বৈচিত্রময়তা আমাদের প্রকৃতিকে করে তুলেছে আকর্ষণীয় ও আগ্রহপূর্ণ। মানবজীবনের অন্যতম একটি বৈচিত্র্যময় ব্যাপার হচ্ছে যমজ বাচ্চা (Twin baby) জন্মগ্রহন। পিতামাতার যৌন মিলনের মাধ্যমে নিষিক্ত ডিম্বাণু থেকে একটি ভ্রুণ তৈরী হয় এবং পরবর্তীতে সেই ভ্রুন থেকেই একটি শিশু জন্ম নেয়। তবে এখন অব্দি পৃথিবীতে যমজ বাচ্চা জন্ম নেওয়া অন্যতম একটি বৈচিত্র্যময় ব্যাপারই বটে। যমজ বাচ্চা দেখতে হুবহু একই রকম (Identical Twin) হতে পারে কিংবা দেখতে ভিন্ন ও হতে পারে কিংবা ভিন্ন লিঙ্গের ও হতে পারে।
তবে বর্তমানে এক গবেষণা অনুযায়ী বলা হচ্ছে দেখতে একই রকম অর্থাৎ (Identical Twin) যমজ বাচ্চা দের DNA ১০০% এক নয়। এদের মধ্যে রয়েছে জেনেটিক ভ্যারিয়েশন। অর্থাৎ, আমরা যা ধারণা করি যে দেখতে হুবহু একই যমজ বাচ্চারা একই DNA সম্পন্ন কিংবা এদের মধ্যে কোনো ভিন্নতা নেই, তা সঠিক নয়।
যমজ বাচ্চা (Twin baby) জন্মগ্রহণ নিয়ে পূর্বেকার দিনে আগ্রহের শেষ ছিলো না। তবে Medical Science এর উন্নতি ও প্রযুক্তির কল্যাণে মানুষ নতুন নতুন গবেষণা ও সমস্যার সমাধান ঘটাতে সক্ষম হয়।
সাধারনত নারীদের প্রতি ঋতুচক্রে ডিম্বাশয় থেকে একটি ডিম্বাণু নির্গত হয়। কখনও কখনও দুটি ডিম্বাণু ও নির্গত হয়। প্রায় একই সময়ে উৎপন্ন হওয়া এই ডিম্বাণু দুটিকে পিতা হতে আগত শুক্রাণু নিষিক্ত করে ফেলে। এক্ষেত্রে ভিন্নধর্মী ঘটনা ও ঘটতে পারে। অর্থাৎ, একটি ডিম্বাণু দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে দুটি ভ্রুণে রুপান্তরিত হতে পারে এবং এর ফলেও যমজ বাচ্চা (Twin baby) জন্ম নিতে পারে।
যমজ বাচ্চাদের বেলায় আমরা সাধারণত কয়েক ধরণের ব্যাপার পর্যবেক্ষণ করে থাকি যেমনঃ দেখতে হুবহু একই, উভয়ই দেখতে ভিন্ন, ভিন্ন লিঙ্গের (খুবই সামান্য ক্ষেত্রেই দেখা যায়) ইত্যাদি। মূলত এরা (Twins) দুই ধরণেরঃ
১. Identical twins
২. Fraternal twins
সম্প্রতি এক গবেষণায় এটি দেখা গিয়েছে যে একই ভ্রুণ থেকে জন্ম নেওয়া দুটি যমজ বাচ্চার মধ্যেও ৫.২% পরিবর্তন/ রুপান্তর(Mutation) পরিলক্ষিত হয় অর্থাৎ জেনেটিকাল পরিবর্তন দেখা যায়। একই ভ্রুণ থেকে জন্ম নেওয়া যমজ বাচ্চাদের কে মনোজাইগোটিক যমজ (Monozygotic Twin) বলা হয়। কিন্তু একই ভ্রুণ থেকে জন্ম নেওয়া যমজ বাচ্চা দুটি একে অপরের থেকে জিনগতভাবে আলাদা! অদ্ভুত শোনাচ্ছে না?
