ইদানীং অনেকেই কিটো-ডায়েটের প্রতি আগ্রহী হচ্ছেন। ওজন কমানোর ক্ষেত্রে এই ডায়েট কার্যকর হলেও না জেনে-বুঝে এর প্রতি আকৃষ্ট না হওয়াই ভালো। কিটো গ্রিক শব্দ ‘কিটোল’ থেকে এসেছে। কিটো এসিভোসিস হলো দেহে কিটোন পদার্থ জমাট বাঁধার ফলে অম্লব্যাধি তৈরি হওয়া।
এপিলেপসি বা মৃগীরোগীদের চিকিৎসায় কিটোজেনিক ডায়েট ব্যবহার করা হয়। এতে থাকে কম শর্করা ও উচ্চমাত্রার প্রোটিন, উচ্চমাত্রার চর্বি। মৃগীরোগীদের শরীরে কিটোজেনেসিস হয়, যেন ফ্যাটি অ্যাসিড জারণে বিঘ্ন ঘটে। কিটোজেনিক ডায়েটের ফলে মৃগীরোগীদেরও ওজন কমে যেতে দেখা যায়। আর আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই ডায়েটই ওজন কমানোর জন্য সঠিক পথ বলে কেউ কেউ মনে করছেন।
আবার যেহেতু কম শর্করা গ্রহণের কথা বলা আছে, তাই অনেকে ডায়াবেটিস কমানোর জন্যও এটি ব্যবহার করছেন, আদতে যা দীর্ঘমেয়াদি কোনো বৈজ্ঞানিক পন্থা নয়। শর্করা বিপাকের বিঘ্ন ঘটে বলেই রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে গিয়ে ডায়াবেটিস হয়। অথচ দেহকে একেবারে গ্লুকোজমুক্ত বা দেহে নির্দিষ্ট পরিমাণের তুলনায় কম গ্লুকোজ রাখা যায় না। কারণ এতে দেহে কিটোন বডি নামে অম্লত্ব তৈরি হয়ে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া হাইপোগ্লাইসেমিয়া হয়ে মৃত্যুঝুঁকি বাড়ে। শর্করার ঘাটতি হলে লিভার থেকে চর্বি এসে জ্বালানি হিসেবে কাজ করে বলে যকৃৎ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ওজন কমানোর ক্ষেত্রে অনেক ধরনের ডায়েট দেখা যায়। যেমন এটকিন ডায়েট, জোন ডায়েট, লিকুয়িড প্রোটিন ডায়েট, সাউথ বিচ ডায়েট, কুকি ডায়েট, ভেজিটেবল ও ফ্রুটস ডায়েট প্রভৃতি। কোনো ডায়েটই স্বাস্থ্যসম্মত নয়। কারণ এগুলোতে ফুড সাইড পিরামিড অনুসরণ করা হয় না।
কিটোতে কী থাকে?
কিটো ডায়েটে চর্বি থাকে ৭৫ শতাংশ, যেখানে স্বাভাবিকভাবে থাকা উচিত ২০-২৫ শতাংশ। শর্করা থাকে ৫-১০ শতাংশ। অথচ সারা বিশ্বে শর্করার পরিমাণ নির্ধারণ করা আছে মোট ক্যালরির ৫৫-৬০ শতাংশ। চর্বির মতো প্রোটিনও এখানে বেশি থাকে।
একে তো কঠিন, তার ওপর ব্যয়বহুল
দেখা যায়, কিটো ডায়েট অনুসরণ করা বেশ কঠিন ও ব্যয়বহুল। সবার পক্ষে সবকিছু জোগাড় করা সম্ভব হয় না। এই খাবারে থাকে মূলত সমুদ্রের উদ্ভিদ ও মাছ, পনির, এভোকাডো, মাংস, মুরগির মাংস, ডিম, নারকেল তেল, মাখন, জলপাই তেল ও শর্ষের তেল, যেসব গরু শুধু ঘাস খায়, সেসব গরুর মাংস, যাতে উচ্চমাত্রায় চর্বি থাকে। সয়াবিন তেল একেবারেই নিষেধ।
