করোলিনস্কা ইনস্টিটিউটের নোবেল অ্যাসেম্বলিতে ২০২৩ সালের ফিজিয়োলজি বা মেডিসিনে নোবেল জিতলেন ক্যাটালিন কারিকো এবং ড্রু ওয়েইসম্যান। কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে কার্যকর নিউক্লিওসাইড বেস পরিবর্তন করে mRNA ভ্যাকসিন আবিষ্কারের জন্য তাঁরা এই পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
২০২০ সালের শুরুর দিকে কোভিড-১৯ মহামারি চলাকালীন মারণ ভাইরাসটির বিরুদ্ধে কার্যকর mRNA ভ্যাকসিন তৈরির জন্য দুই মেডিসিনে নোবেল পুরস্কার বিজয়ীর আবিষ্কারগুলো গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তাঁদের এই যুগান্তকারী অনুসন্ধানের মাধ্যমে mRNA কীভাবে আমাদের ইমিউন সিস্টেমের সাথে মিথস্ক্রিয়া করে সে সম্পর্কে আমরা জানতে পেরেছি।
করোনা মহামারির আগে ভ্যাকসিন প্রয়োগ পদ্ধতি:
অনেক আগে থেকেই আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধের জন্য টিকা ব্যবহৃত হচ্ছে। টিকার মাধ্যমে কোনো একটি নির্দিষ্ট ইমিউনকে ধ্বংস করা হয়। পোলিয়ো, হাম, এবং হলুদ জ্বরের মৃত বা দুর্বল ভাইরাস পর্যবেক্ষণ করে সেগুলোর বিরুদ্ধে কার্যকর টিকা আবিষ্কার করা হয়েছিল। তবে অনুন্নত প্রযুক্তির কারণে তখন এই সকল আবিষ্কারগুলো ছিল অনেক সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।
সাম্প্রতিক সময়ে আণবিক জীববিজ্ঞানের অগ্রগতির জন্য পুরো ভাইরাস পর্যবেক্ষণ না করে কেবল নির্দিষ্ট কোনো ভাইরাল উপাদান গবেষণা করেই ভ্যাকসিন বা টিকা তৈরি সম্ভব হয়েছে। ভাইরাসের প্রোটিন বা অন্যান্য ভাইরাল অংশ গবেষণা করে ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর অ্যান্টিবডি তৈরি করা হচ্ছে। ভাইরাল জেনেটিক কোডের অংশগুলো কেটে বা সংগ্রহ করে একটি বাহক বা ভেক্টর ভাইরাসে স্থানান্তরিত করে মূলত ভ্যাকসিনগুলো প্রস্তুত করা হয়। এই পদ্ধতিটি ইবোলা ভাইরাসের ভ্যাকসিন বানাতে ব্যবহৃত হয়েছিল। যখন ভেক্টর ভ্যাকসিনগুলো ইনজেকশন দেওয়া হয়, তখন নির্বাচিত ভাইরাল প্রোটিন আমাদের কোষগুলোতে উৎপাদিত হয়, যা নির্দিষ্ট ভাইরাসের বিরুদ্ধে একটি ইমিউন প্রতিক্রিয়াকে কার্যকর করে তুলে। কিন্তু সম্পূর্ণ ভাইরাস-প্রোটিন এবং ভেক্টর-ভিত্তিক ভ্যাকসিন তৈরির জন্য বড় আকারের কোষ সংস্কৃতি বা ‘Cell Culture‘ প্রয়োজন, যা দ্রুত ভ্যাকসিন তৈরির জন্য একটি বাধা স্বরূপ। এই কারণেই এই পদ্ধতি থেকে দ্রুত ফলাফলের আশা থেকে দূরে সরে যেতে হয় বিজ্ঞানীদের।
mRNA ভ্যাকসিন; সম্ভাবনার নতুন নাম:
আমাদের শরীরে ট্রান্সক্রিপশন পদ্ধতিতে DNA থেকে mRNA তৈরি হয়ে থাকে। একে আমরা ইন ভিট্রো ট্রান্সক্রিপশনও বলে থাকি। কৃত্তিম উপায়ে এই ট্রান্সক্রিপশন করার পদ্ধতি বিজ্ঞানীরা পেয়েছিলেন, তবে তার জন্য অত্যাধুনিক ক্যারিয়ার লিপিড সিস্টেমের প্রয়োজন, যা ছিল অত্যন্ত জটিল। জটিল প্রক্রিয়াটি সম্পাদনা করার পর যে mRNA তৈরি হয়েছিল, সেটি আমাদের কোষে ব্যবহারে অনুপযোগী বলে প্রমাণিত হয়। তাই এই পদ্ধতির বিকাশকেও একটা সময় নিরুৎসাহিত করা হয়।
তবে এই বাধাগুলো হাঙ্গেরিয়ান জৈব রসায়নবিদ ক্যাটালিন কারিকো কে নিরুৎসাহিত করেনি। তিনি তাঁর গবেষণা চালাতে থাকেন এবং তাঁর সাথে সাক্ষাৎ হয় ইমিউনোলজিস্ট ড্রু ওয়েইসম্যান যিনি ডেনড্রাইটিক কোষগুলোর প্রতি আগ্রহী ছিলেন। তাঁরা একত্রে বিভিন্ন প্রকার RNA কীভাবে ইমিউন সিস্টেমের সাথে যোগাযোগ করে তার উপর বিস্তর গবেষণা শুরু করেন।
