“If I’m going to die, I’d like to actually live first.”
(“এই পুরো সময়টা আমি আমার চিকিৎসা না করে আমার চিকিৎসা হওয়ার জন্য বেঁচে আছি, যাতে আমি বাঁচতে পারি। এবং আমি বাঁচতে চাই।”
“আমি যদি মরেই যাই, তবে আমি প্রথমে বাঁচার মত বাঁচতে চাই।”)
লাইনগুলোর সাথে কি আপনি পরিচিত? লাইনগুলো ‘ফাইভ ফিট অ্যাপার্ট’ (Five Feet Apart) নামক একটি চলচ্চিত্র থেকে নেওয়া।
শ্বাস নিন। গভীর শ্বাস নিন। জীবনের বিভিন্ন সময়ে এমন কথা আমরা অনেকবারই শুনেছি, তাইনা? কিন্তু কখনো কি ভেবেছেন, প্রতিবার শ্বাস নেওয়াও হতে পারে সংগ্রাম? সিস্টিক ফাইব্রোসিস (Cystic Fibrosis- CF) এর মতো ফুসফুসের রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য প্রতিটি শ্বাস একটি সংগ্রাম, একটি বিজয় এবং একটি বেদনাদায়ক রিমাইন্ডার যে, এটিই তার শেষ শ্বাস বা প্রশ্বাস হতে পারে।(Science Bee)
মুভিতে দেখা যায়, সতেরো বছর বয়সী স্টেলা তার বেশিরভাগ সময়ই হাসপাতালে সিস্টিক ফাইব্রোসিসের রোগী হিসাবে চিকিৎসাধীন থাকেন। তাকে একটি কঠোর রুটিন, কিছু সীমানা মেনে চলতে হয়। নিজের উপর রাখতে হয় প্রচন্ড রকমের নিয়ন্ত্রণ। এটি সিস্টিক ফাইব্রোসিসযুক্ত মানুষদের জন্য অস্বাভাবিক নয়।
গল্পের একটি পর্যায়ে আবির্ভাব হয় উইল নিয়ম্যান নামক এক ছেলের। তার বয়সও সতেরো, সেও সিস্টিক ফাইব্রোসিস রোগে আক্রান্ত। উইল স্টেলার মতো নয়, সে তার স্বাস্থ্যের ব্যাপারে অনেক বেপরোয়া ও উদাসীন।
এর পেছনে কারণও রয়েছে। উইল Burkholderia cepacia নামক ব্যাকটেরিয়া দ্বারাও আক্রান্ত। এই ব্যাকটেরিয়াগুলো অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী, যার কারণে এরা চিকিৎসাকে চ্যালেঞ্জিং করে তোলে এবং অনেক সময় কিছু রোগীর ফুসফুসের কার্যক্ষমতা হ্রাসকে ত্বরান্বিত করে। যার কারণে তার চিকিৎসার ফলাফল আশানুরূপ নয়। এমনকি যদি তার ওষুধগুলো কার্যকরও হয়, তবুও ব্যাকটেরিয়াটির সংক্রমণ তাকে ফুসফুস ট্রান্সপ্ল্যান্টের জন্য অক্ষম করে দিয়েছে।
একটা সময় স্টেলা এবং উইলের মধ্যে একে অপরের জন্য অনূভুতির সৃষ্টি হয়।
তাদের রয়েছে অসংখ্য বিধিনিষেধ, তাদের থাকতে হবে নিরাপদ দূরত্বে। কেননা সিস্টিক ফাইব্রোসিসযুক্ত রোগীদের একে অপরের ৬ ফিটের মধ্যে চলে আসা ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে। কিন্তু তাদের সংযোগ যতো তীব্রতর হয়, ততই নিয়মগুলি জানালার বাইরে ফেলে দেওয়ার লোভও তীব্রতর হয়ে উঠতে থাকে।(Science Bee)
তাই সমাধান হিসেবে তারা ৬ ফিট থেকে কমিয়ে দূরত্বটা আনে ৫ ফিট এ, এবং ৫ ফিট লম্বা এক পাইপের এক প্রান্ত একজন, অন্য প্রান্ত আরেকজন ধরে রেখে নিজেদের মধ্যে দূরত্ব বজায় রাখতো। জানেনই তো প্রেমের কোনও সীমানা নেই। কি হবে তাদের ভালবাসার পরিণতি ?
