সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পৃথিবীর আবহাওয়া ব্যাপক রকমের পরিবর্তন এবং চরম পরিস্থিতি লক্ষণীয়। গ্রীষ্মে অতিরিক্ত গরম, ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড়, অতিবৃষ্টি, শীতকালে রেকর্ড তাপমাত্রা হ্রাস সব মিলিয়ে আবহাওয়ায় এলোমেলো অবস্থা পুরো বিশ্বজুড়ে দেখা যাচ্ছে। আবহাওয়ার এই চরম পরিস্থিতিতে এল নিনো ও লা নিনা কে দায়ী করা হচ্ছে। কী এই এল নিনো ও লা নিনা?
১৬ শতকে দক্ষিণ আমেরিকার একদল জেলে মাছ শিকার করতে গিয়ে খেয়াল করে সমুদ্রজল স্বাভাবিকের তুলনায় অধিক উষ্ণ। অস্বাভাবিক এই পরিস্থিতির নাম তাঁরা দিলেন এল নিনো দে নাভিদাদ। স্প্যানিশ ভাষায় যার অর্থ ক্রিসমাসের সময়ের ছোট বালক। মূলত এই ঘটনা ডিসেম্বরের সময় ঘটে বলে তারা এই নাম দেয়, পরবর্তীতে সেখান থেকেই ‘এল নিনো’ নামটি আসে। অন্যদিকে এল নিনোর বিপরীত ঘটনা হলো ‘লা নিনা’। এটিও একটি স্প্যানিশ শব্দ যার অর্থ ছোট বালিকা।
প্রায় প্রতি দুই থেকে সাত বছর পর পরই এই এল নিনো এবং তার পরপরই লা নিনা পর্যায়ক্রমে দেখা যায়। এল নিনো এবং লা নিনা এই দুটি ব্যাপার বুঝতে হলে সবার প্রথমে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে বায়ু প্রবাহের যে চক্র তা বুঝতে হবে। বোঝার সুবিধার্থে ধরা যাক একটি বড় সুইমিংপুল পানি পূর্ণ অবস্থায় আছে। এর ঠিক মাঝামাঝিতে হিটারের সাহায্যে তাপ দেওয়া হচ্ছে। এর ফলে শুধু সুইমিংপুলের মাঝামাঝি অঞ্চলের পানিই গরম হচ্ছে অপরদিকে পুলের চারদিকের পানি ঠান্ডা অবস্থায় আছে।
ঠিক এমন অবস্থায় যে ঘটনাটি ঘটবে তা হল সুইমিংপুলের মাঝের অঞ্চলের পানি জলীয় বাষ্প হয়ে উপরে উঠে যাবে। একই সাথে তাপ দেয়ার কারণে সুইমিংপুলে গরম পানির অংশের পৃষ্ঠের কাছাকাছি বাতাস গরম হয়ে উপরে উঠে যাবে। এতে গরম পানির কাছাকাছি এলাকায় বাতাসের ঘাটতির ফলে নিম্নচাপ দেখা দিবে। একই সময় সুইমিংপুলের চারপাশের ঠান্ডা পানি সংলগ্ন বাতাস পানির কাছাকাছিই থাকবে।
তাই সুইমিংপুলে গরম অংশের পানির পৃষ্ঠের তুলনায় ঠান্ডা অংশের পানির পৃষ্ঠে বায়ুর চাপ বেশি থাকবে। যেহেতু পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম অনুসারে বায়ু উচ্চচাপের অঞ্চল থেকে নিম্নচাপের অঞ্চলের দিকে ধাবিত হয় তাই ঠান্ডা পানির পৃষ্ঠ বরাবর সব বাতাস গরম অংশের দিকে ধাবিত হবে।
অন্যদিকে সুইমিংপুলের একটু উপরের দিকে সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী একটি ঘটনা ঘটবে। গরম পানির অঞ্চল থেকে গরম হয়ে যাওয়া বাতাস উপরের দিকে উঠে যাবে এবং তা আশেপাশে ছড়িয়ে যাবে। ধীরে ধীরে যখন এই বাতাস তাপ হারাতে থাকবে তখন তা পুনরায় নিচে চলে আসবে অর্থাৎ ঠান্ডা পানির পৃষ্ঠের কাছাকাছি চলে আসবে ফলাফল ঠান্ডা পানির অংশে বায়ুর চাপ প্রতিনিয়ত বেশি থাকবে এবং গরম পানি অংশে বায়ুর চাপ কম থাকবে।
