উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরে ফারো দ্বীপপুঞ্জের কাছাকাছি একটি অঞ্চলে কিছু মোটরচালিত নৌকা ঘুরাঘুরি করছে। চারপাশে বেশ বড় জায়গাজুড়ে সমুদ্রের উপর জালের মত ভাসমান বস্তুগুলোর দিকে এগিয়ে যেতে যেতে ওলাভার গ্রেগারসেন বললেন, “এখানে কিছুটা বাতাস বইছে, আমরা দেখব আমরা ফসল কাটার নৌকার দিকে কতদূর যেতে পারি।”
মিঃ গ্রেগারসেন সামুদ্রিক শৈবাল উৎপাদক প্রতিষ্ঠান ‘ওশান রেইনফরেস্ট’ এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক। বিভিন্ন খাদ্য উৎপাদনকারী সংস্থা এবং অন্যান্য বেশ কিছু ইন্ডাস্ট্রির ক্রমবর্ধমান চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে এশিয়া, ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকাতে বেড়ে ওঠা সামুদ্রিক শৈবাল উৎপাদনকারী ফার্মের মধ্যে একটি তাঁর ফার্ম।
সমুদ্রের তলদেশে নোঙ্গর করা চাষের ছড়াটি ৫০,০০০ মিটার (১৬৪,০০০ ফুট) জাল জাতীয় দড়ি নিয়ে গঠিত, যা সমুদ্রের রুক্ষ পরিস্থিতি সহ্য করতে পারে। মূল কাঠামোটি সমুদ্রপৃষ্ঠের ১০ মিটার নিচে অবস্থিত, যাতে করে উপরিভাগের বড় বড় ঢেউগুলো এড়ানো সম্ভব হয়। উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরে অবস্থান হওয়া সত্ত্বেও মিঃ গ্রেগারসান বলেছেন, “গভীর এবং পুষ্টি সমৃদ্ধ জলরাশি সামুদ্রিক শৈবাল বৃদ্ধির জন্য বেশ উপযোগী, এর তাপমাত্রাও ৬ থেকে ১১ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের মধ্যে স্থির থাকে।”
যান্ত্রিকীকরণ
সামুদ্রিক শৈবাল দ্রুত বর্ধনশীল। তারা সূর্যের আলো থেকে শক্তি ব্যবহার করে এবং সমুদ্রের জল থেকে পুষ্টি এবং কার্বন ডাই অক্সাইড গ্রহণ করে। বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন যে, সামুদ্রিক শৈবাল জলবায়ু পরিবর্তন এবং কার্বন নিঃসরণের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সহায়তা করতে পারে।
ওশান রেইনফরেস্ট সম্প্রতি ক্যালিফোর্নিয়ায় একই জাতীয় ব্যবস্থা তৈরির জন্য মার্কিন জ্বালানি বিভাগ হতে অর্থায়ন লাভ করেছে, যেখানে তারা ভবিষ্যতে জ্বালানীর চাহিদা মিটানোর জন্য সামুদ্রিক শৈবাল উৎপাদন শিল্প বিকাশের আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
সংগ্রহকারী নৌকাটিতে ক্যাপ্টেন একটি যন্ত্রের মাধ্যমে পানি থেকে জালগুলো তুলে নেয়। এরপর শৈবাল জাল থেকে আলাদা করা হয় এবং পাত্রে রাখা হয়। শেষে জালগুলি পুনরায় সমুদ্রে ছড়িয়ে দেওয়া হয়।
এ বছর ওশান রেইনফরেস্টের প্রায় ২০০ টন ফলন হবে। তবে সংস্থাটি পরের বছর তার ক্ষমতা দ্বিগুণ করার পরিকল্পনা করছে। মিঃ গ্রেগারসান বলেছেন “এখনও আমরা লাভ করছি না, তবে খুব শীঘ্রই লাভের মুখ দেখবো।”
ব্যবহার