চলচ্চিত্রটি তৈরিতে যুক্ত ছিল ক্লেয়ার্স প্লেস ফাউন্ডেশন (Claire’s Place Foundation)। এটি একটি দাতব্য সংস্থা, যেখানে সিস্টিক ফাইব্রোসিসের সাথে লড়াই করা পরিবারগুলিকে মানসিকভাবে এবং আর্থিকভাবে সহায়তা প্রদান করা হয়।
ফাউন্ডেশনটি ক্লেয়ার ওয়াইনল্যান্ড (Claire Wineland) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি একজন অনুপ্রেরণামূলক বক্তা এবং কর্মী ছিলেন। ওয়াইনল্যান্ড টেক্সাসের অস্টিনে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, জন্ম থেকেই তিনি সিস্টিক ফাইব্রোসিস আক্রান্ত ছিলেন। ফুসফুসের সফল প্রতিস্থাপনের ঠিক পরেই, 2018 সালের সেপ্টেম্বরে স্ট্রোকের কারণে মাত্র ২১ বছর বয়সে ক্লেয়ার মারা যান। তিনি তার ইউটিউব চ্যানেলের মাধ্যমে সিস্টিক ফাইব্রোসিস নিয়ে তার অভিজ্ঞতা শেয়ার করতেন। (Channel link : Claire Wineland)
সিস্টিক ফাইব্রোসিস আসলে কি ?
সিস্টিক ফাইব্রোসিস (সিএফ) একটি জেনেটিক রোগ। সিএফ দ্বারা প্রভাবিত জিন কোষের ভিতরে এবং বাইরে লবণ এবং পানির চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে। সিস্টিক ফাইব্রোসিসযুক্ত মানুষদের ফুসফুস, পাচনতন্ত্র এবং অন্যান্য অঙ্গগুলির মধ্যে ঘন স্টিকি মিউকাস তৈরি হয়, যা পুরো দেহকে প্রভাবিত করে।
সিস্টিক ফাইব্রোসিসের পরিণতি ভয়াবহ, সম্ভাব্য পরিণতি হলো মৃত্যু। সিএফ আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে মৃত্যুর সর্বাধিক কারণ হলো শ্বাস প্রশ্বাসের ব্যর্থতা। সিএফ-র বর্তমানে কোনও প্রতিষেধক নেই।
ষাট বছর আগের পরিস্থিতিতে সিএফ আক্রান্ত অনেক শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বয়সে পৌঁছানোর আগেই মারা যেতো। তবে চিকিৎসার অগ্রগতির কারণে সিএফ আক্রান্ত ব্যক্তিরা বর্তমানে প্রায়শই ৩০-৪০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকতে সক্ষম হন, যদিও কিছু কিছু ক্ষেত্রে এর বেশিও বেঁচে থাকতে দেখা যায়।(Science Bee)
সিস্টিক ফাইব্রোসিস কীভাবে দেহকে প্রভাবিত করে?
সিস্টিক ফাইব্রোসিস শরীরে ঘন মিউকাস বা শ্লেষ্মা তৈরি করে।
সিএফ আক্রান্ত ব্যক্তিদের জিনের রূপান্তরের কারণে Cystic Fibrosis Transmembrane Conductance Regulator প্রোটিন অকার্যকর হয়ে পড়ে। প্রোটিন যখন সঠিকভাবে কাজ করে না, তখন এটি কোষে ক্লোরাইডকে পৌঁছাতে সাহায্য করতে পারে না। ক্লোরাইডের অভাবে কোষ পানিকে আকর্ষণ করতে পারেনা। ফলশ্রুতিতে বিভিন্ন অঙ্গ- তন্ত্রে ঘন এবং আঠালো মিউকাসের সৃষ্টি হয়।
ফুসফুসে থাকা শ্লেষ্মাগুলো জীবাণুগুলোকে আটকে ফেলে এবং এর ফলে শ্বসনতন্ত্রে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়। ফলশ্রুতিতে সংক্রমণ, প্রদাহ, শ্বাস প্রশ্বাসের ব্যর্থতা এবং অন্যান্য জটিলতা দেখা দেয়।
অগ্ন্যাশয়ে তৈরি হওয়া শ্লেষ্মাগুলো খাদ্য হজমকারী এনজাইমগুলির নিঃসরণকে বাধা দেয়। এনজাইমগুলো শরীরকে খাদ্য এবং মূল পুষ্টি শোষণে সহায়তা করে, এরা বাধাগ্রস্ত হওয়ার ফলে শরীরে অপুষ্টি এবং দুর্বলতা বৃদ্ধি করে।(Science Bee)
সিস্টিক ফাইব্রোসিসে আক্রান্ত হওয়ার কারণ কী ?