পুরো ব্যবস্থাটিকে একবারে চিন্তা করলে দেখা যাচ্ছে গরম পানির অঞ্চল থেকে উপরে উঠে যাওয়া বাতাস, উপর দিয়ে ঠান্ডা পানি অঞ্চলের দিকে চলে যাচ্ছে এবং তাপ হারিয়ে ঠান্ডা হয়ে তা আবার নিচে ঠান্ডা পানির কাছাকাছি চলে যাচ্ছে। সেই একই ঠান্ডা বাতাস পুনরায় গরম পানির কাছাকাছি চলে যাচ্ছে। যা বাতাসের একটি ক্রমাগত চলমান চক্র তৈরি করে দিচ্ছে।
ঠিক এমনই একটি বাতাসের চক্র প্রতিনিয়ত পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে চলমান। একে বলা হয় Walker Circulation। প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে বাতাসের এই চক্র প্রতিনিয়ত চলছে যা প্রশান্ত মহাসাগর এবং তার আশপাশের অঞ্চলের আবহাওয়ার উপর সরাসরি প্রভাব ফেলে।
Walker Circulation যে শুধুমাত্র প্রশান্ত মহাসাগরে দেখা যায় তা কিন্তু নয়। সূর্যের সাপেক্ষে পৃথিবীর অবস্থান এবং পৃথিবীর গোলাকার আকৃতির কারণে সব অঞ্চলে সমানভাবে তাপ পড়ে না। বিষুবীয় তথা পৃথিবীর মাঝামাঝি অংশে সূর্যের তাপ হয় সর্বোচ্চ। আর প্রশান্ত মহাসাগর যেহেতু আয়তনের দিক দিয়ে সবচেয়ে বড় তাই এই Walker Circulation প্রশান্ত মহাসাগর এলাকায় লক্ষণীয় মাত্রায় দেখা যায়। প্রশান্ত মহাসাগরে এই চক্রকে আলাদাভাবে Pacific Walker Circulation নাম দেওয়া হয়েছে।
এইতো গেল স্বাভাবিক পরিস্থিতির ঘটনা। এবারে আসা যাক এল নিনো এবং লা নিনাতে। এল নিনো এবং লা নিনা এই দুই ঘটনা নির্ভর করে পৃথিবীর আরও একটি বায়ুচক্রের উপর। পৃথিবীর মেরু থেকে বিষুবীয় অঞ্চলে যেহেতু তাপমাত্রা তুলনামূলক বেশি তাই মেরু অঞ্চল থেকে বিষুবীয় অঞ্চলে বায়ুর চাপ তুলনামূলক কম। ফলে walker circulation এর মতই আরো এক ধরনের বায়ুচক্র দেখা দেয় যা পৃথিবীর উত্তর ও দক্ষিণ থেকে বিষুবীয় অঞ্চলের দিকে বায়ু প্রবাহ তৈরি করে। একে বলা হয় Global Atmospheric Circulation বা Atmospheric Circulation।
কিন্তু পৃথিবীর ঘূর্ণনের ফলে এই বায়ু কিছুটা বেঁকে যায় ফলে মেরু অঞ্চল থেকে বিষুবীয় অঞ্চলে সরাসরি সোজা পথে না এসে কিছুটা পশ্চিম দিকে বাঁকতে শুরু করে। পৃথিবীর তাপমাত্রা উঠা নামার কারণে কোনো কোনো বছর এই বায়ুপ্রবাহ তুলনামূলক বেশি হয়ে যায়। যখন এই বায়ু প্রবাহ বেড়ে যায় তখন তা Walker Circulation এর উপর প্রভাব ফেলে।
স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে Walker Circulation এবং Atmospheric Circulation মিলে প্রশান্ত মহাসাগরের পৃষ্ঠের বায়ু পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে চলাচল তৈরি করে। ফলাফল, অস্ট্রেলিয়া এবং তার আশপাশের অঞ্চলের আকাশে মেঘ দেখা দেয় এবং স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হয় যা প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিম দিকে অবস্থিত, তবে ল্যাটিন আমেরিকার দেশ চিলির, ইকুয়েডর আর পেরুর সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলে কোন বৃষ্টি থাকে না। ঠিক অনেকটা সেই সুইমিংপুলের পানির উপর বায়ুচক্রের মতো।