এ ছাড়া থাকবে বিভিন্ন ধরনের বাদাম ও বীজ। যেমন সূর্যমুখীর বীজ, তিল, তিসি, কুমড়ার বীজ, সিয়া বীজ প্রভৃতি। নারকেল তেলে আছে মিডিয়াম চেইন ট্রাইগ্লাইসেরাইড। এতে মস্তিষ্ক ভালো থাকে। তবে আমাদের দেশে চুলের জন্য নারকেল সহজলভ্য হলেও খাওয়ার জন্য এই তেলের ব্যবহার ও বিক্রি নেই বললেই চলে। এ ছাড়া নিত্যদিনের প্রতিটি রান্নায় আমরা মাখন ব্যবহার করি না। দেখা যাচ্ছে কিটো ডায়েট উচ্চবিত্তদের জন্যই প্রযোজ্য। কারণ প্রতিটি খাবারের দাম বেশি, যা পরিবারের খরচ বাড়িয়ে দেবে এবং যা আসলেই অপ্রয়োজনীয়।
কিটো ডায়েটে অসুবিধা
কিটো ডায়েটের কয়েকটি খারাপ দিক হলো অধিক চর্বি ও প্রোটিনের জন্য একদিকে ডায়রিয়া, অন্যদিকে কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দেয়। এ ছাড়া কিডনিতে পাথর ও কিডনির অন্যান্য সমস্যা, হৃদ্‌রোগ, পিত্তথলিতে পাথর (গলব্লাডার স্টোন), প্যানক্রিয়াসের অসুস্থতা, থাইরয়েডের সমস্যা, হজম শক্তি কমে যাওয়া, চুল পড়ে যাওয়া প্রভৃতি দেখা দিতে পারে। এ ছাড়া বেশি প্রোটিন ও চর্বির জন্য ত্বকে ফুসকুড়ি (র‌্যাশ) ওঠা, ত্বকের উজ্জ্বলতা নষ্ট হওয়া প্রভৃতিও উল্লেখযোগ্য। ডায়রিয়ার জন্য শরীর দুর্বল হয়ে কর্মক্ষমতা কমে যায়।
এর অপকারিতা সম্পর্কে কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যায়। অস্ট্রেলিয়ায় ২২ বছর বয়সী এক মডেল তারকাখ্যাতির আশায় দিনের পর দিন কিটো ডায়েট চালিয়ে যাওয়ার পর একসময় মারা যান। হতভাগ্য মা-বাবা সবার কাছে অনুরোধ রাখেন, আর কারও সন্তান যেন তাঁদের মেয়ের মতো ফিগার-সচেতন না হয়।
আমার নিজের চেম্বারে নবম শ্রেণির একটি মেয়েকে নিয়ে মা-বাবা আসেন। মেয়েটি তার দৃষ্টিশক্তি নষ্ট করেছে শুধু ‘জিরো ফিগার’-এর আশায়। দেশের বাইরে নিয়ে গিয়েও মেয়েটির চোখ বাঁচানো যায়নি। অধিক পুষ্টিও অপুষ্টির জন্ম দেয়। মেয়েটি তার উদাহরণ। শুধু অপুষ্টির জন্য সে অন্ধ হয়ে গেছে।
সম্প্রতি ভারতের এক অভিনেত্রী কিটো ডায়েট করে মৃত্যুবরণ করেন, যা অনেককেই ভাবিয়ে তুলেছে। কারও কারও অভিমত ছিল, তাঁর অন্য কোনো অসুস্থতা ছিল। তাহলে আমরা দেখতে পাই, কিটো ডায়েট সেই রোগের নিরাময় না করে দ্রুত তাকে মৃত্যুর দিকেই ঠেলে দিয়েছে।
অল্প দিনের জন্য চলতে পারে
খাবারে শর্করা অর্থাৎ ভাত, রুটি, চিড়া, মুড়ি, খই ইত্যাদি বাদ দিলে দেহে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। শর্করা শক্তির অন্যতম উৎস। এর অভাবে শরীরে দহন ক্রিয়া থেমে যায়। ফলে কিটোন বডি নামে দেহে ক্ষতিকর পদার্থ সৃষ্টি হয়। প্রদাহ হয়ে ওঠে অম্লত্ব। শর্করা বাদ দিলে ওজন অবশ্যই কমবে। তবে এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াকে অস্বীকার করা যাবে না। কিটো ডায়েট ৭-১০ দিন এমনকি ১৫ দিন পর্যন্ত চালানো যায়। তবে জীবনভর নয়।