বাবা-মা উভয়েরই ত্রুটিযুক্ত জিন পেয়ে থাকার কারণে, একজন মানুষ সিএফে আক্তান্ত হতে পারে।
ত্রুটিযুক্ত জিনে এমন একটি প্রোটিন তৈরির কোড রয়েছে যা ফুসফুস এবং অগ্ন্যাশয় সহ অঙ্গসমূহের লবণ এবং পানির প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করে।
সিএফে আক্রান্ত থাকার ফলে দেহে লবণের ভারসাম্য বিঘ্নিত হয়, যার ফলে কোষের বাইরে খুব কম লবণ, পানির সরবরাহ হয়। ফলশ্রুতিতে স্বাভাবিকের চেয়ে ঘন-শ্লেষ্মা তৈরি হয়।(Science Bee)
ত্রুটিযুক্ত জিনের একটি কপি বহনকারীদের ক্যারিয়ার বলা হয়। ক্যারিয়ারদের মধ্যে এর লক্ষণ প্রকাশ পায় না। যখন বাবা-মা উভয়েই ক্যারিয়ার হয়, তখন সন্তানের সিস্টিক ফাইব্রোসিসে আক্রান্তের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়।
যদি ক্যারিয়ার পিতা-মাতার কোনো সন্তান হয়ে থাকে, তবে নিম্নের যেকোনো একটি ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে:
১. ২৫ শতাংশ, বা ৪ এর মধ্যে ১ জন সন্তানের সিএফ থাকবে।
২. ৫০ শতাংশ, বা ২ এর মধ্যে ১ জন সন্তান সম্ভবত সিএফে আক্তান্ত না হলেও বাহক হবে।
৩. ২৫ শতাংশ, বা ৪ এর মধ্যে ১ জন সন্তান বাহক কিংবা আক্রান্ত কোনোটিই হবে না।(Science Bee)
সমীক্ষা অনুসারে, ২৫ জনের মধ্যে ১ জন ত্রুটিযুক্ত জিনটি নিজের অজান্তেই বহন করে থাকে।
লক্ষণগুলো কী কী ?
সিএফের সাধারণ লক্ষণগুলি হলো :
১. নোনতা-স্বাদযুক্ত ত্বক
২. অবিরাম কাশি
৩. নিঃশ্বাসে দুর্বলতা
৪. নিঃশ্বাস নেওয়ার সময় শব্দ হওয়া
৫. অতিরিক্ত ক্ষুধা থাকা সত্ত্বেও ওজন কম
৬. চিটচিটে মল
৭. নাকে পলিপস, বা নাকের মধ্যে ছোট মাংসল বৃদ্ধি
সিস্টিক ফাইব্রোসিসে আক্রান্ত হলে তা ফুসফুসের বিভিন্ন সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ায়। যেমন – ব্রঙ্কাইটিস এবং নিউমোনিয়া।
অগ্ন্যাশয়ে সৃষ্ট সমস্যা অপুষ্টি এবং দুর্বলতা বৃদ্ধির কারণ হতে পারে। এর ফলে ডায়াবেটিস এবং অস্টিওপরোসিসের ঝুঁকিও বৃদ্ধি পায়।
ক্রস ইনফেকশন কী ?
সিএফ আক্রান্ত দু’জন রোগী কখনও একসাথে হতে পারে না। তাদের নূন্যতম ৬ ফিট দূরত্বের মধ্যে থাকতে হয়।
সিস্টিক ফাইব্রোসিসযুক্ত ব্যক্তিদের জন্য ক্রস-ইনফেকশন খুব ক্ষতিকারক হতে পারে এবং এটি একটি বিশেষ হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
আক্রান্ত রোগীরা বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়ার ঝুঁকিতে থাকে যা তাদের ফুসফুসে বৃদ্ধি পেতে থাকে। যদিও এই ব্যাকটেরিয়াগুলো সাধারণত যারা সিস্টিক ফাইব্রোসিসে আক্রান্ত না তাদের জন্য ক্ষতিকারক না, তবে যারা সিএফে আক্রান্ত তাদের ফুসফুসে ব্যাকটেরিয়াগুলো ক্ষতিকারক হতে পারে অর্থাৎ তাদের জন্য ব্যাকটেরিয়া গুলো অত্যন্ত সংক্রামক।(Science Bee)
বাইরের পরিবেশে ব্যাকটেরিয়াগুলো দ্বারা সংক্রমণ হওয়ার ঝুঁকি কম থাকে, তবে বাড়ির অভ্যন্তরে সিস্টিক ফাইব্রোসিসযুক্ত অন্যান্য রোগীর সাথে ভ্রমণ করা বা তাদের সাথে সামাজিকভাবে সময় কাটালে আক্রান্তের সর্বোচ্চ ঝুঁকি রয়েছে। সিস্টিক ফাইব্রোসিসযুক্ত রোগীরা যতই একে অপরের নিকটবর্তী হয়, ততই সংক্রমণের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।
কী চিকিৎসা রয়েছে ?