University of Pennsylvania এর জেনেটিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক Ziyue Gao একটি ই-মেইল বার্তায় জানান “আশ্চর্যজনক ভাবে মনোজাইগোটিক যমজ বাচ্চাদের এই গবেষণায় কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, এদের মধ্যে প্যারেন্ট কোষ থেকে আসা রুপান্তর একজন বাচ্চার সমস্ত কোষে উপস্থিত থাকলেও অপর বাচ্চার কোষে এই রুপান্তর অনুপস্থিত।”
তিনি ধারণা করছেন যে, নিষিক্ত ডিম্বাণুর বিভক্তির ঠিক আগে কিংবা ঠিক পরেই এই পরিবর্তন/ রুপান্তর (Mutation) বিন্যাস্ত হয়। তবে এক্ষেত্রে এই বিন্যাস সুষমভাবে হয় না ফলে এদের জিনগত পরিবর্তন লক্ষ্যণীয়। উক্ত গবেষণার ভিত্তিতে প্রায় ১৫% যমজ বাচ্চার মাঝে এই রুপান্তরজনিত (Mutational) ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়।
অপরদিকে আইসল্যান্ডের এক গবেষণা দল ৩৮১ জোড়া অভিন্ন যমজ (Monozygotic Twins) এর জিনগত পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রদান করেন। এদের মাঝে ৩৮ জোড়া সম্পূর্ণ অভিন্ন DNA বিন্যাস সম্পন্ন। কিন্তু বাকী জোড়া সমুহের ক্ষেত্রে তাদের DNA বিন্যাসে ভিন্নতা রয়েছে। এদের মাঝে ৩৯ টি জোড়া এমন যে তাদের মাঝে প্রায় ১০০ টিরও বেশি পরিবর্তন পরিলক্ষিত।
বায়োফার্মাসিউটিক্যাল সংস্থা Amgen এর সহায়ক সংস্থা deCODE genetics এর CEO Kari Stefansson এতে আরও যোগ করে বলেন, “জিনোম বিন্যাস যা একটি সুনির্দিষ্ট প্রোটিন কোড অনুযায়ী সজ্জিত, এছাড়া যমজ বাচ্চাদের (Twin baby) জিনোমের এই পরিবর্তনসমূহ ঠিক কোথায় সংঘটিত হয় তা ভবিষ্যতে গবেষণার এক অন্যতম ক্ষেত্র হতে পারে এবং এটি গুরুত্বপূর্ণ তাদের বিভিন্ন জিনগত পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট রোগ কিংবা পরিবেশগত প্রভাবসমূহের ফলাফল নির্ণয়ের ক্ষেত্রে।”
Stefansson এর মতে, ডিম্বাণু নিষিক্তের ৭-৮ দিনের মধ্যেই এটি বিভক্ত হয়ে থাকে এবং ভ্রুণ দুটি পৃথক হয়ে যায়। কিছু ব্যতিক্রম ক্ষেত্রে এটি সম্পন্ন হতে ৮-১৩দিন ও লাগতে পারে। তবে প্রফেসর Ziyue Gao এর সাথে সম্মতি রেখে তিনিও ব্যক্ত করেন, ভ্রুণ বিভক্তির ঠিক শুরুতেই তাদের মধ্যে DNA বিন্যাস সম্পন্ন হয়। অর্থাৎ পরবর্তীতে রুপান্তরসমূহ (Mutations) দুটি ভ্রুণে অসমভাবে হয়। তবে ব্যতিক্রম ক্ষেত্রে দেখা যায় ডজনখানেক কোষপুঞ্জের বলয় সৃষ্টি হওয়ার পরে ও তা বিভক্তির পরে ও বিন্যাস ঘটে তবে প্যারেন্ট কোষ থেকে আসা রুপান্তর একটিতে (১ম ভ্রুণে) পরিলক্ষিত হলেও অপরটিতে (২য় ভ্রুণে) দেখা যায় না।
গত ৭ই জানুয়ারি, ২০২১ইং এ Nature Genetics জার্নালে এক অনন্য গবেষণা তথ্য প্রকাশিত হয় যেখানে একটি গবেষনা দল তিনটি প্রজন্ম নিয়ে কাজ করেছে। এখানে প্রায় ৩৮৭জোড়া অভিন্ন যমজ (Monozygotic Twins) ও দুটি ট্রিপল সহ পাশাপাশি এদের বাবা-মা ও তাদের সন্তানদের নিয়ে গবেষণাটি পর্যবেক্ষণ করা হয়। অর্থাৎ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে জিনগত ভ্যারিয়েশন কিংবা রুপান্তর (Mutation) এর সুনির্দিষ্ট তথ্য বের করাই ছিলো এর মূল উদ্দেশ্য।
