চলমান নৌকায় বসে চমৎকার দৃশ্যটা দেখতে পেলাম আমরা—খালপাড়ের ঢালুতে একটি বয়সী আর্জিনার লেজ মুখে চেপে ধরে আছে একটি গুইসাপের বাচ্চা, ডিম থেকে বেরিয়েছে ৮-১০ দিন হবে। চমৎকার ছিট ছিট—চিত্রবিচিত্র রঙের ওই আনাড়ি বাচ্চাটি আর্জিনার লেজ ধরে খেয়ে ফেলতে চাইছে। আর্জিনাটি ব্যস্ত জীবন বাঁচাতে, অতএব টানাটানির খেলাটা জমেছে চমৎকার। এমন আশ্চর্য-সুন্দর দৃশ্য দেখে উল্লাসে চিৎকার দিয়ে নৌকা থেকে পাড়ে নামলাম আমরা। ভুলটা হলো এখানেই। ভয়ে আর্জিনার লেজ ছেড়ে ভোঁ দৌড়ে ওপরের দিকে চলে গেল গুইসাপটি, আর্জিনাটিও তাই করল। ছবি তোলা আর হলো না আমাদের। আমরা এ রকম দৃশ্য এই প্রথম দেখলাম। আনাড়ি কম বয়সী চিলু সাপকে আমি আর্জিনার লেজ মুখে পুরতে দেখেছিলাম আমার গ্রামের একটা বাগানে—সাপটিকে লেজে নিয়েই দৌড়াচ্ছিল আর্জিনাটি। চিলু সাপ বা অন্য বিষধর সাপেরা শুনেছি আর্জিনাকে খায়, ছোঁ মারে বাজ-চিলে, বড় বড় সোনা ব্যাঙ অন্য ছোট পাখিদের মতো এদেরও গেলে, বেজিদের সামনে পড়লে অকারণে মেরে ফেলে, পোষা বিড়ালেরা কখনো কখনো এদের নিয়ে মজার খেলায় মাতে।
আর্জিনার সঙ্গে পরিচয় শৈশব থেকে। প্রায় বারো মাসই দেখা হতো ওদের সঙ্গে রান্নাঘরের পেছনে, উঠানে, বন-বাগানে ঘুরত ওরা, আজও তাই করে। বড়শি ফেলে পুঁটি-কই-শিং-মাগুর এমনকি আটার গুলিও খেয়ে ফেলত নির্ভয়ে। বড়শিতে টোপ গেঁথে ওদের সামনে ফেললে টোপ গিলে বড়শিতে ঝুলত, আমরা মজার খেলায় মাততাম। পোষা রাজহাঁসেরা এদের দেখলে মাথা নামিয়ে অবাক-কৌতূহলী চোখে দেখত শুধু। সঙ্গে বাচ্চা থাকা মুরগিরা শত্রু ভেবে ঠোকর মারত—অনেক সময় মুখে পুরে গিলে ফেলতে চেয়ে দম বন্ধ অবস্থায় পড়ত। নিরীহ প্রাণী। মানুষ যেমন ভয় পায় না ওদের, তেমনি এরাও মানুষকে ভয় পায় না। বর্ষাকালে এদের বাচ্চা হয়, শরৎ-হেমন্তে দেখা যায়। কিন্তু আমাদের এলাকার (বাগেরহাট) বাগানে ছিেনজোঁক কিলবিল করলেও আর্জিনার শরীরে লাগে না, আর্জিনার শরীরে লাগলেও রক্ত পান করার আগেই কেন জানি না গড়িয়ে পড়ে যায়!
এরা ডিম পাড়ে জুলাই-সেপ্টেম্বর মাসে। মাটির ফাটলে, নারকেল-সুপারিগাছের শিকড়ের তলায়, বালুমাটির তলায়, পারিবারিক ইটের পাঁজার ভেতরে ও অন্যান্য জুতসই জায়গায়। ডিমের সংখ্যা ৮-১২টি। রং সাদা। ডিমের আকার অনেকটাই করমচা ফলের মতো, তবে আকার গড়নে করমচার চেয়ে অনেক ছোট। সদ্য ফোটা বাচ্চারা লম্বায় হয় ০১.০২ সেমি থেকে ০১.০৩ সেমি। এরাও ডিম পেড়েই খালাস। তা দেবার বালাই নেই। আপনাআপনিই টিকটিকির বাচ্চার মতো ডিম ভেঙে বেরিয়ে আসে।
নিরীহ এই প্রাণীটি রুদ্ররূপ ধারণ করে প্রজনন ঋতুতে। তখন দুটি পুরুষে কুস্তি লড়ে অনেকটাই খাড়া হয়ে। মূল খাদ্য এদের নানান রকম পোকা-পতঙ্গ-কেঁচো-ছোট ব্যাঙ-ব্যাঙাচি, উইপোকা-পিঁপড়া ও ওদের ডিম-বাচ্চা, বোলতার ডিম ও লাউ-বেগুন-আলু-পাট-আখ-ধানে ক্ষতিকর পোকা। এদিক দিয়ে এরা খুবই উপকারী প্রাণী। আবার, শিকারিও ভালো। পোকা-পতঙ্গ একটু বড় হলে বা চতুর হলে এরা ওত পেতে থেকে শিকারের ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ে, অনেকটাই শিকারি প্রাণীদের মতোই।
তেলতেলে শরীরের এই ভূচর প্রাণীটির নাম আর্জিনা। অঞ্জন, অ্যাঞ্জন, সাপের আঁচিল, সাপের লাঠি ইত্যাদি নামেও পরিচিত। ইংরেজি নাম Keeled grass skink. বৈজ্ঞানিক নাম Eutropis carinata. শরীরের মাপ (লেজ বাদে) ১৩ সেমি। লেজ ১৭ সেমি। শরীরের উপরিভাগটা ধাতব-বাদামি। নিচের রং ক্রিমরঙা অথবা হলুদাভ সাদা। সারা দেশেই দেখা মেলে এদের। এদের চালচলনেও আছে চঞ্চলতা, হাঁটে অনেকটাই হেলেদুলে।