দুটি গ্রিক শব্দ মিলে গঠিত হয়েছে প্রোবায়োটিক কথাটি। গ্রিক শব্দ ‘প্রো’ কথার ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘প্রোমোটিং’। বাংলা অর্থ উন্নয়ন করা। আর ‘বায়োটিক’ কথার ইংরেজি অর্থ হল ‘লাইফ’, যার বাংলা প্রতিশব্দ জীবন। এবার এই দু’টিকে জুড়লে দাঁড়ায় জীবনের উন্নয়ন করা।
তবে প্রোবায়োটিক নিয়ে বিস্তারিত বলার আগে একটু ব্যাকটেরিয়া নিয়ে কয়েকটা কথা বলে নিলে বুঝতে সুবিধা হবে। আসলে ব্যাকটেরিয়ার কথা বলতেই আমাদের বেশিরভাগেরই মনে প্রথমেই সংক্রমণের ছবি ভেসে ওঠে। আর এমন ধারণায় আশ্চর্যের কিছু নেই। তবে পৃথিবীর অন্য সবকিছুর মতো ব্যাকটেরিয়ারও খারাপ-ভালো রয়েছে। আমাদের শরীরের ভিতরেই বহু ভালো ব্যাকটেরিয়া বসবাস করে। এগুলিকে বলে কমেনসাল অর্গানিজম। শরীরকে সুস্থ-স্বাভাবিক রাখতে বিভিন্নভাবে সাহায্য করে এই ভালো ব্যাকটেরিয়াগুলি। এই কারণে শিশু জন্মের সময়ই মায়ের থেকে ব্যাক্টেরয়েডস, বিফিডোব্যাক্টেরিয়াম, ল্যাকটোব্যাসিলাস এবং ইসচেরিশিয়া কোলি-নামক ভালো ব্যাকটেরিয়াগুলি পেয়ে থাকে। এই ব্যাকটেরিয়াগুলি শিশুকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।
তবে অনেকসময় অসুস্থতার জন্য শরীরে এই ভালো ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা এবং প্রভাব, দুই কমতে পারে। তখন বাইরে থেকে ওষুধের মাধ্যমে জীবন্ত ভালো ব্যাকটেরিয়া (লাইভ ব্যাকটেরিয়া) প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয়। বাইরে থেকে ঢুকিয়ে দেওয়া এই ভালো ব্যাকটেরিয়াকে চিকিৎসা পরিভাষায় প্রোবায়োটিক বলে। তবে প্রোবায়োটিক মানে শুধুই ভালো ব্যাকটেরিয়া নয়, ঈস্টও প্রোবায়োটিকের (ফ্যাংগাস) অঙ্গ।
◑ প্রোবায়োটিকের ধারণাটা কবে থেকে এল?
২০ শতকের গোড়ার দিকে রাশিয়ান নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী এলি মেচনিকফ এক আশ্চর্য বিষয় আবিষ্কার করেছিলেন। তিনি লক্ষ করেছিলেন অত্যন্ত দারিদ্র এবং খারাপ আবহাওয়ার সঙ্গে লড়াই করেও বুলগেরিয়ার প্রত্যন্ত গ্রামের একদল ব্যবসায়ী বহুদিন পর্যন্ত সুস্থ শরীরে জীবনযাপন করছেন। কীভাবে তা সম্ভব! বিষয়টা তাঁকে ভাবিয়েছিল। এই মানুষগুলির দৈনন্দিন জীবনযাত্রা পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে এঁদের খাদ্যাভ্যাসের উপর বিশেষ নজর পড়ল তাঁর। তিনি দেখলেন, যে যতটুকুই খাদ্য পাক, সঙ্গে দই রাখাটা প্রায় বাধ্যতামূলক। তিনি এরপর নিজেও বেশ কয়েকদিন যাবৎ খাদ্যতালিকায় দই রাখতে শুরু করলেন। ফলও পেলেন হাতে হাতে। সমগ্র পরীক্ষা থেকে তিনি সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন—অন্ত্রের মধ্যে ভালো ব্যাকটেরিয়ার প্রবেশ করিয়ে সুস্বাস্থ্য গঠন করা সম্ভব। সেইথেকে আধুনিক প্রোবায়োটিক নিয়ে ধারণার যাত্রা শুরু। এরপর বহু গবেষণায় প্রোবায়োটিকের ভালো দিকগুলি বেরিয়ে এসেছে। তবে চিকিৎসা ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিকের ব্যবহার ব্যাপকভাবে শুরু হয় গত শতকের নয়ের দশকে।
◑ প্রোবায়োটিক কত প্রকারের হয়?