কিটোজেনিক ডায়েটের অতিরিক্ত প্রোটিন একদিকে যেমন ব্যয়বহুল, অন্যদিকে এটা কিডনির ওপর চাপ ফেলে এবং রক্তের চর্বির পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। সুতরাং ওজন কমাতে গিয়ে দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতার কবলে না পড়াই ভালো।
সহজলভ্য সুষম খাবার পরিমিত পরিমাণে খান। পয়সা খরচ করে নয়, কম খরচে ওজন কমান।
কিটোজেনিক ডায়েট মোট পাঁচ ধরনের হয়ে থাকে।
১২ বছর গবেষণার ফসল কিটোজেনিক ডায়েট। মৃগীরোগীদের ওষুধ আবিষ্কারের আগ পর্যন্ত এটি ব্যবহার করা হতো। ওষুধ আবিষ্কারের পর এ ডায়েটকে গ্রহণযোগ্য নয় বলা হয়েছে। কারণ সাইড ইফেক্ট হিসেবে অতিরিক্ত ওজন হ্রাস পেত। শুধু তা-ই নয়, বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যাও দেখা দিত। যেহেতু ওজন হ্রাস পায় সেজন্য অনেকের মনে হতে পারে, কিটোজেনিক ডায়েট ওজন কমানোর খুবই কার্যকর ডায়েট। অথচ কিটোজেনিক ডায়েট অনুসরণকারীদের নানা ধরনের সমস্যা হয়।
যেসব সমস্যা হতে পারে
যেমন ডায়াবেটিস না হওয়া সত্ত্বেও হাইপো গ্লাইসেমিয়ায় আক্রান্ত হওয়া।
গলব্লাডার রিমুভ এমন অনেকের দিন-রাত শুধু বমি হতে পারে। * এসিডিটি অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পায়।
মেটাবলিক রেট একেবারে স্লো হয়ে গেছে। ক্ষুধামান্দ্য দেখা দিয়েছে।
সবকিছু ভুলে যাচ্ছেন এমনকি দোকানে কিছু কিনতে গেলেও কত টাকায় কিনেছেন বা কত ফেরত পাবেন বা কী কী কিনেছেন সবকিছু।
শরীর অসম্ভব ধরনের ড্রাই থাকে, সারাক্ষণ পানি পিপাসা লাগে। মনে হচ্ছে হাত-পা জ্বালা করছে। ডিহাইড্রেশন হয়।
চুল আগের তুলনায় একেবারে কমে গেছে।
মেজাজ কন্ট্রোল করা যাচ্ছে না। সবার ওপর রাগ করার প্রবণতা দেখা দিয়েছে।
হঠাৎ হঠাৎ হার্টবিট বেড়ে যায়। সে সময় অন্য কোনো কাজ করা যায় না।
আগে ওষুধ খেতে হতো না। কিন্তু অনিয়ন্ত্রিত উচ্চরক্তচাপের জন্য মেডিসিন খেতে হচ্ছে।
ডিসলিপিডেমিয়া হয়ে গেছে। অর্থাৎ খারাপ কোলেস্টেরল বৃদ্ধি পাচ্ছে কিন্তু ভালো কোলেস্টেরল কমে যাচ্ছে।
এ ধরনের ডায়েট আসলে কারোর জন্য প্রযোজ্য নয়। এখন পর্যন্ত দীর্ঘদিন কিটোজেনিক ডায়েট অনুসরণের ফলাফলের কোনো গবেষণা হয়নি। কারণ তার আগেই স্বাস্থ্য সমস্যাগুলো দেখা দিয়েছে। ফলে কিটোজেনিক ডায়েট অনুসরণ বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। যেকোনো ডায়েট অনুসরণেই প্রচুর পানি খাওয়া ও এক্সারসাইজ জরুরি।