* বিজ্ঞান চেতনায় বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ:
গীতাঞ্জলি কাব্য গ্রন্থ সৃষ্টির জন্য ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হওয়ার কারণে কবি হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবি প্রতিভার বিশ্বময় স্বীকৃত। তাঁর নামেই একটা জাতির বিশ্ব পরিচয় । যার সম্পর্কে কোন কিছুই আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। তিনি কবি, সঙ্গীতজ্ঞ, কথা সাহিত্যিক, নাট্যকার, চিত্রশিল্পী, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, শিক্ষাবিদ ও সমাজ-সংস্কারক। আসলে ঊনিশ শতকের এই মনীষী ছিলেন সাহিত্য, দর্শন ও বিজ্ঞানের ত্রিবেনী সঙ্গমের তীর্থ পথিক। আলোচ্য বিষয়টিতে বিশ্ব পথিক রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞান মনষ্কতা তুলে ধরার প্রচেষ্টা।
বিজ্ঞান মানে বিশেষ জ্ঞান। আর বিশেষ বিশেষ জ্ঞানে জ্ঞানী মানুষেরা বিজ্ঞানী নামে সমাজে পরিচিত। পরীক্ষা-নিরীক্ষা গবেষণার মাধ্যমে স্বতঃসত্য আবিষ্কার করে মানবকল্যাণে বিজ্ঞানীদের নিবেদিত প্রাণ। সাহিত্যেও রয়েছে মানবকল্যাণের অপার সম্ভবনা। পৃথিবী দেখতে কেমন তা সাহিত্য সৃষ্টি তা বুঝতে সাহায্য করে থাকে। কবিতা থেকে উপন্যাস, চলচ্চিত্র থেকে নাটকের মাধ্যমে এই ভূমিকা প্রত্যক্ষ হয়। পাশাপাশি মানব সভ্যতার বিকাশে বিজ্ঞানের অবদান অনস্বীকার্য । বিজ্ঞান যুক্তিপূর্ণ শক্ত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। আর সাহিত্যকে ভাবা হয় আবেগ নির্ভর, কল্পনাশক্তি দ্বারা চালিত। বিজ্ঞানেও আবেগ ও কল্পনার ভূমিকা আছে। আসলে গবেষণার বিষয়বস্তুর প্রতি আবেগ না থাকলে বিজ্ঞানী কাজ করবেই বা কিভাবে? বিজ্ঞানের সাথে সাহিত্যের সম্পর্ক নির্নয়ে রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞান মনষ্কতা পরিচয় পাওয়া যায়। ‘বিশ্বপরিচয়’ গ্রন্থের প্রবন্ধ সূচিতে পরমাণুলোক, নক্ষত্রলোক, সৌরজগৎ, গ্রহলোক, ভূলোক — কঠিন বিষয়গুলো পরিনত মনীষী রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞান চর্চায় অনন্য স্বাক্ষর। অধুনা বিশ্ব মানেই বিজ্ঞান সৃষ্ট সভ্যতা, সেই বিশ্বাস থেকে কৌতুহলী কিশোর রবির বিজ্ঞানের সাথে সংযোগ। শৈশব থেকে পরিনত বয়স পর্যন্ত বিজ্ঞানের মাঝে লুকিয়ে থাকা রসকে বারংবার চিনে নিতে সচেষ্ট হয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর কাছে বিজ্ঞান সংস্কৃতিরই একটা অঙ্গ। তাঁর জীবন দর্শনে বরং বার প্রতিফলিত হয়েছে এই বিজ্ঞান মনস্কতা।
‘জীবনস্মৃতি’ তে কবি শৈশবে তাঁর বিজ্ঞানের প্রতি গভীর আগ্রহের কথা ব্যক্ত করেছেন। কিশোর রবীন্দ্রনাথ বিজ্ঞানের শিক্ষকের কাছ থেকে নিয়মিত ইতিহাস, ভূগোল শিক্ষার পাশাপাশি পদার্থ, রসায়ন, প্রাণীবিদ্যা থেকে এমন কি জ্যোতিষ বিজ্ঞান নিয়ে হাতে কলমে পাঠ নিতেন। পিতা দেবেন ঠাকুরের সঙ্গে পাহারে গিয়ে পর্বতের চূড়া থেকে দূরবীক্ষণ যন্ত্রযোগে নভঃমন্ডলের গ্রহ নক্ষত্রদের চিনে চিনে জ্যোতিষবিদ্যায় বিশেষ আগ্রহী