১৯৬০ সাল পর্যন্ত প্রোবায়োটিক হিসাবে ক্লস্ট্রিডিয়া, ল্যাকটোব্যাসিল্লি, এনটেরোকক্কি এবং ই কোলি-র কথা জানা ছিল। এরপর গবেষণার গতি অনেকটা বৃদ্ধি পাওয়ায় আরও অনেকগুলি প্রোবায়োটিকের কথা জানা যায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল—
☞ ল্যাকটোব্যাসিলাস—বর্তমানে ৫০-এর বেশি প্রকারের ল্যাকটোব্যসিলাসের অস্তিত্বের কথা জানা যায়। এগুলি মূলত শরীরের পৌষ্টিকতন্ত্র, মূত্রনালি এবং জেনিটাল সিস্টেমে উপস্থিত থাকে।
☞ বিফিডোব্যাকটেরিয়া—এটিও প্রায় ৩০ রকমের হয়। কোলনের মধ্যে এই ব্যাকটেরিয়ার বসবাস। জন্মের মাত্র একদিনের মধ্যেই এই ব্যাকটেরিয়া আমাদের দেহে উপস্থিত হয়।
☞ সাচ্যারোমোইসিস বউলারদি—একমাত্র আবিষ্কৃত ঈস্ট প্রোবায়োটিক হল এটি। এছাড়াও স্ট্রিপটোকোক্কাস থারমোফিলাস, এনটেরোকোক্কাস ফায়সিয়াম, লেউকনোস্টক ইত্যাদি ধরনের প্রোবায়োটিক পাওয়া যায়।
◑ প্রোবায়োটিক কি শুধুই ওষুধ হিসাবে ব্যবহার করা হয়?
সিংহভাগ ক্ষেত্রেই প্রোবায়োটিককে ওষুধ হিসাবে ব্যবহার করা হয়। আবার বর্তমানে ভারতে অনেকসময় ফুড সাপ্লিমেন্ট এবং প্যাকেটজাত খাদ্যেও প্রোবায়োটিক ব্যবহার করা হয়। তবে আমেরিকার ফুড এবং ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (এফডিআই) এবং ইউরোপিয়ান ফেডারেশনের পক্ষ থেকে প্রোবায়োটিকযুক্ত ফুডসাপ্লিমেন্ট এবং প্যাকেটজাত খাদ্যগুলির উপর বেশকিছু নিষেধাজ্ঞা জারি রয়েছে।
◑ প্রোবায়োটিক কাজ করে কীভাবে?
আসলে শরীরে খারাপ ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণের কারণে ভালো ব্যাকটেরিয়াগুলি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। আবার অনেক সময় খারাপ ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করার জন্য ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিকের কারণেও ভালো ব্যাকটেরিয়া মারা যেতে পারে। এছাড়াও অন্যান্য অনেক কারণেই শরীরে ভালো ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা কমে যেতে পারে বা তা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়তে পারে। এরফলে স্বভাবতই শরীরে বিভিন্ন জটিলতার সৃষ্টি হয়। এমন অবস্থায় প্রোবায়োটিক শরীরের ভালো ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে পারে। পাশাপাশি শরীরে ভালো এবং খারাপ ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে স্বাভাবিক ভারসাম্যও ফেরায়।
এখানে আমাদের প্রিবায়োটিকের ধারণাটিও বুঝে নেওয়া দরকার। প্রিবায়োটিক হল একধরনের কার্বোহাইড্রেট। এই কার্বোহাইড্রেট আমাদের শরীরে হজম হয় না। এটি অন্ত্রের প্রোবায়োটিক বা ভালো ব্যাকটেরিয়ার খাদ্য হিসাবে কাজ করে। এরফলে অন্ত্রের ভালো ব্যাকটেরিয়া এবং প্রোবায়োটিক সক্রিয় হয়ে উঠে নিজেদের কাজ করে যেতে পারে।
◑প্রোবায়োটিক কি অ্যান্টিবায়োটিকের বিকল্প?
না, ব্যাপারটা একদমই এরকম নয়। শরীরের খারাপ ব্যাকটেরিয়া নিধনের কাজে অ্যান্টিবায়োটিকের সবসময়ই চাহিদা রয়েছে। তেমনই অ্যান্টিবায়োটিকের প্রভাবে মরে যাওয়া ভালো ব্যাকটেরিয়াগুলির বদলে শরীরে ভালো ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ করানোর জন্য প্রোবায়োটিকের ব্যবহার হয়। এভাবেই অ্যান্টিবায়োটিক এবং প্রোবায়োটিক পাশাপাশি ব্যবহৃত হয়। তবে এখন কয়েকটি রোগের ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে সুফল পাওয়া না গেলে প্রোবায়োটিক দিয়ে চিকিৎসা করা হয়। তবে আবারও বলছি, প্রোবায়োটিক কিন্তু অ্যান্টিবায়োটিকের বিকল্প নয়।
◑ হজমশক্তি বাড়াতে বা হজমতন্ত্রের কার্যক্ষমতা বাড়াতে প্রোবায়োটিকের কী কী সুফল পাওয়া যায়?
