চাপ বা স্ট্রেস মানব জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই বাস্তবতা আরও গভীরভাবে উপলব্ধি হয় পরীক্ষার আগের রাতে। সারা বছর ফাঁকিবাজির প্রতিদানস্বরূপ জীবনের সবচেয়ে বেদনাদায়ক ও স্ট্রেসফুল রাতের স্মৃতিতে এসব রাত অন্তর্ভুক্ত হয়। শিক্ষা, দাম্পত্য কিংবা পেশাগত জীবনে একবার না একবার স্ট্রেসফুল মুহূর্ত আসে। অনেকে তো চাপ সইতে না পেরে বলেও দেন, “আমি কি আরএফএল পিভিসি পাইপ নাকি? এত চাপ কীভাবে সহ্য করবো?
কীভাবে সইবো? বিজ্ঞান মানসিক চাপ সওয়ার টোটকা দিতে না পারলেও দীর্ঘদিন চাপে থাকার ফলে সৃষ্ট দৈহিক ক্ষতি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দেয়।
সম্প্রতি, বিজ্ঞানীরা মস্তিষ্ক ও ইমিউন সিস্টেমের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে নতুন কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উন্মোচন করেছেন। এক্ষেত্রে, মানসিক চাপ বা স্ট্রেস কীভাবে ইমিউন সিস্টেমকে প্রভাবিত করতে পারে, সে বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুসন্ধান করা হয়েছে। গবেষণার ফলাফল ইমিউন সিস্টেম ও মস্তিষ্কের মধ্যে জটিল সম্পর্ককে তুলে ধরে, যা ভবিষ্যতে স্ট্রেস-সম্পর্কিত রোগের চিকিৎসায় নতুন পথ দেখাতে পারে।
ইঁদুরের উপর চালানো একটি গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, দীর্ঘমেয়াদি স্ট্রেস মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট অংশে কার্যকলাপ বৃদ্ধি করে, যা ইমিউন সিস্টেমকে প্রতিক্রিয়াশীল করে তোলে। এই প্রক্রিয়াটি মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস-পিটুইটারি-অ্যাড্রিনাল (HPA) অক্ষের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়। HPA অক্ষ স্ট্রেস হরমোনের নিঃসরণকে নিয়ন্ত্রণ করে, যা ইমিউন কোষের কার্যকারিতায় প্রভাব ফেলে। এই প্রক্রিয়ায়, বিশেষ করে অন্ত্রের ইমিউন প্রতিক্রিয়ায় বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়।
গবেষকরা দেখতে পান, স্ট্রেসের প্রভাব মস্তিষ্কের মাধ্যমে অন্ত্রের গ্রন্থিগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। ফলস্বরূপ, “ল্যাক্টোব্যাসিলাস” নামক ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। ল্যাক্টোব্যাসিলাস অন্ত্রের সুস্থতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই ব্যাকটেরিয়ার ঘাটতি অন্ত্রের দেয়ালে ক্ষত তৈরি করতে পারে, যা ইমিউন প্রতিক্রিয়া বৃদ্ধি করে এবং বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
গবেষণার মাধ্যমে দেখা গেছে যে, স্ট্রেসের কারণে মস্তিষ্ক থেকে প্রভাবিত হয়ে ইমিউন সিস্টেম দুর্বল হয়ে পড়ে। এর ফলে বিভিন্ন সংক্রমণ এবং দীর্ঘমেয়াদি প্রদাহজনিত রোগের ঝুঁকি বাড়ে। গবেষকরা মনে করছেন, মানব দেহেও এই প্রক্রিয়া অনুরূপ হতে পারে এবং এটি স্ট্রেস-সম্পর্কিত স্বাস্থ্য সমস্যাগুলোর একটি বড় কারণ হতে পারে।
গবেষণার এই নতুন তথ্যগুলো স্ট্রেস-সম্পর্কিত রোগের চিকিৎসায় নতুন দিকনির্দেশনা দিতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, স্ট্রেস কমানোর মাধ্যমে ইমিউন সিস্টেমের ক্ষমতা বাড়ানো যেতে পারে। একই সঙ্গে, গবেষকরা আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে এই প্রক্রিয়াগুলোর বিস্তারিত বোঝার চেষ্টা করছেন। যদি এটি সম্ভব হয়, তবে স্ট্রেস-সম্পর্কিত রোগের প্রতিরোধ ও চিকিৎসায় বড় ধরনের অগ্রগতি ঘটবে বলে আশা করা যায়।
এই গবেষণা স্ট্রেস ও ইমিউন সিস্টেমের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে নতুন তথ্য প্রদান করেছে। এটি দেখায় যে, মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট কার্যকলাপ কীভাবে ইমিউন সিস্টেমকে দুর্বল করতে পারে এবং এই প্রক্রিয়ায় অন্ত্রের সুস্থতা কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এই ফলাফলগুলো স্ট্রেস-সম্পর্কিত রোগের প্রতিরোধ ও চিকিৎসার জন্য নতুন দিক নির্দেশনা দিতে পারে, যা আমাদের স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে একটি বড় পদক্ষেপ।
কৃষ্ণ দেব নাথ / নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: নেচার.কম