হয়ে উঠেন। সেই আগ্রহের বহিঃপ্রকাশ দেখি, মাত্র বার বছর বয়সে তত্ত্ববোধনী পত্রিকায় তাঁর প্রথম জ্যোতিষ বিজ্ঞান বিষয়ক রচনা "গ্রহগণ জীবের আবাসভূমি"। পরবর্তীতে বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ বশেই তিনি বিজ্ঞানী আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুর সাহচর্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছিলেন। তিনি একবার বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্রের গবেষণার বিষয় নিয়ে ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় ( জড় কি সজীব?) এই শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখে বিজ্ঞানীকে তাক লাগিয়ে দিয়ে ছিলেন। যা পড়ে বিজ্ঞানী বিস্মিত হয়ে কবির শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী হওয়ার সম্ভাবনা উল্লেখ করে প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছিলেন।
গীতাঞ্জলি কাব্য গ্রন্থের জন্য নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হওয়ার পরবর্তীতে বিশ্ব পরিচিতির দৌলতে ও নিজস্ব আগ্রহের কারণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে ইউরোপের বিজ্ঞান মহলে যোগাযোগ স্থাপন হয়। যা থেকেই বোধ হয় কবির সাথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও আলবার্ট আইনস্টাইন দুই ভিন্ন জগতের বাসিন্দার যোগাযোগের সুযোগ তৈরি হয়েছিল। এই দুই মনীষীর জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা ভিন্ন ভিন্ন ভাষা- সংস্কৃতি, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক অর্থনৈতিক পরিবেশে। একজন ছিলেন বিশ্বনন্দিত সাহিত্যিক আর আরেক জন বিজ্ঞান জগতের এক জীবন্ত কিংবদন্তি। শোনা যায় তাদের মধ্যে এত শত তফাৎ থাকা সত্ত্বেও নিজেরা পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠেন। তাদের মধ্যে গভীর বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। জানা যায় আইনস্টাইনের সাথে রবীন্দ্রনাথের মোট চার বার সাক্ষাৎ হয়েছিল। দুই মহারথীর প্রথম সাক্ষাৎ ১৯২৬ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর, জার্মানির সংস্কৃতি মন্ত্রীর আয়োজিত একটি চা-চক্র অনুষ্ঠানে। সেই সূত্র ধরেই তাদের পথ চলা, পরস্পর পরস্পরকে চেনা জানা শুরু। প্রথম আলাপেই আইনস্টাইনের আমন্ত্রণে রবীন্দ্রনাথ তাঁর বাসভবনে আতিথেয়তা গ্রহণ করেন। দ্বিতীয় সাক্ষাৎয়ের এক ঘনিষ্ঠ পরিবেশে তাদের মধ্যে বিশ্ব জগৎ, মনুষ্য চেতনা, সমাজ ও বিজ্ঞান নিয়ে মতামত আদান-প্রদান হয়। যে খবর ১৯৩০ সালের ১০ই আগস্ট নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত “Einstein and Tagore plumb the truth” শিরোনাম থেকে জানা যায়। জার্মানিতে আইনস্টাইনের বাস ভবনেই তিনি প্রথম জানতে পারেন যে ভারতীয় বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর যুগান্তকারী গবেষণার কথা। দেশে ফিরেই তিনি অনুজ সত্যেন্দ্রনাথ বোসকে খুজে বের করে তার সাথে