আচ্ছা মানুষ কি কখনো এমন জিনিস তৈরি করতে পারে যার নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে তারা খেই হারিয়ে ফেলবে? বর্তমান পৃথিবীর বহুল ব্যবহৃত শব্দ রোবট কি এমন বুদ্দ্বিমত্তার অধিকারী হবে যে তারা পৃথিবী নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে?
আদৌ কি এসব সম্ভব?!
বিজ্ঞানের সুদূরপ্রসারী চিন্তা পৃথিবী কে এমন উচ্চতায় দাঁড় করিয়েছে যা পূর্বে হয়তো মানুষের কাছে ছিল কল্পনাতীত। রোবট বা যন্ত্রমানব তারই একটি অংশ। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সবখানেই শিক্ষার্থীরা দলে দলে রোবট বানানোর প্রতিযোগীতায় অংশ নিচ্ছে। আমরা সবাই ই এখন যেকোনো কাজের জন্য রোবট এর সহায়তা চিন্তা করি।
স্বভাবতই আমরা ভেবে থাকি,”ইশশশ! যদি এমন কোনো টেকনোলজি থাকতো যে মানুষের মতোই কথা বলবে, যেকোনো কথার যৌক্তিক প্রতিউত্তর প্রদান করবে ঠিক মানুষের মতোই। তার সাথে কমান্ড মেইনটেনেন্স এ ও বেশ দক্ষ হবে।”
এ ধরণের টেকনোলোজি কে রোবটিক্স সেক্টরের সর্বোচ্চ আবিষ্কার হিসেবে গণ্য করা হয় বর্তমানে। রোবটিক্স সেক্টরে এ বহুল আলোচিত সেক্টর হলো এআই(AI) বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স যার অর্থ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা।
মানুষের বুদ্ধিমত্তা ও চিন্তা শক্তিকে কৃত্রিম উপায়ে প্রযুক্তি নির্ভর করে যন্ত্রের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করাকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বলে। এতে করে কম্পিউটার মানুষের মত ভাবতে পারে, শিক্ষা গ্রহণ এবং সমস্যার সমাধান করতে পারে।
বিগত কিছু বছর ধরে বৃহৎ পরিসরে এআই নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে বিশ্বজুড়ে। তাই মোটামুটি সবাই ই এ সম্পর্কে কমবেশি জানি। এটা সত্য যে এআই অন্যরকম উত্তেজনা আর রমরমা পরিবেশ তৈরি করে এবং এ প্রযুক্তি সবার আকর্ষণ এর কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে। মূলত এটি ট্রান্সফরমেটিভ টেকনোলজি, তাই এটি আমাদের জীবন কে পুরোপুরি পাল্টে দিতে প্রস্তুত।
চলুন জেনে নিই কিভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আমাদের ভবিষ্যৎকে পালটে দিতে পারে:
১. এআই এর বিচরণ –
আচ্ছা কখনো কি অ্যামাজন এর ব্যাপক সাড়া ফেলা প্রোডাক্ট “এলেক্সা” এর নাম শুনেছেন? দেখে থাকলে বা ব্যবহার করে থাকলে নিশ্চয় ওয়েদার আপডেট জিজ্ঞেস করা অথবা কোনো বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছে নিশ্চয়ই। অথবা এমন কোনো স্থান দিয়ে চলাফেরা করা হয়েছে যেখানে “ফেইস রিকগনিশন” এর প্রয়োজন হয়? কিংবা মাস্টার কার্ড বা ভিসা কার্ড এর ব্যবহার তো অবশ্যই দেখা হয়েছে।
আজকালকার বেশ প্রচলিত ডেটিং অ্যাপ টিন্ডার এর নাম তো শোনা হয়েছে নিশ্চয়ই। বলা চলে গত ২৪ ঘন্টায় বেশ কয়েকটি এআই এর ব্যবহার দিব্যি আমাদের হয়ে গেছে অথচ এরা আমাদের জীবনের সাথে এতটাই গভীরভাবে মিশে গেছে যে আমরা টেরও পাইনা।
এটাই বাস্তব প্রমাণ, এআই আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে যাচ্ছে দিন কে দিন। সবকিছুকে একপাশে রেখে আপনার ক্রেডিট কার্ড এর লেনদেনের কথাই ভেবে দেখুন; চোখের পলকেই লেনদেন সম্পন্ন হয় এবং এর মধ্যে থাকা এলগরিদম কিন্তু এআই এলগরিদম।
২. এআই এর অনুপ্রবেশে জীবনব্যবস্থার পরিবর্তন ও প্রভাব –
আগে আমরা কারো ঘরে কম্পিউটার বা টেলিভিশন দেখলেও বেশ অবাক চোখে তাকিয়ে থাকতাম। তবে এখন তা বেশ স্বাভাবিক হয়ে বসেছে। এআই এখন তেমনি একটু অস্বাভাবিক মনে হলেও এর ব্যাপক প্রসার আস্তে আস্তে স্বাভাবিক করে তুলছে দৈনন্দিন জীবনে।মোটামুটি সকল ধরণের শিল্পে এআই এর প্রভাব দেখা যাচ্ছে।
