ্গে রংয়ে উপস্থিত কেমিক্যালগুলো বেশি বেশি করে চুলের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে চুলের ক্ষতি করার সুযোগ পায়। মনে রাখবেন, চুলের কৃত্রিম রং যত উজ্জ্বল হবে, তত চুলের বেশি ক্ষতি হবে।
চোখ জ¦ালা করে
রংয়ে উপস্থিত পারোঅক্সাইড চুলের অভ্যন্তরে থাকা প্রোটিনের সঙ্গে বিক্রিয়া করে সালফারের জন্ম দেয়। সেই কারণেই এমন ঝাঁঝালো গন্ধ বের হতে শুরু করে। সেই সঙ্গে অনেকের চোখ জ¦ালা করার মতো সমস্যা দেখা দেয়।
শরীরের ওপর প্রভাব
একাধিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, চুলের রংয়ে উপস্থিত একাধিক কেমিক্যাল বিশেষ করে অ্যামিনোফেনল, ডায়ামিনোবেনঞ্জিন এবং ফেনিলেনডিয়ামাইন শরীরের মারাত্মক ক্ষতি করে। হেয়ার কালারের কেমিক্যালে মানুষের ক্যান্সারও হতে পারে (যেমন-লিউকেমিয়া, নন-হজকিনস লিম্ফোমা, মূত্রথলির ক্যান্সার, বস্নাড ক্যান্সার ও মালটিপল মেয়েলোমা)। তাই কম সময় অন্তর অন্তর চুলে রং করার অভ্যাস ছাড়ুন। না হলে কিন্তু বিপদ বাড়বে!
চুলে রঙ করলে আরও যেসব সমস্যা হতে পারে-
# হেয়ার কালারে চুলের উজ্জ্বলতা কমে যায়। এ ছাড়া চুলপড়া, আগা ফাটা, খুসকি হতে পারে।
# হেয়ার কালারে চর্মরোগ, ফুসফুস বা চোখের ক্ষতি হতে পারে। হেয়ার কালার ব্যবহারের ফলে শ্বাসকষ্ট বাড়তে পারে।
# হেয়ার কালার মাথার ত্বকে ইরিটেশন ও অ্যালার্জি সৃষ্টি করে। হেয়ার কালার ব্যবহারের কয়েক ঘণ্টা থেকে শুরু করে একদিনের মধ্যে চুলকানি, লালচে ভাব, জ¦ালাপোড়া ও অস্বস্তি হতে পারে। এ রকম অস্বস্তি হলে হেয়ার কালার ব্যবহার করা উচিত নয় একদম। তাই কালার ব্যবহার করার আগে অ্যালার্জি টেস্ট করে নেয়া দরকার।
# চুল কালার করলে চুল রুক্ষ হয়ে ফেটে যায়। আগা ফাটা ছাড়াও চুল মাঝে দিয়ে ফেটে ফেটে ঝরে যাওয়ার মতো সমস্যা দেখা দেয়। ফলে চুল পাতলা হয়ে যায় আস্তে আস্তে। এ ধরনের সমস্যা হলে ফেটে যাওয়া চুল কেটে ফেলা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না।
চুলের যতেœ করণীয়
চুল রং করার পর এর যতœ নেয়াও কিন্তু সমান জরুরি। তা না হলে চুলের ক্ষতি অনিবার্য। এ ক্ষেত্রে কিছু পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা-
# চুলের রং রোদে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই বাইরে বের হওয়ার আগে রোদ নিরোধক সিরাম ব্যবহার করুন। চাইলে চুলের স্কার্ফ কিংবা ছাতাও ব্যবহার করতে পারেন।
# রং করা চুলের জন্য ভালো মানের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের শ্যাম্পু ও কন্ডিশনার কিনতে পাওয়া যায়। চুলের যতেœ সেগুলোই ব্যবহার করার চেষ্টা করুন।
# রং করা চুলে সরাসরি মেহেদি লাগাবেন না। মেহেদির সঙ্গে অন্যান্য উপকরণ মেশানো থাকলে তবেই সেটা ব্যবহার করুন।
# চুলের কোনো কোনো অংশ ফাটা, খারাপ থাকতে পারে। সে চুলগুলো কেটে তারপর রং করান। তা না হলে চুল ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
# চাইলে রং করা চুলের যতেœ ১৫ দিন পরপর পার্লারে গিয়ে হেয়ার স্পা, ক্রিম ট্রিটমেন্ট ডিপ কন্ডিশনিং করাতে পারেন।
# সপ্তাহে দুবার প্রোটিন প্যাক ব্যবহার করুন। এ ক্ষেত্রে প্রোটিন প্যাক বানাতে ডিম, টক দই, অলিভ ওয়েল একত্রে মিশিয়ে প্যাক বানিয়ে ৪০ মিনিট রাখুন। পরে ব্যবহার করুন।
সংগৃহীত