বর্তমানে সিএফ-র নিরাময়যোগ্য সমাধান নেই। তবে বর্তমান চিকিৎসা ব্যবস্থা রোগটির লক্ষণগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চেষ্টা করে। পৃথক পৃথক মানুষদের মধ্যে পৃথক লক্ষণ দেখা যেতে পারে এবং এর কারণে চিকিৎসা পদ্ধতির মধ্যেও পার্থক্য থাকে।
সাধারণত বর্তমানে আক্রান্ত রোগীদের গড় আয়ু চল্লিশের আশেপাশে হয়। রোগের তীব্রতা, রোগ নির্ণয়ের সময় এবং সিএফ জিনের পরিবর্তন আয়ু হ্রাস-বৃদ্ধিকে প্রভাবিত করে।
রুটিন থেরাপি এবং স্বাস্থ্যকর জীবনধারা মেনে চলার মাধ্যমে অনেক সিএফ আক্রান্ত মানুষ সক্রিয় জীবনযাপন করতে পারেন।(Science Bee)
১৯৫৫ সালে সিস্টিক ফাইব্রোসিসে আক্রান্ত সন্তানদের পিতামাতার একটি দল যখন ‘সিস্টিক ফাইব্রোসিস ফাউন্ডেশন’ শুরু করেছিলেন তখন এই রোগের কোনও চিকিৎসা ছিল না। কিন্তু, পিতামাতারা আশা ছাড়েন নি। এই অল্প পরিচিত রোগ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য, তাদের সন্তানদের জন্য নতুন চিকিৎসা, বিশেষ যত্ন এবং নিরাময়ের জন্য তারা চেষ্টা করতে থাকেন।
পরবর্তী বছরগুলোতে, সিএফ ফাউন্ডেশনের দৃঢ়তা এবং তহবিল সংগ্রহ সিএফ নিয়ে মৌলিক গবেষণা করতে সাহায্য করেছে। যার ফলে সিস্টিক ফাইব্রোসিসের জন্য দায়ী জিন এবং প্রোটিনের সনাক্তকরণ সহ গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারগুলির সম্ভব হয়েছে। শরীরের উপর রোগটির প্রভাব সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানকে প্রসারিত করে গবেষকরা নতুন চিকিৎসা তৈরির পথ প্রশস্ত করেছেন।
সত্য কথা হচ্ছে, সুস্থ মানুষেরাও যে কোনো সময় মারা যেতে পারে। পরিবারের সদস্যের অসুস্থতা কোনো পরিবারকে মানসিকভাবে এবং আর্থিকভাবে ধ্বংস করে দিতে পারে। যখন আপনি নিজের বাস্তবতা গুলোর সম্মুখীন হন, তখন কোনো মানুষকে ভালবাসা রীতিমতো ভীতিকর হতে পারে এবং তার থেকেও বেশি ভয়ংকর হতে পারে অন্যের ভালবাসার কেউ হওয়া।(Science Bee)
আমরা সকলেই কোনও ভাবে নিজের বাস্তবতাকে নিয়ন্ত্রণ করার উপায় খুঁজে বের করার চেষ্টা করি। হতে পারে নিয়মিত একগাদা ঔষধ খেয়ে অথবা, আমাদের যা বলা হয় তা মেনে চলে। কখনো বা হাসপাতালের দরজায় “সমস্ত প্রত্যাশা ত্যাগ করুন” সাইন রেখে আমরা বাস্তবতাকে মেনে নিতে চেষ্টা করি। এই জাতীয় চলচ্চিত্রগুলি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, আমরা যতদিনই বাঁচি, ততদিন যেন বাঁচার মত বাঁচতে চেষ্টা করি।
কায়েস মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ/ নিজস্ব প্রতিবেদক