ব্যাংকিং খাতে কিংবা ম্যানুফেকচারিং খাতে সবখানেই এর ব্যাপক বিচরণ দেখা যাচ্ছে। তবে চিকিৎসা খাতে এর বেশ যুগান্তকারী প্রভাব দেখা যাচ্ছে। মূলত বিভিন্ন রোগ নির্ণয় এবং এর মাধ্যমে রোগী এবং চিকিৎসা প্রদানকারী প্রত্যেককেই সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে এবং সঠিক চিকিৎসা প্রদান করতে সহায়তা করছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, যা আগে অতোটা সম্ভব ছিলনা।
৩. এআই এর প্রভাবে মানুষের যান্ত্রিকতা থেকে রেহাই –
আমাদের সবারই এক ভ্রান্ত ধারণা থাকে যে টেকনোলজির প্রভাবেই মানুষ প্রতিনিয়ত যান্ত্রিক হয়ে পড়ছে। কথা গুলো আংশিক সত্য। তবে এটাও সত্য যে কাজের বেশ চাপে পড়েই মানুষ যান্ত্রিকতার দিকে ধাবিত হচ্ছে। আর দৈনন্দিন জীবনে এর ব্যবহার অনেক গুলো ক্ষেত্রে মানুষের উপর থেকে কাজের অতিরিক্ত চাপ সরিয়ে সেই কাজ গুলোকে অটোমেশন প্রক্রিয়ায় এনে বেশ সহজতর করে দিচ্ছে।
কিন্তু এই রেভুলউশন এর একটা চিন্তার বিষয় হিসেবে দাঁড়িয়ে যায় অটোমেশন প্রক্রিয়ার জন্য মানুষের বেকারত্ব বৃদ্ধি। কিন্তু এটাও সত্য, এক খাতের চাকরি হারাবে তো অন্য খাতের চাকরির জন্ম হবে কারণ যতোই টেকনোলোজি তার রেভুলউশন দেখাক না কেন, তার প্রত্যেককে কন্ট্রোলের হাত মানুষেরই। যার কারণে মানুষের সৃজনশীলতার উপরে পৃথিবীর কিছু নেই।
এআই এর প্রভাব আমাদের কর্মজীবনে বেশ ভালোভাবেই আছে। জার্নালিজম বা সাংবাদিকতা তার বেশ বড় একটি উদাহরণ। বেশকিছু অসাধারণ এআই টুলস আছে যা সংবাদ যাচাই বাছাই এবং তা লিখতে সহায়তা করে।
বিখ্যাত ফোর্বস ম্যাগাজিন এর খবরগুলো তৈরিতে “বার্টই” নামক এক এআই এর সাহায্য নেওয়া হয় যা ট্রেন্ডিং বা চলমান টপিক, সঠিক খবর, সঠিক আলোকচিত্র, হেডলাইন ইত্যাদির জন্য প্রয়োজনীয় সাজেশন প্রদান করে। এর ফলে মানুষের উপর থেকে বেশ বোঝা কমে আসে ও সাংবাদিকরা তাদের লেখার দিকে ঠিকমতো সময় দিতে পারে।
৪. জনসাধারণের জন্য প্রতিনিয়ত সহজলভ্য হওয়া –
স্বাভাবিকভাবেই আমরা ভাবি যেকোনো অসাধারন টেকনোলজি এর দাম হবে আকাশচুম্বি। এমনটা ভাবা খুবই স্বাভাবিক। তবে আপনি চমকে যাবেন যখন “এলেক্সা” এর মতো টেকনোলজি গুলোর দাম দেখবেন। বেশ সাশ্রয়ী মূল্যে এগুলো পাওয়া যাচ্ছে এবং বিপুল সংখ্যক মানুষ এটি ক্রয় করছে।
সব স্তরের কাজে মানুষজন যেকোন ধরণের এআই টেকনোলজি ক্রয় ও ব্যবহার করে যাচ্ছে।
২০১৯ সালে অ্যামাজন “পার্সোনালাইজ” নামক এক এআই টেকনোলজি চালু করে যা বিভিন্ন ব্যবসা তে তাদের উপযোগী ক্রেতাদের সহজেই চিহ্নিত করে রেকমেন্ড করতে পারে। এই টেকনোলজি ব্যবহারের জন্য ব্যবহারকারীর কোনো প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয়না।
৫. অন্যান্য প্রযুক্তির জন্য জ্বালানী স্বরূপ কাজ করা এআই –
সর্বশেষ একটি যুক্তি দাঁড় করাতে চাই এআই এর পৃথিবী পরিবর্তনে অবদানের উপর। আজকের পৃথিবী এমনসব প্রযুক্তি ও আবিষ্কার দেখতে পাচ্ছে যা এক সময় আমাদের কল্পনার দূরদূরান্তেও ছিল না।আর কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা হলো সেই ভিত্তি যার উপর ভর করেই দাঁড় করানো হচ্ছে বহু নতুন প্রযুক্তি। একটি বাড়ি দাঁড়াবার জন্য যেমন পিলার এর প্রয়োজন হয় তেমনি আধুনিক বিজ্ঞানের প্রযুক্তি গুলোর ভিত্তিই হলো এআই।
কিংবা আপনার আঙ্গুলের ছাপ ব্যবহার না করে শুধু আপনার চেহারাকে ই পাসওয়ার্ড হিসেবে কি সেট করতে পারতেন? কিংবা আপনার সাথে চ্যাট করবে, নিজ থেকে রিপ্লাই দিবে, কথা বলবে, যৌক্তিক সমাধান প্রদান করবে এমন রোবট এর কথা ভাবতে পারতেন কি কখনো? এগুলো স্বল্প আঙ্গিকে আলোচনা করা কিছু আবিষ্কার কেবল। এদের ব্যবহার প্রতিনিয়ত এমন ভাবে করছি, এদের অস্তিত্ব আমাদের জন্য বেশ স্বাভাবিক এখন। বৈজ্ঞানিক যেকোনো বিপ্লব কিংবা বিরাট সাফল্যের পেছনে যুগান্তকারী অবদান ছিল এই এআই এর।
কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা আমাদের তৈরি নিজেদের জন্য আশীর্বাদ। উপযুক্ত ও পরিমিত ব্যবহারেই এর প্রকৃত ফলাফল নিহিত।
ফাহাদ বিন এনাম/ নিজস্ব প্রতিবেদক