কিন্তু যেই বছরে Atmospheric Circulation এর বায়ুপ্রবাহ তুলনামূলক বেশি থাকে সেই বছরে প্রশান্ত মহাসাগরের পৃষ্ঠে পূর্ব থেকে পশ্চিমে বায়ুপ্রবাহ স্বাভাবিকের তুলনায় একটু বেশি হয়। যার ফলাফল স্বরূপ Walker Circulation এ অতিরিক্ত বায়ু চলে আসে আর আবহাওয়া তার চরম রূপ প্রদর্শন করে। অস্ট্রেলিয়া এবং ওশেনিয়া অঞ্চলে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত ও বন্যা দেখা দেয় এবং ল্যাটিন আমেরিকার প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূলে চরম অনাবৃষ্টি এবং খরা দেখা দেয়। একে বলে লা নিনা (La Nina)
এর সম্পূর্ণ উলটো চিত্র হলো এল নিনো। মেরু ও বিষুবীয় অঞ্চলে তাপমাত্রার পার্থক্য কম হলে বায়ু চাপের পার্থক্য কম থাকে আর এতে Atmospheric Circulation এ কম বায়ুপ্রবাহ হয়। ফলাফলস্বরূপ স্বাভাবিকের তুলনায় কম বায়ু পূর্ব থেকে পশ্চিমে যায়। যার ফলে প্রশান্ত মহাসাগরের পৃষ্ঠের কাছাকাছি গরম বাতাস এবং গরম পানি পশ্চিম দিকে খুব একটা যেতে পারে না।
ফলাফলস্বরূপ গরম বাতাস প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝখানের এলাকাতেই থেকে যায় আর সেখানেই তৈরি হয় নিম্নচাপ এবং প্রচুর পরিমাণে জলীয় বাষ্প। মাত্রাতিরিক্ত জলীয় বাষ্প মহাসাগর এবং ল্যাটিন আমেরিকার পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলে অতিবৃষ্টির সৃষ্টি করে। আর অস্ট্রেলিয়া এবং ওশেনিয়া এলাকায় দেখা যায় খরা এবং অনাবৃষ্টি।
সম্পূর্ণ ব্যাপারটিকে সহজ ভাবে বললে, Walker Circulation, Atmospheric Circulation আর পৃথিবীর ঘূর্ণন গতি এই তিন মিলে প্রশান্ত মহাসাগরের পানির পৃষ্ঠের কাছাকাছি অঞ্চলে পূর্ব থেকে পশ্চিমে একটি স্বাভাবিক বায়ু প্রবাহ তৈরি করে। কিন্তু পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও হ্রাসের সাথে সাথে Atmospheric Circulation এর বায়ু প্রবাহ বাড়ে ও কমে। বায়ু প্রবাহ বেড়ে গেলে দেখা দেয় লা নিনা। আর কমে গেলে হয় এল নিনো।
এখন এই এল নিনো এবং লা নিনাতে যে শুধু প্রশান্ত মহাসাগর এবং তার আশেপাশে এলাকাতেই হতে পারে তা কিন্তু নয়। এল নিনো এবং লা নিনার ফলে আরো এক ধরনের বায়ুপ্রবাহকে সরাসরি প্রভাব পড়ে। সেই বায়ু প্রবাহ হল Jet Stream।
পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের ট্রপোস্ফিয়ার অঞ্চলে উচ্চগতির বায়ু প্রবাহ বিরাজমান। এই বায়ু প্রবাহ তুলনামূলক সরু এবং অনেক দীর্ঘ আর আঁকাবাঁকা পথে চলাচল করে। অনেকটা আমাজন নদীর মত। এই বায়ু প্রবাহ কোন দিকে বেঁকে যাবে তা নির্ভর করে পৃথিবী কোন অঞ্চলের বায়ুর তাপমাত্রা কী রকম আছে তার উপর।