অর্থাৎ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে কোন রুপান্তর/ পরিবর্তন (Mutation) কোন যমজ বাচ্চাগুলিতে কতটুকু হচ্ছে।
এক্ষেত্রে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে যে পরিবর্তন প্রবাহিত হতে দেখা যায় তা মূলত জননকোষীয় রুপান্তর (Germinal mutation) এবং এগুলো ডিম্বাণু, শুক্রাণুতে প্রদর্শিত হয়। একই রুপান্তর যদি পিতামাতার সোমাটিক কোষেও উপস্থিত থাকে তবে উক্ত পরিবর্তন তাদের প্রাথমিক বিকাশেই সংঘটিত হয়েছিলো।
আবার National Cancer Institute এর তথ্যমতে গর্ভধারণের কয়েক সপ্তাহেই কোনও কোষ জননকোষে পরিণত হয় না। অর্থাৎ সমস্ত কোষ তখন অভিন্ন রুপান্তর (Mutation) প্রাপ্ত হতে পারে। তবে বিভাজনের পর সোম্যাটিক এবং জননকোষের সৃষ্টি হলে সোম্যাটিক কোষে প্রদর্শিত নতুন রুপান্তর ব্যাক্তির বাচ্চারা পাবে না। তবে এই রুপান্তর(Mutation) দুটি যমজ বাচ্চা (Twin baby) র মাঝে প্রদর্শিত হলে এবং তা বংশানুক্রমে প্রবাহিত হলে ধারণা করা হয় উক্ত রুপান্তর (Mutation) এদের প্রাথমিক বিকাশের সময়ই ঘটে যখন সমস্ত কোষ একত্রে ছিলো অর্থাৎ বিভাজন ঘটে নি।
এটিই পূর্বে Ziyue Gao উল্লেখ করেছিলেন। গবেষক দলটি এই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে রুপান্তরসমূহের পাশাপাশি যমজ বাচ্চা দুটির মাঝে এমন কিছু রুপান্তর (Mutation) এর অনুসন্ধান করছিলেন যা দুজনের মাঝেই উপস্থিত তবে সমস্ত কোষে উক্ত রুপান্তর অভিন্ন ভাবে পরিলক্ষিত হয় নি। এই ঘটনাকে মোজাইকিজম (Mosaicism) বলা হয় এবং Ziyue Gao আরও যুক্ত করেন “নিষেকের পরপরই রুপান্তরটি ভ্রুণ বিভক্তির পূর্বেই তৎক্ষনাৎ বাহিত হয় যমজদ্বয়ের মাঝে।”
উক্ত পরীক্ষার ফলাফলস্বরূপ গবেষণা দল এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে হুবহু একই দেখতে Monozygotic Twins দের মাঝে DNA অভিন্ন এ কথা বলা যায় না। এছাড়া এটিও স্পষ্ট যে রুপান্তরের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে একটি যমজে প্রায়শয়ই স্পষ্ট প্রতীয়মান হলেও অপরটির ক্ষেত্রে তা দেখা যায় নি।
তবে Ziyue Gao এর মতে গবেষণাটির সীমাবদ্ধতা এই যে, তারা গালের ত্বক ও রক্ত নমুনা হতে DNA সংগ্রহ করে। তবে শুক্রাণু, ডিম্বাণু কিংবা আরও সিকোয়েন্সিং টিস্যু থেকে নমুনা সংগ্রহের মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট রুপান্তর পর্যবেক্ষণ সম্ভব। তবে উক্ত গবেষণা ভিত্তিতে অন্তত একথা বলা উচিৎ নয়, যে হুবহু একই দেখতে যমজ (Identical Twin) দের মাঝে ১০০% DNA এর মিল রয়েছে।
অর্থাৎ অভিন্ন যমজ এরা দেখতে হুবহু এক হলেও এরা একে অপরের কার্বন কপি নয়। তবে অভিন্ন যমজ (Monozygotic twin) দের মাঝে এ ধরণের জিনোম পার্থক্য খুবই বিরল এবং রুপান্তরের (Mutation) এর ফলে কোষের কার্যকরী পরিবর্তন ও ফিনোটাইপিক পার্থক্যকরণে উক্ত গবেষণা অনন্য ও প্রশংসনীয় বলে উল্লেখ করেন Ziyue Gao.
তন্ময় ইসলাম তানভীর/ নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্রঃ লাইভ সাইন্স, সাইন্স নিউজ