ফেসবুক বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর একটি। বেশ কয়েক বছর ধরেই মানুষ মস্তিষ্কের ভাবনা বোঝার ডিভাইস আবিষ্কার করার চেষ্টা করে আসছে। এটি নিয়ে তারা বিভিন্ন সময় কিছু ধারণাও দিয়েছে। তবে এবার স্পষ্টতই ফেসবুক একটি নতুন নিউরাল সেন্সর তৈরির পরিকল্না করছে যা মানুষের মস্তিষ্কের নিউরন থেকে সরাসরি চিন্তাভাবনা সংগ্রহ করতে পারবে এবং সেগুলো অক্ষরে রূপান্তর করতে পারবে!
ফেসবুক ২০১৭ সালে এই ধরনের প্রযুক্তির ঘোষণা দেয়। এরপর এক বছরের মধ্যেই তারা ব্রেইন-মেশিন ইন্টারফেস গবেষণায় বিনিয়োগ করে। ২০১৯ সালে ফেসবুক যুক্তরাষ্ট্রের একটি ছোট স্টার্ট-আপ প্রতিষ্ঠান, সিটিআরএল ল্যাবসকে কিনে নেয় যা মাইন্ড-রিডিং টেকনোলজি তৈরী করে। সিটিআরএল-ল্যাবস কিনে নেওয়ার মধ্য দিয়ে এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আরেক ধাপ এগিয়ে যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম প্রতিষ্ঠানটি।
সিটিআরএল ল্যাবস নিউরাল সেন্সরভিত্তিক একটি রিস্টব্যান্ড জাতীয় ডিভাইস তৈরি করতে কাজ করছে। তাদের দাবি, এই ডিভাইসটির মাধ্যমে মানুষের ব্রেইনকে কম্পিউটারের সাথে সংযোগ করা যাবে। এটি মস্তিষ্কের ইলেকট্রিক্যাল সিগন্যাল ডিকোড করতে পারবে। রিস্টব্যান্ডটি পরে চিন্তা-ভাবনাকে ব্যবহার করে কম্পিউটার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। মস্তিষ্ক থেকে তরঙ্গ কম্পিউটারে যুক্ত হওয়ার পদ্ধতিটি ‘ব্রেইন কম্পিউটিং’ নামে পরিচিত।
প্রাথমিকভাবে প্যারালাইসিস রোগীদের সাহায্য করার উদ্যেশ্যে স্বল্পমেয়াদী লক্ষ্য হিসেবে এটি শুরু করার চিন্তা করেছিলো ফেসবুক। যা তাদের ব্রেইনকে কম্পিউটারের সাথে সংযোগ করে, কোনো রকম পেশী নাড়াচাড়া ছাড়াই মস্তিষ্কের সংকেত ডিকোড করে সেটিকে অক্ষরে রূপান্তর করতে পারবে। তবে, এটি এখন শুধুমাত্র চিন্তাশক্তি ব্যবহার করে, একাই কীবোর্ড থেকে অগমেন্টেড রিয়েলিটি গ্লাস পর্যন্ত ডিজিটাল ডিভাইসগুলি নিয়ন্ত্রণ করতে মানুষকে সক্ষমতা দেওয়ার দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে।
দীর্ঘমেয়াদী প্রযুক্তি পণ্য এবং হার্ডওয়্যার নিয়ে কাজ করা ‘ফেসবুক রিয়েলিটি ল্যাবস‘ নামে একটি বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, সান ফ্রান্সিসকোর গবেষকদের সাথে এই প্রযুক্তিটি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। ২০১৯ সালে, নেচার কমিউনিকেশনস জার্নালে প্রকাশিত একটি সমীক্ষা দেখিয়েছিল গবেষকরা কীভাবে ব্রেইন-কম্পিউটার ইন্টারফেস ব্যবহার করে মানুষের মস্তিষ্ক থেকে কথাকে সরাসরি একটি পর্দায় ডিকোড করতে সক্ষম হন।
কিভাবে কাজ করবে ফেসবুকের নিউরাল সেন্সর?