বেশিরভাগ সামুদ্রিক শৈবাল খাদ্য হিসেবে ব্যবহার হয়, তবে কিছু পরিমান শৈবাল বিভিন্ন পণ্যে ব্যবহার করা হয়। এটি টুথপেষ্ট, প্রসাধনী, ওষুধ এবং পোষ্য প্রাণীর খাবার উৎপাদনে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এছাড়াও প্লাস্টিকের বিকল্প হিসেবে পচনশীল প্যাকেজিং পণ্য, পানির বোতল এবং পানীয়ের স্ট্র সহ অন্যান্য অনেক পণ্য উৎপাদনে এটির ব্যবহার বাড়ছে।
সম্প্রতি সামুদ্রিক শৈবাল উৎপাদন অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO) জানিয়েছে, ২০০৫ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে এর উৎপাদন দ্বিগুণ হয়েছে, যা বার্ষিক ৩০ মিলিয়ন টন ছাড়িয়েছে। এটি এখন বিশ্বব্যাপী ৬ বিলিয়ন ইউএস ডলারের বেশি মুল্যের একটি ব্যবসা।
উদ্ভাবকরা সামুদ্রিক শৈবালের উৎপাদন বাড়াতে এবং খরচ কমাতে চেষ্টা করছেন। নরওয়েজিয়ান বৈজ্ঞানিক গবেষণা দল ‘সিন্টেফ’ এই কৃষিকে নতুন করে গড়ে তোলার জন্য নতুন প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে। গবেষণা বিজ্ঞানী সিলজে ফোরবোর্ড বলেছেন “এখন বেশিরভাগ সামুদ্রিক শৈবাল খাবারের জন্য ব্যবহৃত হয়, তবে ভবিষ্যতে আমরা এটি মাছের খাদ্য, সার, বায়োগ্যাসের জন্য ব্যবহার করতে চাই। তাই এটি পরিমাণে বেশি প্রয়োজন এবং আমাদের আরও দ্রুত উৎপাদন করতে হবে।”
নতুন উদ্ভাবন
সামুদ্রিক শৈবাল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ‘আলগাপ্লাস’ উত্তর পর্তুগালে অনেক পুকুর এবং ট্যাঙ্ক এর মধ্যে সামুদ্রিক শৈবাল চাষ করছে। আলগাপ্লাস এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হেলেনা অ্যাব্রেউ বলেন, “এটি অনেক বেশি নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ, সমুদ্রের তুলনায় এখানে অনেক বেশি সুবিধা রয়েছে। আমরা ট্যাঙ্কগুলির অভ্যন্তরে তাপমাত্রা এবং সমস্ত কিছু নিয়ন্ত্রণে রাখি এবং সারা বছরই উৎপাদন করতে পারি।”
এর জন্য প্রথমে উপকূলীয় জলাশয় (লেগুন) থেকে সমুদ্রের জল মাছের পুকুরে প্রবাহিত করতে হয়। এরপরে এটি পরিস্রাবণ ব্যবস্থার মাধ্যমে সামুদ্রিক শৈবাল সমৃদ্ধ ট্যাঙ্কগুলিতে পাম্প করা হয়। মাছের পুকুর থেকে আসা এই জলগুলি নাইট্রোজেন সমৃদ্ধ। হেলেনা অ্যাব্রেউ বলেন, “আমাদের অতিরিক্ত কোনও সার ব্যবহারের দরকার নেই। আমরা আমাদের সামুদ্রিক শৈবালের বৃদ্ধির জন্য মাছের জল ব্যবহার করি।”
মিসেস অ্যাব্রেউ মনে করেন না যে জমির প্রাপ্যতা একটি সীমাবদ্ধতা। তিনি বলেন, “পর্তুগাল, ফ্রান্স, ইতালি, গ্রীস এবং তুরস্কে সামুদ্রিক শৈবাল চাষের জন্য পর্যাপ্ত জমি রয়েছে।” কানাডা এবং দক্ষিণ আফ্রিকাতেও সামুদ্রিক শৈবালের চাষ হয়। তবে এতে অনেক চ্যালেঞ্জও রয়েছে। প্রধান বাঁধা হলো শক্তি ব্যয়। তবে এটি নিশ্চিত যে সামুদ্রিক শৈবালের বাজার আরও বাড়তে থাকবে এবং আরও অনেক নতুন কোম্পানি এতে যুক্ত হবে।
সোহানুর রহমান/ নিজস্ব প্রতিবেদক