মেদ বা স্থুলতাআমাদের এই আধুনিক জীবনে অনেক বড় সমস্যা হিসেবে সুপরিচিত। ফাস্টফুড, কায়িক পরিশ্রম কিংবা ব্যায়ামের অভাব, প্রচুর চর্বি জাতীয় খাবার অস্বাভাবিক স্থুলতার জন্য দায়ী। ডায়াবেটিকস, হার্টডিজিজ, উচ্চরক্তচাপ সহ নানা ধরনের রোগ দেখা দেয় স্থুলতার কারনে।
নিঃসন্দেহে বলা যায় এই স্থুলতা শারীরিকভাবে অনেক ক্ষতি করে আমাদের। স্থুলতা কমানোর জন্য নানা ধরনের ডায়েট ও ব্যায়াম করে থাকে সবাই। তবে ডায়েটটা কেমন হতে হবে এবং ডায়েটস্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে কিনা তা জানা আবশ্যক। শরীর আর বয়স অনুযায়ী স্থুলতা কমানোর জন্য ডায়েট এবং ব্যায়াম করতে হয়। তা না হলে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে প্রচুর। আজ আমরা শারীরিক ব্যায়াম আর ডায়েট শরীরের উপর কি প্রভাব ফেলে তা নিয়ে আলোচনা করব।
একটি সাম্প্রতিক পর্যালোচনা দেখায় যে, শারীরিক ব্যায়াম এবং ফিটনেস বাড়ালে স্থুলতার স্বাস্থ্য পরিস্থিতি এবং মৃত্যুর ঝুঁকি হ্রাস হয়। সেটা যদি আপনি ওজন না কমান তাতেও সম্ভব। সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন(সিডিসি) ট্রাস্টেড সোর্স অনুসারে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৪২.৪% প্রাপ্তবয়স্ক মানষের ২০১৭-২০১৮ সালে স্থুলতা ছিল, যা ১৯৯৯-২০০০ সালের ৩০.৫% থেকে উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।
স্থুলতা কমানোর জন্য যেসব নির্দেশিকাগুলি রয়েছে তা হলো ক্যালরি গ্রহণ সীমিত করা এবং শারীরিক ব্যায়ামবাড়ানোর অভ্যাস করা। গত দুই দশক ধরে, কিছু বিজ্ঞানী যুক্তি দিয়েছিলেন যে, স্থুলতা ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ওজন কমানোর উপর মূল ফোকাস করা একটি ভুল পদ্ধতি হতে পারে। এর পরিবর্তে, তারা পরামর্শ দেন যে শারীরিক ক্রিয়াকলাপের মাত্রা বাড়ানো এবং কার্ডিওরেসপিরেটরি ফিটনেসউন্নত করার উপর ভিত্তি করে একটি “Fat but Fit“ পদ্ধতি চালু করেন।
এতে করে যারা শরীরের অতিরিক্ত ওজন কমাতে চায় তাদের জন্য প্রাথমিক ফোকাস হওয়া উচিত এই পদ্ধতি। স্থুলতার চিকিৎসার জন্য “Fat but Fit” পদ্ধতি যুক্তি দেয় যে এটি ফিটনেস উন্নত করার মাধ্যমে এমনকি ওজন খুব একটা না কমিয়েও কার্ডিওভাসকুলার রোগএবং মৃত্যুর ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করতে পারে।
কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে, শারীরিক ব্যায়াম এবং ক্যালারি কম গ্রহন করার মাধ্যমে ওজন হ্রাস মৃত্যুর ঝুঁকি কমাতে পারে কিন্তু অন্যদিকে অনেক গবেষণামতে ওজন হ্রাস এবং মৃত্যুর ঝুঁকির মধ্যে তেমন সম্পর্ক নেই বললেই চলে। সাম্প্রতিক তিনটি বিশ্লেষণ থেকে জানা যায় যে, Weight Cyclingকার্ডিওভাসকুলার রোগ এবং সব কারণের মৃত্যুর ঝুঁকি বৃদ্ধির সাথে যুক্ত।
বিভিন্ন প্রতিবেদন সুপারিশ করে যে, কার্ডিওরেসপিরেটরি ফিটনেস উচ্চ বিএমআই-এর সাথে সম্পর্কিত মৃত্যুর ঝুঁকিকে ব্যাপকভাবে হ্রাস করতে পারে, এমনকি দূর করতে পারে। কিন্তু আমরা কি জানি, নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম কিভাবে আর কত টা উপকার করতে পারে? নিয়মিত শরীরচর্চা রক্তের গ্লকোজ নিয়ন্ত্রণ, রক্তের কোলেস্টেরলের মাত্রা এবং ভাস্কুলার ফাংশনকে উন্নত করে। ব্যায়াম শরীরের যকৃতএবং ভিসারালঅ্যাডিপোজটিস্যুতে সঞ্চিত চর্বির পরিমাণ কমাতেও কার্যকর।