আমাদের পাচনতন্ত্রে ভালো এবং খারাপ, দু’ধরনের ব্যাকটেরিয়াই থাকে। তবে খারাপ ব্যাকটেরিয়া থাকা সত্ত্বেও আমাদের কোনও শারীরিক ক্ষতি হয় না। এর কারণ হল ভালো এবং খারাপ ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে একটা ভারসাম্য বজায় থাকে। এটা আমাদের পাচনতন্ত্রের কৃতিত্ব হিসাবেও দেখা যেতে পারে। সুস্থ-স্বাভাবিক অবস্থায় থাকলে আমাদের পাচনতন্ত্র খারাপ সব টক্সিন, ব্যাকটেরিয়া, রাসায়নিক, বর্জ্য পদার্থগুলিকে বের করে দিতে সক্ষম হয়। অথচ বর্তমানের খাদ্যাভ্যাস, চিন্তা, অনিদ্রার মতো সমস্যাগুলির কারণে পাচনতন্ত্রের খারাপ এবং ভালো ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে ভারসাম্য নষ্ট করে দেয়। এতে করে পাচনতন্ত্রে বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হয়। এমন পরিস্থিতিতে প্রোবায়োটিক খুব ভালো কাজ করে। এছাড়া রোগ হিসাবে বললে—ইনফেকশাস ডায়ারিয়া, অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার জন্য ডায়ারিয়া, ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম (আইবিএস), ইরিটেবল বাওয়েল ডিজিজ (আইবিডি), সাধারণ পেট ব্যথা, আলসারেটিভ কোলাইটিস, হেলিকোব্যাকটর পাইলারি ইনফেকশন, নেক্রোটাইজিং এনটেরোকোলাইটিস, অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার ডিজিজের মতো রোগগুলিতেও প্রোবায়োটিক অত্যন্ত কার্যকরী।
◑অন্যান্য আর কোন কোন রোগে প্রোবায়োটিক ব্যবহার করা হয়?
প্রোবায়োটিক বলতেই সবাই গ্যাসট্রোএনটেরোলজির কথা বলে ওঠেন। তবে এখন গবেষণায় গ্যাসট্রো ছাড়াও অন্যান্য অনেকক্ষেত্রেই প্রোবায়োটিকের সুফল সম্বন্ধে বলা হচ্ছে। প্রথমেই ইমিউনিটির কথা আসবে। আসলে ইমিউনিটি হল সেই বস্তু যা বিভিন্ন জীবাণুর সঙ্গে লড়াই করে শরীরকে সুস্থ রাখে। তাই কোনও ব্যক্তির ইমিউনিটি কম থাকলে অ্যালার্জি, অটোইমিউন ডিজিজ (যেমন—রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস,আলসারেটিভ কোলাইটিস, ভ্যাজাইনাল ইনফেকশন ইত্যাদি) এবং বিভিন্ন রকমের ইনফেকশনে (যেমন—ডায়ারিয়া, এইচ পাইলরি ইত্যাদি) আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা অনেকগুণ বেড়ে যায়। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, এই ইমিউন সিস্টেম ভালো রাখার নেপথ্যেও প্রোবায়োটিকের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। তাই ইমিউনিটি বাড়ানোর প্রশ্নে এখন অনেককেই প্রোবায়োটিক দেওয়া যেতে পারে। শরীরের ইমিউন সিস্টেম ভালো থাকলে আপনা থেকেই রোগভোগ কমে। পাশপাশি রিপ্রোডাকটিভ ট্র্যাক্ট, লিপিড প্রোফাইলের সমস্যা, দাঁতের ক্ষয়, ফুসফুসের সমস্যা এবং ডায়াবেটিসের মতো রোগ সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রেও প্রোবায়োটিকের ভূমিকা রয়েছে বলে গবেষণায় উঠে আসছে।
◑কোন খাদ্যে প্রোবায়োটিক থাকে?
এখন বাজারজাত অনেক খাদ্যেই প্রোবায়োটিক মিশিয়ে দেওয়া হয়। তবে সাধারণের কথা বলতে গেলে প্রথমেই টকদই-এর কথা আসবে। এছাড়া দইয়ের ঘোল, ডার্ক চকোলেট, গ্রিন অলিভ, চিজ ইত্যাদিতেও প্রোবায়োটিক থাকে।
তথ্যসূত্র : গুগল