বিজ্ঞান চর্চায় সাথী হন। তারপর আমরা পেলাম তার বিজ্ঞান ভিত্তিক সেই বই ‘বিশ্বপরিচয়’। যে বইটি উৎসর্গ করলেন তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্র নাথ বসুকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও আইনস্টাইনের মধ্যে মোট চার বার সাক্ষাৎ হয়েছিল। তাঁর ইউরোপ ভ্রমন কালেই আকাশ বিজয়, তেজস্ক্রিয়া, পরমাণু তত্ত্বের ইলেকট্রন-প্রোটন দু ধরণের তড়িৎকণা, কোয়ান্টাম মতবাদ, বেতার তরঙ্গ, জীবাণুতত্ত্ব, বংশগতি বিদ্যা প্রভৃতি যুগান্তকারী বৈজ্ঞানিক গবেষণা সংক্রান্ত আবিষ্কার ও অগ্রগতি ঘটেছে। যা রবীন্দ্রনাথের মনেও আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। তিনি বিজ্ঞানের শিক্ষা থেকেই যথার্থ অনুভব করেছিলেন - অন্ধ বিশ্বাসের মুঢ়তার প্রতি অবিশ্বাস বা অশ্রদ্ধা জাগাতে বিজ্ঞান চেতনার বিকল্প নেই। তাঁর স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গিতে বিজ্ঞান সংস্কৃতিরই একটা অঙ্গ। বিজ্ঞানের গভীরে লুকিয়ে থাকা সেই রসকে বারংবার চিনে নিতে চেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর জীবন দর্শনে বার বার প্রতিফলিত হয়েছে বিজ্ঞান মনস্কতা। রবীন্দ্রনাথের এই বিজ্ঞান মনষ্কতার আরেক উল্লেখযোগ্য দিক হলো, জীবন ও পরিবেশ নিয়ে তার সহজাত সচেতনতা বোধ। পৃথিবীজুড়ে আজ সর্বত্রই পরিবেশ দূষণ ও ‘হিউম্যান ইকোলজি’ অর্থাৎ মানুষের সঙ্গে পরিবেশের সম্পর্ক নিয়ে আলোড়ন হচ্ছে, যা ভীষণ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কারণ।
কালজয়ী কবি-সাহিত্যিক রচনাকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন নানা গুণের পরিপূর্ণ এক সম্বৃদ্ধশালী ভান্ডার। নিজেই একা হয়ে উঠে ছিলেন বিশ্বমানের প্রতিষ্ঠান। তাঁর আবির্ভাব ছিল এক যুগান্তকারী ঘটনা । এমনই এক মনীষী তাঁর জীবন বোধ দিয়ে একটা পুরো জাতিকে আজীবন সম্বৃদ্ধ করার চেষ্টা করে গেছেন। যে কারণে কুসংস্কারে আচ্ছন্ন প্রতিক্রিয়াশীল ও ধর্মান্ধ শক্তির বিরুদ্ধে আধুনিক মনষ্কতায় সমাজ উত্তরণে বিজ্ঞানপ্রেমী রবীন্দ্রনাথ আজও প্রাসঙ্গিক।
# মানস রঞ্জন ঘোষ, ০৯ ০৫ ২০২২
10 মে 2022
করেছেন
mahbubur
নাম: লালকুঠি/নর্থব্রুক হল।
স্থানঃ শ্যামবাজার ঢাকা।
সময়কাল: ব্রিটিশ আমল
ব্যবহার: অডিটোরিয়াম
নর্থব্রুক হল লালকুঠি নামেও পরিচিত।
এটি মূলত ব্রিটিশ আমলে একটি টাউন হল হিসেবে
নির্মিত হয়েছিল।
এটি বাংলাদেশের পুরান ঢাকার ফরাশগঞ্জ সড়কে বুড়িগঙ্গা নদীর উত্তর তীরে অবস্থিত।
নর্থব্রুক হল একটি ইন্দো-সারাসেন ভবন, এবং মুঘল স্থাপত্য এবং ইউরোপীয় রেনেসাঁ স্থাপত্য শৈলীর সংমিশ্রণ। অর্ধবৃত্তাকার হর্সশু খিলান উত্তর দিকে প্রধান প্রবেশদ্বার ধারণ করে। উত্তর দিকের চারটি অষ্টভুজাকার মিনার, চূড়া এবং শোভাময় প্যারাপেট সহ, মুসলিম ও মুঘল বৈশিষ্ট্যগুলি দেখায়। জানালা, দরজা এবং দেয়াল ইউরোপীয় শৈলী অনুসরণ করে অলঙ্কৃত ছিল, কিন্তু ভবনের শীর্ষের গম্বুজগুলি মুসলিম শৈলী অনুসরণ করে অলঙ্কৃত ছিল।
10 মে 2022
করেছেন
mahbubur