একজন ব্যক্তি কিছুক্ষণ হাসিখুশি থাকছে তো আবার কিছুক্ষণ পর রেগে যাচ্ছে। এটাকে একজন মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি হিসেবে ধরে নিলেও এখানে রয়েছে হরমোনের প্রভাব। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, হরমোনের সাথে মেজাজ এর কী সম্পর্ক? চলুন জেনে নেওয়া যাক।
হরমোন মানব মস্তিষ্কের বিভিন্ন অঞ্চলের দেওয়া নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করে এবং নিউরোট্রান্সমিটার বা স্নায়ু সংকেত পরিবাহকগুলো দ্বারা পরিচালিত কাজগুলোকে প্রভাবিত করে মানুষের মেজাজকে পরিবর্তন করে। এই রাসায়নিক সংকেত বা হরমোনসমূহ মানবদেহের এন্ডোক্রাইন (হরমোন নিয়ন্ত্রক) সিস্টেম দ্বারা উৎপাদিত হয়ে আবেগ ও মেজাজসহ বিভিন্ন শারীরিক ক্রিয়াকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে এবং হরমোন রক্ত প্রবাহের মাধ্যমে পুরো শরীরে প্রবাহিত হয়। তবে হরমোন তো অনেক রয়েছে, কিন্তু মানুষের মেজাজ এবং আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য চারটি হরমোন কাজ করে। এগুলো হলো, সেরোটোনিন, ডোপামিন, অক্সিটোসিন এবং এন্ড্রোফিন। এই হরমোন চারটি মানুষের সুখ, দুঃখ, রাগ অনুভূতি-সমূহকে নিয়ন্ত্রণ করে। বাস্তবিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে মস্তিষ্ক বিভিন্ন সময়ে প্রয়োজন অনুসারে বিভিন্ন হরমোন নিঃসরণ করে।
সেরোটোনিন, ডোপামিন, অক্সিটোসিন ও এন্ড্রোফিন এর ভূমিকা:
সেরোটোনিন: হাসি-কান্না এবং যৌন আকাঙ্ক্ষা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
ডোপামিন: আনন্দ অনুভূতি এবং আত্মপ্রেরণা যোগাতে সাহায্য করে।
অক্সিটোসিন: বন্ধন, ভালোবাসা এবং বিশ্বাস গড়তে সাহায্য করে।
এন্ড্রোফিন: ব্যথা-মুক্তি, শান্ত অনুভূতি বা শিথিলকরণে সাহায্য করে।
সেরোটোনিন, ডোপামিন, অক্সিটোসিন ও এন্ড্রোফিন হরমোনগুলোর রাসায়নিক পরিচিতি :
সেরোটোনিন: এর আণবিক গঠন হলো C10H12N2O এবং এর রাসায়নিক নাম 5-hydroxytryptamine, বা 5-HT। এটি ট্রিপটোফ্যান (অ্যামিনো এসিড) দ্বারা সংশ্লেষিত হয়।
ডোপামিন: এর আণবিক গঠন C8H11NO2। ডোপামিন হলো একটি বেনজিন রিং দ্বারা গঠিত একটি ক্ষুদ্র অণু। যা দুটি ছোট বাহু (হাইড্রক্সিল গ্রুপ) এবং একটি লেজ (ইথাইল চেইন) দ্বারা এটিকে ধরে রাখে, যা কিছুটা এরকম 4-(2-aminoethyl)benzene-1,2- diol। এটি ক্যাটেকোলামাইন নামক একটি গ্রুপের সবচেয়ে সহজ জাত, যার মাধ্যমে আমাদের শরীরের অন্যান্য যোগাযোগ মাধ্যম যেমন নরপাইনফ্রাইন এবং এপিনেফ্রাইন একসাথে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
অক্সিটোসিন: এর আণবিক গঠন C43H66N12O12S2। অক্সিটোসিন মানবদেহের জিনের একটি বিশেষ কোড থেকে আসে যাকে বলা হয় OXT জিন। অক্সিটোসিনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ নয়টি বিল্ডিং ব্লকের দ্বারা গটিত একটি ছোট চেইনের মতো। যা দেখতে কিছুটা এরকম: Cys – Tyr – Ile – Gln – Asn – Cys – Pro – Leu – Gly।
এন্ড্রোফিন: এর আণবিক গঠন C77H120N18O26S। এন্ড্রোফিন তিন প্রকারে আসে: α-endorphin, β-endorphin এবং γ-endorphin। এই এন্ডোরফিনগুলো প্রোপিওমেলানোকোর্টিন নামক প্রোটিন থেকে তৈরি হয়। এদের সবার শুরুতে মেট-এনকেফালিন নামে একটি বিশেষ অংশ রয়েছে: Tyr-Gly-Gly-Phe-Met। এই মেট-এনকেফালিন এর অংশ এন্ড্রোফিনের ফাংশন সঠিভাবে পরিচালনা করতে সহায়তা করে।
হরমোন এর মেজাজ পরিবর্তন প্রক্রিয়া:
লক্ষ কোটি কোষের সমন্বয়ে তৈরি আমাদের দেহ। আমাদের এই দেহে কোষগুলো একে অন্যের সাথে সরাসরি যুক্ত নয়। তাই কোষগুলো একে অন্যের সাথে যুক্ত থাকতে হরমোন নামক এই রাসায়নিক বার্তা ব্যবহার করে। হরমোন অনেকটা তথ্য শেয়ার করার জন্য ক্লাসে নোট পাস করার মতো সকল অঙ্গানুসমূহকে তথ্য-বার্তা পাঠিয়ে দেয়। তবে এক্ষেত্রে একজন মানুষের মেজাজ বা আবেগ পরিবর্তন করার জন্য যে চারটি বিশেষ হরমোন রয়েছে, সেগুলো বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রয়োজানুসারে মস্তিষ্ক হতে নিঃসৃত হয়।
উদাহরণস্বরূপ, একজন ব্যক্তির কোনো কারণে খুশি বোধ করা, আবার কোনো ক্ষতস্থানে দ্রুত রক্ত জমাট বাঁধা এবং অস্বস্তি বোধ করার মতো জিনিসগুলোতে এই সেরোটোনিন হরমোন কাজ করে। আবার কেউ যখন কোন কিছু দেখে অনুপ্রাণিত হয় বা খুব আনন্দ অনুভব করে তখন মস্তিষ্কে ডোপামিন হরমোন নিঃসৃত হয়। একইভাবে কারো উপর ভালোবাসা বা মায়ার জন্ম হলে অক্সিটোসিন এবং ব্যাথা-মুক্তি বা রিল্যাক্স ফিল করলে এন্ড্রোফিন হরমোন নিঃসরণ হওয়ার মাধ্যমে হরমোন মানুষের মেজাজ বা আবেগ পরিবর্তন করতে ভূমিকা রাখে।
মানবদেহে এই চারটি হরমোনের যেকোনো একটির অভাব থাকলে কী হতে পারে?