কথা বলার সময় মানুষের মস্তিষ্ক, মোটর কর্টেক্স থেকে চোয়াল, ঠোঁট এবং ল্যারিক্সের পেশীগুলোকে তাদের গতিবিধি সমন্বয় করার জন্য এবং শব্দ উৎপন্ন করার জন্য সংকেত প্রেরণ করে। কিন্তু এক্ষেত্রে ফেসবুক একধরনের ‘সাইলেন্ট স্পিচ সিস্টেম’ তৈরি করতে যাচ্ছে, যা মস্তিষ্কের ভাবনাগুলোকে ডিকোড করে সরাসরি মিনিটে ১০০ টির মতো শব্দ টাইপ করতে পারবে। একজন মানুষ ফোনে এক মিনিটে যত শব্দ টাইপ করতে পারে, এটি তার চেয়ে দ্রুত কাজ করতে সক্ষম হবে।
প্রতিবেদন অনুসারে, সেন্সরটি মস্তিষ্ক থেকে মেরুদণ্ডের কর্ড, বাহু এবং ডান হাতের কব্জির মাধ্যমে নিউরাল সিগন্যাল নেবে। এটি ব্যবহারকারীদেরকে তাদের চিন্তার ভিত্তিতে শারীরিক ক্রিয়াও করতে দিবে। ফেসবুকের মতে, এটি ব্যবহারকারীদেরকে কোনো ভার্চুয়াল অবজেক্ট ধারণ করতে, টাইপিং এবং ভিডিও গেমের চরিত্র নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়তা করবে। এর মাধ্যমে শুধু ইচ্ছা করলেই কারো সাথে নিজের ছবিও শেয়ার করা যাবে।
প্রযুক্তিটি ইলন মাস্কের ‘নিউরালিংক‘ কোম্পানির ব্রেইন-রিডিং প্রযুক্তির অনুরূপ। প্রযুক্তিবিদদের মতে, এমন আবিষ্কার সত্যিকার অর্থে একটি কঠিন কাজ।
মানুষের মস্তিষ্কের ওপর এই ধরনের ডিভাইস নিয়ে কাজ করা একজন বিজ্ঞানী, শেফিল্ড ইউনিভার্সিটির গবেষক, মাহনাজ আরবনেহে এ পদ্ধতিটিকে ‘নন-ইভ্যাসিভ টেকনিক’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তার মতে, এ প্রযুক্তিতে বিদ্যুৎবাহক মাথার খুলির ওপরে পৌঁছাবে; ব্রেনের ভেতরে নয়। এর মাধ্যমে ইলেকট্রিক্যাল অ্যাক্টিভিটি রেকর্ড করা হবে।
এই ধরনের প্রযুক্তির অগ্রগতি নিয়ে তিনি বলেন, “কয়েক বছর আগেও এটিকে কল্পবিজ্ঞান বলে মনে হতো, কিন্তু এখন এটি বাস্তব। স্নায়ুতন্ত্রের বিশেষ ব্যাধি পারকিনসন রোগীদের জন্য আমরা এমন কিছু প্রযুক্তি ব্যবহার করে সফলতা পেয়েছি।” খুব দ্রুতই বিভিন্ন ল্যাব থেকে এমন ডিভাইস বেরিয়ে যাবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।
বাজফিড নিউজ অনুসারে, ফেসবুক তাদের বার্ষিক সভায় নতুন নিউরাল সেন্সর তৈরির পরিকল্পনা নিয়ে একটি ঘোষণা দিয়েছে। যদিও ওই সভার বিস্তারিত প্রকাশ করেনি সংবাদমাধ্যমটি, তবে তারা জানিয়েছে যে তারা একটি অডিও রেকর্ডিং অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে যা সমস্ত কর্মচারীদের কাছে প্রচারিত হয়েছিলো। এটি ইঙ্গিত দিয়েছে যে ফেসবুক আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বিভাগের উন্নয়নের সাথে যুক্ত কিছু গুরুতর পরিকল্পনা প্রকাশ করেছে এবং দ্রুতই সেটি আনার চেষ্টা করছে।
প্রযুক্তি এবং ডিভাইস দিয়ে আরও স্বাভাবিকভাবে ভাব বিনিময় করা সম্ভব। ফেসবুকের প্রক্রিয়াধীন এই রিস্টব্যান্ড যে কারও ভাবনা-উদ্দেশ্য ক্যাপচার করতে পারবে। নিঃসন্দেহে নিউরাল ইন্টারফেস হতে যাচ্ছে একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার। এর মাধ্যমে পরিবেশের সঙ্গে মানুষের ভাবের আদান-প্রদানে বিস্তর পরিবর্তন আসবে। পাল্টে যাবে মানুষের জীবন। যদি ফেসবুক এ উদ্ভাবন করে ফেলে তবে সেটা হবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তথা প্রযুক্তি ইতিহাসের নতুন অধ্যায়। ফেসবুকের সিটিও মাইক শ্রোফারের মতে, এটি বাস্তবায়ন হলে কোটি কোটি মানুষের জীবন উন্নত হবে।
কিন্তু যেকোনো নতুন প্রযুক্তির কথা সামনে আসলেই এর উপকারের পাশাপাশি ক্ষতির চিন্তার উদ্ভব ঘটে। এ ক্ষেত্রেও তার বাইরে নয়। ফেসবুকের মতো প্রতিষ্ঠান তাদের লাভ ছাড়া কোনো প্রযুক্তি আনবে না। ব্রেইন-কম্পিউটার ইন্টারফেস দ্বারা মানুষের প্রাইভেসি লঙ্ঘনের ঝুঁকি ব্যাপক। এটি আবিষ্কার হলে পরবর্তী প্রজন্মের কম্পিউটার প্রযুক্তি নিয়ে নিশ্চিত বিপদে পড়তে হবে।
তাই আপাতদৃষ্টিতে চমকপ্রদ মনে হলেও ফেসবুক কেনো মানুষের ব্রেইন কে টার্গেট করেছে সেটি আসলে ভাবার বিষয়। তাই, তারা আসলে কী করতে চায় এটি আমাদেরকে বুঝতে হবে এবং এর ব্যবহার সম্পর্কে সচেতন হতে হবে।
রেজুয়ানা ফাউজিয়া রিনাত/নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্রঃ TechWireAsia , উইওন নিউজ