মেরু অঞ্চল থেকে ঠান্ডা বাতাস এবং বিষুবীয় অঞ্চলের গরম বাতাস এর মাঝামাঝি দিয়ে খুবই সরু কিছু চ্যানেল বা প্রণালি তৈরি হয়। এই উচ্চগতি সম্পন্ন বায়ুপ্রবাহ গুলো আবহাওয়ায় ব্যাপক প্রভাব ফেলে।
উদাহরণস্বরূপ, যখন লা নিনা হয় তখন প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্ব অঞ্চল তথা ল্যাটিন আমেরিকার উপকূলীয় অঞ্চলে উচ্চচাপ তৈরি হয়। ফলে ট্রপোস্ফিয়ার অঞ্চলে উচ্চগতিসম্পন্ন জেট স্ট্রিম স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি উত্তরদিকে চলে যায়। এতে আমেরিকার দক্ষিণ অংশের জলীয় বাষ্প প্রায় থাকেই না এবং উত্তরদিকে জেট স্ট্রিম চলে যাওয়ায় উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে অত্যধিক পরিমাণে জলীয়-বাষ্প, বৃষ্টিপাত এবং তাপমাত্রা হ্রাস হয় এবং এল নিনো এর সময় আমেরিকায় হয় উলটো ঘটনা।
এমনিতে আরও একটি ঘটনা ঘটে তা হল পৃথিবীর অন্যান্য অংশে ওয়াকার সার্কুলেশনের স্থানচ্যুতি। প্রশান্ত মহাসাগরের ওয়াকার সাইকেল এর মতো ভারতীয় মহাসাগরেও রয়েছে ওয়াকার সার্কুলেশন যা ভারতীয় মহাসাগরে নিম্নচাপ তৈরি করে। কিন্তু এল নিনোর ফলে ওয়াকার সার্কুলেশনের অবস্থান পাল্টে যায়, ফলাফল স্বরূপ মধ্যপ্রাচ্যের অস্বাভাবিক পরিমাণের নিম্নচাপ ও জলীয়বাষ্প দেখা দেয়। যার ফলে গেল বছরই মধ্যপ্রাচ্যের মরুভূমি অঞ্চলে সবুজ গাছপালা জন্মাতে দেখা গিয়েছে।
ওয়াকার সার্কুলেশন এর এমন স্থান পরিবর্তনের ফলে ভারতীয় উপমাসাগরে স্বাভাবিকের তুলনায় কম উচ্চচাপ দেখা যায়। ফলে ভারতীয় উপমহাদেশ ও তার আশপাশ অঞ্চলে ভারতীয় মহাসাগর থেকে আসা জলীয় বাষ্পের পরিমাণ কমে যায়, যা গ্রীষ্ম বা শুকনো মৌসুমের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। গ্রীষ্ম মৌসুমে অনাবৃষ্টি এবং জেট স্ট্রিমের অবস্থান পরিবর্তন এই দুই মিলে গ্রীষ্মে আবহাওয়া অস্বাভাবিক রকমের গরম হয়ে যেতে পারে যার ফলে দেখা দেয় হিট ওয়েভ এর মত ভয়াবহ পরিস্থিতি। ঠিক একইভাবে এল নিনোর সম্পূর্ণ উলটো ঘটনাটি চলার সময় দেখা দেয় চরম ঠান্ডা।
ইতোমধ্যেই মধ্যেই বাংলাদেশ, ভারত সহ দক্ষিণ এশিয়ার অঞ্চলে এই প্রভাব দেখা দিচ্ছে। ২০২৩ সালে বাংলাদেশের তিন তিনটি ঘূর্ণিঝড়, অতিরিক্ত গরম এবং শীতে অতিরিক্ত ঠান্ডা আবহাওয়ার সাক্ষী হয়েছে পুরো দেশবাসী।
এল নিনো এবং লা নিনা এর জন্য গ্রিন হাউজ গ্যাসকে দায়ী করা হয় হয়। তবে এই নিয়ে বিজ্ঞানীরা এখনো নিশ্চিত নন। বিশেষজ্ঞদের মতে,
“২০২৪ সাল ইতিহাসে উষ্ণতম বছর হতে যাচ্ছে। পাশাপাশি আবহাওয়ার অন্যান্য চরম অবস্থাগুলো বৃদ্ধি পেতে পারে।”
জুম্মান আল সিয়াম/ নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: স্পেস, ক্লাইমেট.গভ, উইকিপিডিয়া