স্কুল কলেজে কেমিস্ট্রি বা রসায়ন নিয়ে তো অনেকেই পড়েছি। পদার্থবিজ্ঞানেও পড়া হয়েছে কোয়ান্টাম তত্ত্ব নিয়ে। কিন্তু কোয়ান্টাম সুপারকেমিস্ট্রি সম্পর্কে জানেন কি?
কোয়ান্টাম সুপারকেমিস্ট্রি আজ পর্যন্ত কেবলই বিজ্ঞানীদের একটি ধারণা হিসেবে ছিল কিন্তু প্রথমবারের মতো গবেষণাগারে এর প্রমাণ পাওয়া গেছে। এটি বুঝতে হলে আগে কোয়ান্টাম তত্ত্ব নিয়ে একটু আলোচনা করতে হবে। কোয়ান্টাম তত্ত্ব হলো আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের তাত্ত্বিক ভিত্তি যা পারমাণবিক স্তরে পদার্থ এবং শক্তির প্রকৃতি এবং এর আচরণ ব্যাখ্যা করে।
ইউনিভার্সিটি অফ শিকাগো এর একটি গবেষক দল “কোয়ান্টাম সুপারকেমিস্ট্রি”-এর প্রথম প্রমাণ ঘোষণা করেন। কোয়ান্টাম সুপারকেমিস্ট্রি দ্বারা এমন এক ঘটনার কথা বোঝায় যেখানে একই কোয়ান্টাম স্টেট (Quantum State) বা কোয়ান্টাম অবস্থায় থাকা একগুচ্ছ অণু বা পরমাণু একই সময়ে সম্মিলিতভাবে ত্বরান্বিত বিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায়। পূর্বে এই সম্পর্কিত ভবিষ্যদ্বাণী করা হলেও পরীক্ষাগারে কখনও এর প্রমাণ পাওয়া যায় নি।
কোয়ান্টাম স্টেট তাহলে কি?
কোয়ান্টাম স্টেট বা কোয়ান্টাম অবস্থা হচ্ছে এমন একটি গাণিতিক সত্ত্বা যা দ্বারা কোয়ান্টাম সিস্টেমের অবস্থাকে প্রকাশ করা যায়। কোয়ান্টাম সিস্টেম হচ্ছে এমন একটি সিস্টেম যা কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যা অনুযায়ী আচরণ করে। এটি পদার্থবিদ্যার একটি শাখা যা প্রকৃতির ক্ষুদ্রতম কণা এবং শক্তির সাথে কাজ করে।
কোয়ান্টাম সিস্টেমে কণাসমূহের এমন বৈশিষ্ট্য থাকে যা সাধারণ থেকে খুব আলাদা যেমন একসাথে একাধিক অবস্থায় থাকা, স্থান ও সময় জুড়ে সংযুক্ত হওয়া এবং কোনো কিছুর ব্যাপারে পরিমাপ না হওয়া পর্যন্ত অনিশ্চিত থাকা। কোয়ান্টাম সিস্টেমগুলো পদার্থ এবং শক্তির গঠন এবং আচরণ বোঝার জন্য এবং কোয়ান্টাম কম্পিউটার, কোয়ান্টাম সেন্সর এবং কোয়ান্টাম ক্রিপ্টোগ্রাফির মতো নতুন প্রযুক্তির বিকাশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
জেমস ফ্রেঙ্ক ইন্সটিউট (James Franck Institute) ও এনরিকো ফার্মি ইন্সটিউট (Enrico Fermi Institute) এর সদস্য, পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক চেং চিন (Cheng Chin) (যার পরীক্ষাগারে পরীক্ষণটি করা হয়েছিলো) বলেন, “আমরা যা দেখেছি তা তত্ত্বীয় ভবিষ্যদ্বাণীগুলোর সাথে মিলে গেছে। বিগত ২০ বছর ধরে এটি কেবলই একটি বৈজ্ঞানিক লক্ষ্য ছিলো। তাই বর্তমান যুগ আমাদের জন্য খুবই উত্তেজনাময়।”
কতগুলো অণু-পরমাণুকে একই কোয়ান্টাম স্টেটে নিতে হলে তাদেরকে ০ কেলভিন তথা পরম শূন্য তাপমাত্রার কাছাকাছি তাপমাত্রায় নিতে হয়। এই অবস্থায় তারা অস্বাভাবিক ক্ষমতা অর্জন এবং আচরণ প্রদর্শন করতে পারে। বিজ্ঞানী চিন এর দল পরমাণুসমূহকে একই কোয়ান্টাম স্টেটে নিয়ে যাওয়াতে পারদর্শী। কিন্তু অণুর গঠণ পরমাণু থেকে জটিল হওয়ায় অণুদেরকে একই কোয়ান্টাম স্টেটে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাদেরকে একটি নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করতে হয়েছে। তারা সিজিয়াম পরমাণুসমূহকে শীতল করে একই কোয়ান্টাম অবস্থায় রাখেন। এরপরে তারা দেখতে পান যে পরমাণুরা বিক্রিয়া করে অণু গঠন করে।
সাধারণত ভিন্ন ভিন্ন পরমাণুর মধ্যকার প্রতিটি সংঘর্ষের জন্য একটি করে অণু গঠনের অনেক বেশি সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞান ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে একই কোয়ান্টাম অবস্থায় পরমাণুসমূহ সম্মিলিতভাবে বিক্রিয়া সম্পাদন করে।
চিন আরো বলেন, “কেউ আর রাসায়নিক বিক্রিয়াকে স্বাধীন কণার মধ্যে সংঘর্ষ হিসাবে বিবেচনা করতে পারবেন না। এটিকে একটি দলীয় প্রক্রিয়া হিসাবে চিন্তা করতে হবে। কারণ তারা সবাই সামগ্রিকভাবে একসাথে বিক্রিয়া করছে ।”
এর দুইটি ফলাফল হতে পারে। প্রথমটি হলো যে বিক্রিয়াটি সাধারণ বিক্রিয়ার তুলনায় দ্রুত ঘটে। এই সিস্টেমে যত বেশি পরমাণু থাকবে, বিক্রিয়া তত দ্রুত ঘটবে। এর কারণ হচ্ছে বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী সকল পরমাণু/অণু একটি অবিচ্ছিন্ন সত্তার মতন আচরণ করে।
আরেকটি ফলাফল হলো যে বিক্রিয়া শুরুতে একই কোয়ান্টাম স্টেটে থাকার ফলে বিক্রিয়ার শেষে তারা একই আণবিক অবস্থায় থাকে।
বিজ্ঞানীরা আশা করছেন যে এই অগ্রগতি একটি নতুন যুগের সূচনা হিসেবে প্রদর্শিত হবে। যদিও এই পরীক্ষাটি সাধারণ কণাসমূহের সাথে সঞ্চালিত হয়েছিলো। তারা বৃহত্তর এবং আরো জটিল অণুসমূহ পরিচালনা করার জন্য কাজ করার পরিকল্পনা করেন।
চিন আরো বলেন, “আমরা আমাদের বিচারবুদ্ধি এবং কোয়ান্টাম ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানকে আরও জটিল অণুতে সম্প্রসারণ করতে আরো অনেক দূর নিয়ে যেতে পারি। এই বৈজ্ঞানিক কমিউনিটিতে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার দিক।”
হাসিবুল ইসলাম সৌরভ / নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: সাইন্স অ্যালার্ট, সাইটেক ডেইলি, ফিজিক্স.অর্গ