mRNA ভ্যাকসিনের সফলতা:
কারিকো ও ওয়েইসম্যান জানতে পারেন ইন ভিট্রো ট্রান্সক্রিপশন পদ্ধতিতে প্রাপ্ত mRNA আমাদের দেহ থেকে সরাসরি তৈরি হচ্ছে না। বরং সেটি ‘Foreign Substance’ বা পরদেশি পদার্থ হিসেবে শরীরে অবস্থান করছে। তাঁরা বিস্মিত হয়েছিলেন যে কেন ইন ভিট্রো ট্রান্সক্রাইবড mRNA বিদেশি হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে। কেনো স্তন্যপায়ী কোষ থেকে mRNA একই প্রতিক্রিয়ার জন্ম নেয়নি। এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য তাঁদের ভিন্নধর্মী ও ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের অনেকগুলো mRNA তৈরি করতে হতো।
RNA-তে চারটি বেস রয়েছে, সংক্ষেপে A, U, G, এবং C।
কারিকো এবং ওয়েইসম্যান জানতেন যে স্তন্যপায়ী কোষ থেকে RNA-তে বেসগুলো রাসায়নিকভাবে নিয়মিত পরিবর্তিত হয়, যা ভিট্রো ট্রান্সক্রিপ্ট এ তৈরি mRNA এর ক্ষেত্রে হয় না। এর কারণ হিসেবে তাঁরা ধারণা করেছিলেন হয়তো কোনো রাসায়নিক বেসের অনুপস্থিতির কারণে এমনটা হচ্ছে। এটি তদন্ত করার জন্য তারা mRNA এর বিভিন্ন রূপ তৈরি করেছিলেন, যার প্রতিটির বেসে অনন্য রাসায়নিক পরিবর্তন ছিল, যা তারা পরে স্তন্যপায়ীর কোষগুলোতে সরবরাহ করেছিলেন। এইবার তাঁরা দেখতে পান mRNA গুলো কাজ করছে। সেগুলো ভিন্নধর্মী প্রোটিন বা ভাইরাসের বিরুদ্ধে কাজ করতে সক্ষম হচ্ছে। অবশেষে তাঁরা সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, থেরাপি হিসেবে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে। এই প্রাথমিক ফলাফলগুলো ২০০৫ সালে প্রকাশিত হয়েছিল, কোভিড-১৯ মহামারীর ১৫ বছর আগে।
২০০৮ ও ২০১০ সালে আরো কিছু গবেষণা করার পর জানা যায় যে বেস পরিবর্তন করার পাশাপাশি জীবাণু দমনকারী প্রোটিন উৎপন্ন হচ্ছে mRNA এর সাহায্যে। পাশাপাশি প্রোটিন উৎপাদনকে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করেছে।
mRNA ভ্যাকসিনের চূড়ান্ত ব্যবহার:
mRNA প্রযুক্তির প্রতি আগ্রহ বাড়তে শুরু করে এবং ২০১০ সালে বেশ কয়েকটি কোম্পানি পদ্ধতিটির বিকাশের জন্য কাজ করেছিল। জিকা ভাইরাস এবং MERS-CoV এর বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন তৈরিতে পদ্ধতিটি অনুসরণ করা হয়েছিল। কোভিড-১৯ মহামারী প্রাদুর্ভাবের পরে SARS-CoV-2 ভ্যাকসিনের প্রোটিন এনকোডিং-এ দুটি বেস পরিবর্তন বা সংশোধিত করে কোভিড প্রতিরোধী mRNA ভ্যাকসিন রেকর্ড গতিতে তৈরি করা হয়েছিল। এই ভ্যাকসিন প্রায় ৯৫% সফল হয়েছিল কোভিড দমনে। কোভিড ভ্যাকসিন ও SARS-CoV-2 ভ্যাকসিন, উভয় টিকাই ২০২০ এর ডিসেম্বরে অনুমোদিত হয়েছিল।
ক্যাটালিন কারিকো এবং ড্রু ওয়েইসম্যান এর এই যুগান্তকারী আবিষ্কার প্রমাণ করেছে যে, তুলনামূলক অনেক কম সময়ে ভ্যাকসিন বা টিকা তৈরি সম্ভব। ভবিষ্যতে নতুন কোনো ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলা এই পদ্ধতিটিই মানবজাতিকে রক্ষা করতে পারে। ক্যান্সার চিকিৎসাতেও এই পদ্ধতিটি কাজে লাগানো যেতে পারে বলে বিজ্ঞানীরা আশা রাখছেন। ধন্যবাদ কারিকো এবং ওয়েইসম্যান কে মানবজাতির জন্য এত শক্তিশালী এক ঢাল নির্মাণের জন্য।
তানভীর আহমেদ/নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: The Nobel Prize, Scientific American