"ডিকিনসনিয়া"
দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার ফ্লিন্ডার্স রেঞ্জে প্রথম পাওয়া যায় এই জীবটির জীবাশ্ম। সেটা ছিল ১৯৪৫ সাল। পরবর্তীতে জীবটির আরো ফসিল পাওয়া গিয়েছিল। ইউক্রেনের পোডোলিয়ায়, শ্বেত সাগর ও রাশিয়ার উরাল পর্বতমালাতেও এই জীবের জীবাশ্ম খুঁজে পান বিজ্ঞানীরা।
জীবাশ্ম বিজ্ঞানীরা ফসিলগুলোকে খুঁজে পেয়েছিলেন বেলে পাথরের ভেতরে। সমতল, পাঁজরযুক্ত ডিম্বাকৃতি এই জীবটি চার ফুট এর ওপরে বৃদ্ধি পেতে পারে। উপবৃত্তাকার জীবটির বুকের দুইদিকে পাঁজরার মতো রেখা নেমে গিয়েছে দেহের প্রান্ত বরাবর।
জীবাশ্ম বিজ্ঞানীরা বুঝে উঠতে পারছিলেন না, উপবৃত্তাকার জীবাশ্মগুলো কোন জীবের। সেগুলো উদ্ভিদ না প্রাণী। কিছু গবেষক একে ছত্রাকের দলে ফেলেছিলেন। আবার কেউ কেউ বলেছেন প্রাণী। পরিচয় পাওয়া না গেলেও, একটি নাম পেয়েছিল জীবটি। এটি প্রথম খুঁজে পেয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ভূতত্ত্ববিদ রেগ স্প্রিগ।
তিনি দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার খনির ডিরেক্টর বেন ডিকিনসনের অধীনে কাজ করতেন। তার নামানুসারেই এর নাম দেন ডিকিনসনিয়া। এই প্রাণীর ফসিল আবিষ্কৃত হওয়ার পর ৭৫ বছর কেটে গিয়েছিল, জীবটির পরিচয় নিয়ে বিভিন্ন বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন মত দিয়েই যাচ্ছিলেন। কোনো কিছুতেই তারা স্থির হতে পারছিলেন না।
বিজ্ঞানীদের ধারণা, ডিকিনসনিয়া নামের মিটারখানেক লম্বা এই জীবটি একটি বৃহদাকার এককোষী অ্যামিবা, নয়তো ছত্রাক। মনে করা হতো, পৃথিবীতে এই জীবটির অস্তিত্ব ছিল আজ থেকে ৫৭ কোটি বছর আগে, ক্যামব্রিয়ান যুগে।
কয়েকবছর আগে অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির পিএইচডি স্কলার ইলিয়া বোব্রভস্কি, রাশিয়ার উত্তর-পশ্চিমে শ্বেতসাগরের পাড় থেকে আবিষ্কার করেছিলেন ডিকিনসনিয়ার ফসিল। ডিকিনসনিয়ার জীবাশ্মটি নিয়ে পরীক্ষা করার সময় বহুকোষী এই জীবটির টিস্যুর মধ্যে কোলেস্টেরলের দানা খুঁজে পান গবেষক। যা প্রমাণ করেছিল জীবটি ছত্রাক নয়, বৃহদাকার অ্যামিবাও নয়। ডিকিনসনিয়া আসলে একটি প্রাণী এবং ডিকিনসনিয়াই বিশ্বের প্রথম প্রাণী।
ইলিয়া আরো জানিয়েছিলেন, জলজ এই প্রাণীটির দেহ ছিল জেলিফিশের মতই নরম। প্রাণীটির শরীরে খাদ্যনালির সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। খাদ্য হজম হওয়ার পর কোষে পাচিত খাদ্য সরবরাহ করার জন্য আলাদা ব্যবস্থা ছিল। অনুমান করা হচ্ছে, প্রাণীটির খাদ্য ছিল আণুবীক্ষণিক উদ্ভিদ বা ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন।
অস্ট্রেলিয়ার ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক জকেন ব্রোকস বলেছিলেন, আগে আমরা জানতাম, ৫৪ কোটি বছর আগে পৃথিবীতে প্রাণীরা এসেছিল। ডিকিনসনিয়ার এই ফসিল প্রমাণ করে পৃথিবীতে ৫৫ কোটি ৮০ লাখ বছর আগেও বড় ও বহুকোষী প্রাণীর অস্তিত্ব ছিল।
ডিকিনসনিয়ার বৈশিষ্ট্যভেদে গবেষকরা একে বিভিন্ন প্রজাতিতে ভাগ করেছেন, যেমন ডিকিনসনিয়া ব্রাচিনা, ডিকিনসনিয়া কোসটাটা, ডিকিনসনিয়া ইলঙ্গাটা, ডিকিনসনিয়া লিজা, ডিকিনসনিয়া মেন্নেরি, ডিকিনসনিয়া মিনিমা, ডিকিনসনিয়া রেক্স,ডিকিনসনিয়া স্প্রিগি, ডিকিনসনিয়া টেনুইস ইত্যাদি।
এখনো বিজ্ঞানীদের চুলচেরা গবেষণা চলছে ডিকিনসনিয়াকে নিয়ে। তবে ফলাফল যাই হোক না কেন, ডিকিনসনিয়ার অস্তিত্বই প্রমাণ করে যে, ৫৭ কোটি বছর আগের ক্যামব্রিয়ান যুগে নয়, পৃথিবীতে প্রাণীর পদচারণা তারও কয়েক কোটি বছর আগের এডিয়াকারান যুগে। ১৯৮০ এর দশকে, গবেষকরা এডিয়াকারান যুগের অনেক জীবাশ্মের সন্ধান পেয়েছেন। তবে ডিকিনসনিয়াই পৃথিবীর বুকে পা রাখা প্রথম প্রাণী, যার বয়স ৫৭ কোটি বছর।
সূত্র: ন্যশনালজিওগ্রাফি