আবেগ-অনুভূতিই মানুষকে অন্যান্য সকল সাধারণ প্রানী থেকে আলাদা করে। আর এই আবেগ তৈরির পেছনে রয়েছে চারটি মূল হরমোন। এই চারটি হরমোনের যেকোন একটি যদি কোন ব্যাক্তির মধ্যে অনুপস্থিত থাকে তাহলে সে ব্যাক্তি সর্বদা ভয়াবহ মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হবে। আর যদি কোন ব্যাক্তির মধ্যে আবেগ হরমোন দ্বারা সৃষ্ট কোন আবেগ অনুপস্থিত থাকে তাহলে সে ব্যাক্তিকে Alexithymia আক্রান্ত বলে গণ্য করা হয়।
ধরা যাক, কোন ব্যক্তির মধ্যে সেরোটোনিন হরমোন অনুপস্থিত। যেহেতু সেরোটোনিন হরমোন হাসি-কান্না এবং যৌন আকাঙ্ক্ষা নিয়ন্ত্রণ করে, সেহেতু সেরোটোনিন হরমোন অনুপস্থিত ব্যক্তি কখনোই কী কারণে হাসতে হয় বা কী কারণে কান্না করতে হয় তা কখনো বুঝতে পারবে না এবং কখনো যৌন কামনাও তার মধ্যে থাকবে না।
আবার কোন ব্যক্তির মধ্যে ডোপামিন হরমোন অনুপস্থিত থাকলে সে ব্যক্তি কখনোই আনন্দ অনুভব করতে পারবে না এবং তার মধ্যে কখনোই আত্মপ্রেরণার যোগান হবে না। একইভাবে যদি কোন ব্যক্তির মধ্যে এন্ড্রোফিন অনুপস্থিত থাকে তাহলে সে ব্যক্তি ব্যথা, স্পর্শ অনুভব করতে পারবে না। যখন কোন ব্যক্তিকে প্যারালাইসিস রোগ আক্রমণ করে, তখন সে ব্যক্তির মধ্যে এন্ড্রোফিন হরমোন নিঃসরণ হওয়া বন্ধ হয়ে যায়।
এবার আসা যাক অক্সিটোসিন হরমোনের ক্ষেত্রে। এই হরমোনটি উপরোল্লিখিত বাকি তিনটি আবেগ নিয়ন্ত্রণকারী হরমোন থেকে কিছুটা ভিন্ন। অক্সিটোসিন মানুষের মধ্যে ভালোবাসা ও বিশ্বাস গড়তে সাহায্য করে। মানুষ যখন অন্য কোন ব্যক্তিকে ভালোবাসে তখন তার মধ্যে অক্সিটোসিন নিঃসৃত হয়। তবে এই হরমোন নিঃসরণ হওয়ার শুরু থেকে ৩ বছর পর্যন্ত বেশি পরিমাণে নিঃসৃত হয়। ৩ বছর পর এই হরমোন নিঃসরণের মাত্রা কমে যায়। তাই ভালোবাসার ৩ বছর পর্যন্ত একে অন্যের প্রতি যে টান থাকে তা আস্তে আস্তে কমতে থাকে। আবেগ নিয়ন্ত্রণকারী হরমোনের মধ্যে এটিই একমাত্র যা মানবদেহে কম-বেশি থাকতে পারে। তবে মাঝে মধ্যে অধিক দুশ্চিন্তার কারণে মস্তিষ্ক সঠিক সময়ে সাড়া দিয়ে সঠিক হরমোন নিঃসরণ করতে না পারলে তখন একজন ব্যক্তির মাঝে বিষণ্ণতা বা উদ্বেগ সৃষ্টি হয়।
তাই মানবদেহে আবেগ নিয়ন্ত্রণকারী এই চারটি হরমোনের কোনো একটিও অনুপস্থিত থাকলে একজন ব্যক্তির দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় চরম বিপর্যয় নেমে আসে।
মোঃ শাহিনুল ইসলাম রাফি / নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া, ক্লীভল্যান্ড ক্লিনিক, অ্যাটলাস বায়োমেড, হেলথডিরেক্ট, হেলথলাইন, হেলথ.হ্যাভার্ড.এডু, সাইকম
+1
1
+1
1
+1
1
+1
+1
1
+1
+1