আপেক্ষিকতার নাম শুনলেই আমাদের মাথায় একজন বিজ্ঞানীর মুখই ভেসে উঠে। নিঃসন্দেহে তিনি আলবার্ট আইনস্টাইন। এই ইহুদি বিজ্ঞানী তাঁর জীবদ্দশায় পদার্থবিদ্যায় এমন দুইটি তত্ত্ব দিয়ে যান, যা একশ বছর পরে এসেও বিজ্ঞানীদের কাছে সমান আগ্রহের বিষয়বস্তু এবং কল্পনাশক্তির প্রখর ক্ষমতার প্রতিচ্ছবি।
আপেক্ষিকতা তত্ত্ব এই যাবত কালে ঘটা প্রচুর পরিক্ষা-নিরিক্ষায় উত্তীর্ণ বলে প্রমাণিত হয়ে এসেছে। কিন্তু সম্প্রতি বিজ্ঞানীদের গবেষণায় উঠে এসেছে মহাকর্ষের মহাজাগতিক ত্রুটি, যা আমাদের আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্বের সিমাবদ্ধতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।
সম্প্রতি ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াটারলু এবং ইউনিভার্সিটি অফ ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার একদল গবেষক মহাবিশ্বের মাধ্যাকর্ষণ শক্তির একটি সম্ভাব্য “মহাজাগতিক ত্রুটি’ আবিষ্কার করেছেন এবং মহাজাগতিক স্কেলে মাধ্যাকর্ষের এই অদ্ভুত আচরণ ব্যাখ্যা করেছেন। আমরা যখন মহাজাগতিক স্কেলে (গ্যালাক্সি ক্লাস্টারের স্কেলে) মহাকর্ষকে বোঝার চেষ্টা করি , তখন আমরা সাধারণ আপেক্ষিকতার ভবিষ্যদ্বাণীগুলির সাথে আপাত দৃশ্যটিতে অসংগতি খুঁজে পাই।
এমনটা মনে হয় যেন মহাকর্ষ নিজেই আইনস্টাইনের তত্ত্বের সাথে পুরোপুরি মিলতে চাচ্ছে না। বিজ্ঞানীরা এই অসামঞ্জস্যতাকে বলছেন একটি মহাজাগতিক ত্রুটি। বিজ্ঞানীরা লক্ষ করেন, বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরত্বের সাথে কাজ করার সময় মাধ্যাকর্ষণ প্রায় এক শতাংশ দুর্বল হয়ে যায়। এই ঘটনার মাধ্যমেই আপেক্ষিকতার ত্রুটি সকলের সামনে আসে।
বিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে, পদার্থবিদ এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা একটি গাণিতিক মডেল তৈরি করার চেষ্টা করছেন যা সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্বের আপাত অসঙ্গতিগুলিকে ব্যাখ্যা করতে পারে। এই প্রচেষ্টাগুলির মধ্যে অনেকগুলি ওয়াটারলুতে সংঘটিত হয়েছে, যা ফলিত গণিতবিদ এবং জ্যোতির্পদার্থবিদদের মধ্যে চলমান আন্তঃবিভাগীয় সহযোগিতার ফলে অত্যাধুনিক মহাকর্ষীয় গবেষণার একটি দীর্ঘ ইতিহাস তৈরি করেছে।
প্রকল্পের প্রধান গবেষক এবং সাম্প্রতিক ওয়াটারলু ম্যাথমেটিকাল ফিজিক্সে স্নাতক রবিন ওয়েন বলেছেন,
“বিগ ব্যাং থিওরাইজ করা থেকে শুরু করে ব্ল্যাক হোলের ছবি তোলা পর্যন্ত সমস্ত কিছুর জন্য মহাকর্ষের এই মডেলটি অপরিহার্য হবে।”
গবেষকদের দলটি মহাজাগতিক সমস্যা এর নতুন মডেলে আইনস্টাইনের গাণিতিক সূত্রগুলিকে এমনভাবে সংশোধন করেন এবং প্রসারিত করেন যাতে সেটি সাধারণ আপেক্ষিকতার বিদ্যমান সফল ক্ষেত্রগুলিকে পরিবর্তন না করে, মহাজাগতিক পরিমাপের অসঙ্গতিকে সমাধান করে।
ওয়াটারলু বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং পেরিমিটার ইনস্টিটিউটের গবেষক নিয়ায়েশ আফশোর্দি বলেছেন,
“প্রায় এক শতাব্দী আগে, জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছিলেন যে আমাদের মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে। দূরবর্তী ছায়াপথগুলি, তারা এত দ্রুত গতিতে চলেছে যে, তারা প্রায় আলোর গতিতে চলছে বলে মনে হচ্ছে। যা আইনস্টাইনের তত্ত্ব দ্বারা অনুমোদিত সর্বাধিক গতি ৷
আমাদের অনুসন্ধানে বোঝা যায়, সেই স্কেলে আইনস্টাইনের তত্ত্বও অপর্যাপ্ত হতে পারে। এই নতুন মডেলটি মহাজাগতিক ধাঁধার প্রথম সূত্র হতে পারে যা আমরা স্থান এবং সময় জুড়ে সমাধান করতে শুরু করেছি।”
গবেষণাপত্রটি জার্নাল অফ কসমোলজি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোপার্টিকেল ফিজিক্স এ প্রকাশিত হয়েছে। গত ১০০ বছর ধরে, পদার্থবিজ্ঞানীরা কীভাবে মহাকর্ষ বল মহাবিশ্ব জুড়ে কাজ করে তা ব্যাখ্যা করার জন্য আলবার্ট আইনস্টাইনের “সাধারণ আপেক্ষিকতা” তত্ত্বের উপর নির্ভর করেছেন। জেনারেল রিলেটিভিটি আমাদের গ্রাভিটি বা মাধ্যাকর্ষণ সম্পর্কে চিরায়িত ধ্যানধারণা পাল্টে দিয়ে নতুন ভাবে ভাবতে শেখায়।
নিউটনিয়ান যুগে মানুষ ভাবতো, মহাকর্ষ একটি বল। আইনস্টাইন আমাদের দেখান মহাকর্ষ স্থানকালের বক্রতা ছাড়া কিছুই না। সাধারণ আপেক্ষিকতা, অগণিত পরীক্ষা এবং পর্যবেক্ষণ দ্বারা নির্ভুল বলে প্রমাণিত।
এর থেকেই আমরা ধারণা পাই যে মাধ্যাকর্ষণ কেবল তিনটি ভৌত মাত্রা নয়, একটি চতুর্থ মাত্রাকেও প্রভাবিত করে। আর সেটিই হল সময়। শত কলঙ্ক থাকা সত্ত্বেও চাঁদ যেমন সগৌরবে মানবজাতির মাঝে মুগ্ধতা ছড়িয়ে আসছে, তেমনি ভাবে এই সূক্ষ্ম ত্রুটি নিয়ে আইনস্টাইন তাঁর আপেক্ষিকতা তত্ত্ব দিয়ে মানুষকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বিস্ময় বিলিয়ে যাবেন।
কৃষ্ণ দেব নাথ / নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: স্পেস.কম, ফিজিক্স.অর্গ