ভিসারাল অ্যাডিপোজ (visceral adipose tissue) টিস্যু হল এমন চর্বি যা অভ্যন্তরীণ অঙ্গকে ঘিরে থাকে, বিশেষ করে পেটে থাকে। লিভারে চর্বি জমা হয় এবং ভিসারাল অ্যাডিপোজ টিস্যু কার্ডিওভাসকুলার রোগ এবং টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকির সাথে যুক্ত। নিয়মিত শরীরচর্চা ইনসুলিনের প্রতি চর্বিযুক্ত টিস্যুর প্রতিক্রিয়াও ভালভাবে উন্নত করতে পারে, পাশাপাশি এটি স্থুলতা এবং টাইপ ২ ডায়াবেটিসে চর্বিযুক্ত টিস্যুর ইনসুলিন সংবেদনশীলতা কমাতে সাহায্য করে।
ওজন কমানোর ক্ষেত্রে কিছু ব্যাপার খেয়াল রাখতে হবে।
এর মধ্যে একটি হচ্ছে ক্র্যাশ-ডায়েটিং এড়িয়ে চলতে হবে। ক্র্যাশ-ডায়েটিংয়ের মাধ্যমে দ্রুত ওজন কমানোর চেষ্টা করা যেসব ঝুঁকি বহন করে তা হলো :
১. নতুন স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিতে পারে।
২. ভিটামিনের ঘাটতি দেখা দিতে পারে।
৩. শরীরের প্রয়োজনীয় উপাদানের অভাব দেখা দেয়।
স্বাস্থ্যকরভাবে ওজন হ্রাস করা কঠিন। কিছু ক্ষেত্রে, একজন ডাক্তার পরামর্শ দিতে পারেন যে গুরুতর স্থুলতাযুক্ত ব্যক্তির খুব কম ক্যালরিযুক্ত তরল খাদ্য অনুসরণ করা উচিত। ডায়েট অনুসরণ করার সময় একজন ব্যক্তি যাতে নিরাপদ থাকে তা নিশ্চিত করার জন্য একজন ডাক্তার কে অবশ্যই এই কৌশলটি পর্যবেক্ষণ করা উচিত। নিয়মিত শরীরচর্চার দিকে মনোযোগ দেয়া সবারই উচিত। যদিও একজন ব্যক্তি কেবল বসে বা ঘুমিয়ে থাকলেও শরীর কিছু ক্যালরি পোড়ায়, তবে যারা যত বেশি শরীর চর্চায় সক্রিয়, তত বেশি তার ক্যালোরি খরচ হবে।
এক পাউন্ড চর্বি হারাতে একজন ব্যক্তির ৩৫০০ ক্যালরি ক্ষয় করতে হয়। তাই অবশ্যই নিজের শারীরিক সক্ষমতা অনুযায়ী শরীর চর্চা করতে হবে। রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রর (সিডিসি) মতে – “অতিরিক্ত ওজন অবশ্যই বেশ কিছু স্বাস্থ্য সমস্যার ঝুঁকি বাড়ায়। ওজন কমানো হতাশাজনক এবং কঠিন হতে পারে, কিন্তু এমনকি মাত্র ৫-১০ শতাংশ ওজন কমানো শরীরের উল্লেখযোগ্য স্বাস্থ্য সুবিধা নিয়ে আসতে পারে।” অল্প অল্প ওজন কমানোও গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। ধীরে ধীরে এবং ক্রমাগত ওজন কমানো অনেক স্বাস্থ্যঝুঁকি কমায়। উদাহরণস্বরূপ, প্রতি সপ্তাহে ১-২ পাউন্ড, অনেক তাড়াতাড়ি ওজন কমানোর চেয়ে অনেক ভালো, কারণ একজন ব্যক্তির লক্ষ্যমাত্রার ওজনে পৌঁছানোর পরে এটি বন্ধ থাকার সম্ভাবনা বেশি।
ব্যায়াম এবং খাদ্যতালিকায় পরিবর্তন ওজন কমানোর জন্য দরকারী টেকনিক। কিন্তু কিছু লোকের জন্য এগুলি কার্যকর নয়। এই ক্ষেত্রে, মেডিসিন বা সার্জারি একটি বিকল্প হতে পারে। কখনও কখনও হরমোনের ভারসাম্যহীনকার্যকলাপের জন্যও অতিরিক্ত ওজন বাড়ে। যেমন – থাইরয়েডএর সমস্যা। এই ক্ষেত্রে, সঠিক মেডিসিন, নিয়মিত ব্যায়াম আর স্বাস্থ্যকর খাবারের মাধ্যমে এই রোগ আয়ত্ত্বে আনা সম্ভব।
পরিশেষে, এটাই বলব ওজন হ্রাসের জন্য ডায়েট করা যতটা স্বাস্থ্যকর উপায়ে করা যায় ততই স্বাস্থ্যঝুঁকি কম থাকে। শুধুমাত্র ডায়েটের মাধ্যেমে স্থুলতা কমানো সম্ভব নয় বরং এটি শারীরিক নানা ক্ষতিও করতে পারে।